সড়কে
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চালকের লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। অথচ সেই
লাইসেন্স–সংক্রান্ত কার্যক্রম তিন বছর ধরে অচল হয়ে আছে। এর মধ্য দিয়ে নিজের
ব্যর্থতাই প্রকাশ করল দেশের যানবাহন চালকের লাইসেন্সের একমাত্র অভিভাবক
সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ডিজিটাল সেবা দেওয়ার জন্য
সরকারি সংস্থাগুলোর নিজস্ব কোনো ব্যবস্থাপনা না থাকা এবং ঠিকাদারদের ওপর
নির্ভরতায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের পর আরেকটি বড় উদাহরণ হচ্ছে বিআরটিএ।
ঠিকাদারদের
স্বেচ্ছাচারিতা ও বিআরটিএর অদক্ষতার কারণে প্রায় ৪৪ লাখ লাইসেন্স আটকে
আছে। চালক সঠিক নাকি ভুয়া লাইসেন্সে গাড়ি চালাচ্ছেন, সেটি যাচাই করাও সম্ভব
হচ্ছে না। ফলে সড়ক নিরাপত্তা যেমন হুমকির মুখে পড়েছে, তেমনি লাইসেন্স পেতে
বা নবায়ন করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে গ্রাহককে।
আমরা
দেখছি, যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্স কম থাকায় প্রায় ২০ লাখ যানবাহন
চালাচ্ছেন ‘ভুতুড়ে’ চালকেরা। এখন লাইসেন্স নিয়ে এত ভোগান্তি ও জটিলতার
কারণে স্বাভাবিকভাবে অনেক চালক বিআরটিএর কার্যালয়মুখো হতে চাইবেন না। যার
কারণে লাইসেন্স ছাড়াই বা সেটি নবায়ন না করেই অনেক চালক গাড়ি চালাবেন, এটি
বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে পুলিশের চাঁদাবাজিরও বড় উৎস হয়েছে সেসব
গাড়ি। এমন পরিস্থিতিতেই কিছুদিন আগে কক্সবাজারের চকরিয়ায় এক পিকআপের চাপায়
লাশ হতে হলো একই মায়ের ছয় সন্তানকে। লাইসেন্স ছাড়াই চালক সেই পিকআপটি
রাস্তায় চালচ্ছিলেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২০ বছরে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার
পেছনে চালকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এখন বিআরটিএর লাইসেন্স জটিলতার কারণে
দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে
না।
বিআরটিএর লাইসেন্স সরবরাহ, নতুন আবেদনকারীর ব্যক্তিগত তথ্য, আঙুলের
ছাপ, ছবিসহ তথ্যভান্ডার তৈরি, পুরোনো লাইসেন্সগুলো তথ্যভান্ডারে যুক্ত করা
এবং অনলাইনে সংরক্ষণ করার কাজটি পুরোটাই ঠিকাদারিনির্ভর। ২০১১ সাল থেকে
টাইগার আইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই কাজ দেখে আসছিল। তবে চুক্তি জটিলতায়
২০১৯ সাল থেকে তারা নতুন লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে
মাদ্রাজ প্রিন্টার্স নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান এ কাজটি পেলে তাদেরও পুরো
তথ্যভান্ডার বুঝিয়ে দেয়নি। অভিযোগ উঠেছে, টাইগার আইটি লাইসেন্স দেওয়ার কাজ
স্থায়ীভাবে নিজের আয়ত্তে রাখতেই এমনটি করেছে। অন্যদিকে নতুন ঠিকাদারি
প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সড়ক নিরাপত্তার
সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্যভান্ডার সংরক্ষণ ও কার্যক্রম কেন
ঠিকাদারকে দিয়ে চালানো হবে? এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত।
বিআরটিএর মতো প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা না থাকা শুধু দুঃখজনকই না,
উদ্বেগজনকও।
সংস্থাটির চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ বলছেন, বিষয়টি কারিগরি
সমস্যা। দ্রুত সমাধান আশা করছেন তাঁরা। সড়ক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো.
নজরুল ইসলামও বলছেন, সমাধানের পথেই হাঁটছেন তাঁরা। তবে তাঁরা স্থায়ী ও
কার্যকরী সমাধানের পথে হাঁটছেন বলে মনে হয় না। আমরা চাই না সরকারের
গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটি ঠিকাদারের কাছে জিম্মি হয়ে থাকুক। দ্রুত নিজস্ব
ব্যবস্থাপনায় চালকের লাইসেন্স দেওয়া ও নবায়নের কার্যক্রমটি চালানো মতো
সক্ষমতা অর্জন করুক। ডিজিটাল বাংলাদেশে নাগরিক সেবার এমন হাল কোনোভাবে
কাম্য হতে পারে না।