সৈয়দ আহমাদ তারেক ||
বঙ্গবন্ধুর সুখের অনিন্দ্য সময়গুলোর মনোহর জীবনের স্মৃতিধন্য কুমিল্লাকে বঙ্গবন্ধুর নিজেদের মতো করে আমাদের কি দেখা হয়েছে? সংগ্রামের সঠিক পরিচালনার জন্যে সমগ্র জীবন যাপন আকন্ঠ নিমজ্জিত করেছেন। কতো বিচিত্র বর্ণিল আপাদমস্তক বাংলার, বাংলাদেশে নির্লোভ সততা আর কোথায় দেখি ?
একা, একা, দুপুরবেলা। উদ্বেগহীন পা দুটো কুমিল্লা টাউন হল মাঠ থেকে জেনে নিলো, ওখানে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে ‘মুক্তির উৎসব ও সুবর্ণ জয়ন্তী মেলা’ হচ্ছে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে।
প্রশাসনিক আয়োজনে আমার ব্যক্তিগত অসূয়া নেই, অথবা অযথাই বিব্রত এইসব কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিকতায়। চোখ আটকে গেলো সাদা মাটা প্যানাফ্লেক্সের লাল-সবুজে আকর্ষণহীন। মর্মাহত হইনি, বরং উৎফুল্ল হয়ে কী করব বুঝতে না পেরে সামনে এগোতেই দেখি লেখাঃ ‘আলোক চিত্রে কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধু’।
প্রদর্শনীর উন্মুক্ত মাঠের একপাশে অজস্র লাল প্লাষ্টিকের আরএফএল ডিঙ্গিয়ে প্রবেশ করতে পারি। পা রাখি মেরুন রং জুট ম্যাটে। চৈত্রের সন্ধ্যায় উড়ন্ত ধুলোবালি উড়ে আসে প্রান্তর ছুঁয়ে। তবুও দেখি সাদা থান কাপড়ের শরীর ঘেঁষে কুমিল্লা বঙ্গবন্ধুর ৪১টি আলোকচিত্র।
প্রথম ছবি ৪ জুলাই ১৯৭২ কুমিল্লা হাউজিং এস্টেটের মাঠের (অভয় আশ্রম বা কেটিসিসি এর সামনে) জনসমুদ্রে ভাষণ দিচ্ছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একটু হেলে সামনে এগুতেই একজন সুশোভন মা ও তার আত্মজাকে জানালেন, বঙ্গবন্ধুর পদচারণা এই কুমিল্লায় নানা ঘটনার স্মৃতিবহুল ছবি।
নির্বাচনী প্রচারণায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১১ মার্চ ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে সামরিক একাডেমীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন।
মাত্র কিছু দেখা হলে আরো আরো কিছু দেখার বাসনা প্রবল। ইতিমধ্যে পাশে দাঁড়ানো যে, তার বয়স না জানলেও মনে হয় স্কুল ছাত্র। পঞ্চাশ বছরের পরিক্রমায়, একাত্তরের গ্লানি, স্বেদগন্ধময় ক্লান্তিগুলোর কথা অথবা অদম্য স্পৃহায় গ্রাম বাংলার কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী জনতার ত্যাগ তিতিক্ষার কথা তার জানা নেই। সে জানালো তার পাশের বাসায় খ্রীষ্টান পাড়ায় থাকতেন, শুনেছি নেতা ? যখন নয়মাসের যুদ্ধের কথা বলেন রাগান্বিত অথবা নির্লিপ্ত নিম্নকন্ঠে, স্কুল ছাত্রকে বলি, এই দেখো, আমাদের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে কুমিল্লা পুলিশ লাইনে। পাশে কুমিল্লা জেলা আওয়ামী নেতা অধ্যাপক খোরশেদ আলম।
স্কুলছাত্রটি আমাকে ফেলে এগিয়ে গিয়ে বলে, ২৩শে জানুয়ারি ১৯৭০ আপনার বয়স। বলি, ষোল কি সতেরো। সে বললো, দেখুন, দেখুন টাউন হলের মাঠের জনসভা মঞ্চে মানপত্র দেখছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পাশে দাঁড়িয়ে মানপত্র পাঠরত আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আবদুর রউফ। আরেক ছবিতে বঙ্গবন্ধুকে ফুলের তোড়া দিচ্ছেন অধ্যাপক আবদুর রউফ।
অজস্র স্মৃতিজাগানিয়া বেদনা বিষাদের এই ২০২২ সালে মুক্তির উৎসব সুবর্ণ জয়ন্তীর সুশোভন আনন্দের ছবিগুলো স্মৃতির বেদনাকেও আপ্লুত করে।
অপরদিকে বুকের ভেতর থেকে সূর্য জাগে তোমার উত্তোলিত গর্বিত তর্জনীর নির্দেশে বাঙালি শ্রেষ্ঠ পুরুষের শুধুই ছবিই দেখি। শুধু কি তুমিই ছবি। এ ছবিটি আমাকে স্থির, চঞ্চল নাকি বিহ্বল করেছে, তা ইন্দ্রিয়াতীতের বাইরে চলে যাচ্ছে যেন। আমার চিন্তার ঘনঘোর উঠেছে, দেখেছে ১১ই মার্চ ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে সামরিক একাডেমীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। পেছনে তৎকালীন কর্ণেল জিয়াউর রহমান।
আরো, আরো পুরোনো কিছু আলোকচিত্রও মনে করিয়ে দেয় যুক্তফন্ট্রের মন্ত্রিসভার ছবি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঠিক পেছনে মন্ত্রী আবদুর রহমান খান, পেছনে থেকে চতুর্থ: মন্ত্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল খানের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার। আবার দেখি, কোনটা দেখে কোনটা দেখি-দ্বিধান্বিত মন আমাকে ক্ষুণ্ন করেনা।
স্বল্প পরিসরের ধুলামাখা দশ বাই ছত্রিশ ফুটের আয়োজনে জেলা প্রশাসনের সাড়ম্বরে ‘আলোকচিত্রে কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক আলোকচিত্র সমূহের সংগ্রহ কিভাবে ?
সমন্বিত, প্রয়াসে নাকি ব্যক্তিগত সংগ্রহে ?
বেশ কিছু স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগে জানা যায়, দৈনিক কুমিল্লার কাগজ সম্পাদক এর একান্ত দীপ্যমান দেশপ্রেম থেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংগ্রামী সময়ের গবেষণায়, যে যুবক যুদ্ধ না দেখেই যুদ্ধকে ঘৃণা করতে অসামান্য সংগ্রহের অনিশ্চিত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে মহতী কাজে উৎসর্গীত প্রাণ-আপনাকে রক্তিম অভিবাদন, অমূল্য সংগ্রহের দীপ্ত আলোর রেখা।
অপরিসীম আনন্দের সাথে কিছুটা দু:খবোধ এই যে, বাংলার অকুতোভয় মানব জীবন প্রশাসনের উদাসীন ভূমিকায় নিজেদের প্রাধান্য নিয়েই কি সংগ্রাহক- গবেষকের নাম উচ্চারণে ও ব্যানারে খচিত বালখিল্যতা অবজ্ঞা ?
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর মুক্তির উৎসবে আমাদের জাতির জনকের দুর্লভ ও তেজোদীপ্ত বলিষ্ঠ সত্তার পূর্ণ বাঙালির প্রকাশ অভিলাষ নিয়ে যাবেই সমুখে।
স্থানু দাঁড়িয়ে থাকি। সহসা সচকিত হতে পারি না। ছবিগুলো দেখতে দেখতে আমি উত্তেজিত, স্পন্দিত। কে সে সুপুরুষ, দীর্ঘদেহী, জলদ গম্ভীর নিনাদে অবিস্মরণীয় বজ্রকন্ঠে তুমিই বলেছিলে ?
আমি নিরুত্তর। শুধু দেখি অপলক চোখের মায়া, সজলতা অতিক্রম করে আমি দেখি কুমিল্লা সেনানিবাস। শহীদ লে. কর্ণেল এম আর চৌধুরী স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সামরিক একাডেমীর জেন্টেলম্যান ক্যাডেটদের প্রথম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১/৬/৬৭ইং তারিখে লাকসাম থানা আওয়ামীলীগ দৌলতগঞ্জ বাজার জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে ৬ দফা দাবির ভিত্তিতে ঐতিহাসিক ৭ জুন স্মরণে বিশাল জনসভা প্রচারপত্রের দুষ্প্রাপ্য ছবিও প্রদর্শিত হয়েছে।
এমনকি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৯৯৬ সালের ১৯ আগস্ট কুমিল্লা জেলা কারাগারে বন্দী মুজিবুর রহমানকে লিখিত বঙ্গবন্ধুর বাজেয়াপ্ত চিঠি দেখে বিস্মিত নয়নখানি উদাসীন, বিভ্রান্ত মনোবেদনায় শিহরিত।
১৯৫২ সালের ২ মে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় অফিস ৯ নবাবপুর রোড, ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মৌলবী আবদুল বারী বি.এলকে লিখিত চিঠি অনুলিপি দর্শকদের বিমোহিত করে। বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গে সেই সময়ের প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক বাংলা-ইংরেজী সংবাদপত্রের পাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমগ্র পাতায় প্রকাশিত হয়েছে দেশব্যাপি জনসংযোগের ও সাধারণ মানুষের মাটির কাছাকাছি থাকার কথা। সাংগঠনিক পরিচালনার ভূমিকা তিনি অনবদ্য একজন মহাপুরুষ, যেখানে দৈনিক আজাদের সংবাদে বলেছেন, চোরাচালানীদেরকে মৃত্যুদণ্ডদানের আইন প্রণয়ন।
৫ জুলাই ১৯৭২ সালের দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতা ছাপা হয়েছেঃ ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি করুন আর না করুন, তাহতে কিছুই যায় আসে না।
‘জাতীয় জীবনে কোন বিশৃংখলা বরদাসত করা হবে না’ প্রকাশিত তারিখ ১২ জানুয়ারি ১৯৭৫।
‘লাকসামের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আউয়ালকে বঙ্গবন্ধুর চিঠি’।
এমনি বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যেতে যেতে, পথে পথে বিপত্তির সম্ভাবনাকে অস্বীকৃতি জানিয়ে বীর বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিরন্তন আকাক্সক্ষার সোনার বাংলা গড়ে তুলে সমৃদ্ধ সুন্দর জীবনের পথে এগিয়ে যেতে প্রেরণা জোগাবে।
কুমিল্লা টাউন হল মাঠের ‘মুক্তি উৎসব ও সুবর্ণ জয়ন্তী’ মেলার অংশীদার কুমিল্লার কাগজ সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আবুল কাশেম হৃদয়ের অমূল্য সংগ্রহ ও জেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা কুমিল্লাবাসী দর্শকবৃন্দের সবার জন্যে অত্যন্ত স্মৃতিকাতরতার সাথে নব প্রত্যয়ে উদ্ভাসিত হবে। জয় বাংলা।