Published : Monday, 28 February, 2022 at 12:00 AM, Update: 28.02.2022 1:07:54 AM
তানভীর দিপু:
মাথার
উপরে বোমা আর ক্ষেপনাস্ত্র হামলার ভয়, চারপাশে ধ্বংসস্তুপ- প্রাণসংহারী
যুদ্ধকালীন এই সময়ে ৪ দিনের প্রচেষ্টায় ইউক্রেন ছেড়ে পোল্যান্ডের শরনার্থী
শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন কুমিল্লার তরুণ নাজিউর রহমান আদনান। ইউক্রেনে রাশিয়ার
হামলা শুরুর পর ২২ ফেব্রুয়ারি ভোররাত ৪টায় সাইরেনের শব্দে শুধু একটা
জ্যাকেট আর বুটজুতা পরেই ছুটেন আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে। তারপর ৪ দিন দুর্বিসহ
জীবন কাটিয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় অবশেষে পোল্যান্ডে পৌঁছান তিনি। প্রাণ
হাতে নিয়ে আশ্রয়ের সন্ধ্যান খোঁজা সেই গা শিহরিত সময়ের চিত্র দৈনিক
কুমিল্লার কাগজের কাছে তুলে ধরেন আদনান। জানান ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।
কুমিল্লার
নেউরা-ঢুলিপাড়া এলাকার মৃত শাহ আলম মজুমদারের ছেলে আদনান পড়াশুনার
উদ্দ্যেশে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাড়ি জমান ইউক্রেনে। থাকতেন দেশটির
রাজধানী কিয়েভে।সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি একটি ব্যবসা
প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তিনি। তার মা এবং একমাত্র বোন ইংল্যান্ডে থাকেন।
যুদ্ধকালীন
মুহূর্তে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকা সেই দুর্বিসহ সময়ের বর্ণনা
করতে গিয়ে এ প্রতিবেদককে আদনান জানান- ‘কাজ থেকে এসে নিজের এপার্টম্যান্টে
রান্না শেষ করে রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুমানোর জন্য শুয়েছি। মাঝরাতে হঠাৎই
বোম্বিইংয়ের (বোমাবর্ষণ) শব্দ শুনতে পেলাম, এলার্মের আওয়াজও শুনালাম। সবার
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমিও দৌঁড়ালাম। এত আওয়াজ আর চিৎকার এর আগে কখনো
শুনিনি। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কাপড় পরার কোন সুযোগ নাই। শুধু
ডকুমেন্ট কিছু নিয়েই দৌঁড়। মোবাইলে কোন নেটওয়ার্ক ছিলো না, এর আগের রাতেই
সাইবার এ্যাটাক হয়েছিলো। শুধু খুঁজছিলাম কোথাও নিরাপদ বাংকার পাওয়া যায় কি
না, সব বাংকার নিরাপদ ছিলো না। আমি যে এলাকায় ছিলাম। ওই রাতে অনেক শীত
ছিলো, বৃষ্টি হচ্ছিলো। সবার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমি যে এলাকায় ছিলাম
বজনিয়াকি, ওসাকস্কি টাউন হল আমার এলাকায় বোম্বিং হইসে, মিসাইল এ্যাটাক
হইসে। সেই বোম্বিইংয়ে আমার দুইটা ইন্ডিয়ান ছোট ভাই মারা গেছে বলে শুনেছি।
ওদের সাথে আমার মাত্র কয়েক দিন আগেও কথা হয়েছিলো। আমরা একই কোম্পানিতে
চাকরি করতাম।’
গত ২২ তারিখ ভোর রাতে ইউক্রেনে রাজধানী কিয়েভে রাশিয়ার
অতর্কিত হামলায় পালিয়ে বাঁচার ঘটনায় জানাচ্ছিলেন সেখানে থাকা বাংলাদেশি
নাগরিক নাজিউর রহমান আদনান।
আদনান জানান, যুদ্ধ শুরু হবার পর প্রথম ছোট
ছোট বোম্বিংয়ের আওয়াজ শুনছি। এরপর মিসাইল এ্যাটাক শুরু হলো। আগুনের গোলার
মত। মানুষের চিৎকার তো আছেই। দৌঁড়ে কোন রকম একটা বাংকার ঢুকলাম। অন্ধকার
সেখানে, একটা ছোট বাংকারে কয়েক শ’ মানুষ। কিছু কিছু বাংকার আবার প্রটেকশন
থেকেও না থাকার মত-কি যে আতংক। সাইবার এ্যাটাক হবার কারনেই সাধারণ মানুষের
বেশি কষ্ট হচ্ছিলো। খাবার দাবার, পানির অভাব সাথে প্রচন্ড শীত। অনেকেই
হাইপোথারমিয়া তে ভুগতে শুরু করে।
২৫ তারিখ স্টেট অব ইমারজেন্সি যখন
ঘোষনা কওে তখন আমরা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে পোল্যান্ড সীমান্তবর্তী
এলাকায় এগুতে শুরু করি। কোন গাড়ি-ঘোড়া কিছু ছিলো না। চতুর্দিকে বোম্বিং
চলছিলো। প্রাণের ভয়ে সব বন্ধ ছিলো। প্রায় ৮ কিলোমিটার হেঁটে একটা সাবওয়েতে
গিয়ে গিয়ে সেখান থেকে সেন্ট্রাল স্টেশণ বোগজালে গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে ৪
টা ট্রেনে উঠতে গিয়েও উঠতে পারিনি। সেখান থেকে ইউক্রেনিয়ানদেও প্রাধান্য
দিয়ে ট্রেনে উঠানো হচ্ছিলো, যারা এসব ট্রেনে করে বর্ডারের কাছে শহর গুলোতে
পৌঁছাবে। তারপর কোন রকম একটা ট্রেনে উঠে সাড়ে ষোল ঘন্টা জার্নি কওে লিভিব
শহরে পৌঁছাই। সেখানে যাবার পওে আরেক বিপদ, সেখানে কোন খাবার নাই-পানি নাই।
তার উপর দীর্র্ঘ জার্নি করে শরীর অচল। লিভিব থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে
ইউক্রেন-পোল্যান্ড বর্ডার। সাইবার এ্যাটাকের কারনে অনেকেই বুথ থেকে টাকা
তুলতে পারি নাই। তাও দুই জন ভারতীয় দুই জনকে সাথে নিয়ে ৮ হাজার ইউক্রেনিয়ান
মুদ্রা দিয়ে একটি প্রাইভেট কার ঠিক করে বর্ডারে পৌছাই। অনেকেই সেখানে অনেক
কষ্টে ছিলো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা একটা ইউক্রেনিয়ান দলের সাথে কোন
রকমে বর্ডার পার হলাম। তারপর মনে হলো- আল্লাহ অনেক নিরাপদে আমাদের
পোল্যান্ড পৌঁছালেন।
আদনান জানান, ইউক্রেনের বেশির ভাগ বাংলাদেশিরাই
অবৈধ ভাবে বসবাস করতো। তাই ্ই মুহুর্তে তাদের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। কিন্তু
পোল্যান্ড সীমান্ত অত্রিক্রম করার পর আমরা যে আতিথেয়তা পেয়েছি তা অতূলনীয়।
সেখানে বাংলাদেশিরা যে শরনার্থী শিবিরে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে তা অনেক
ভালো। আশা করি কোন বাঙালিই কষ্ট পাবেন না।