শাহীন শাহ্ ।।
আমাদের অভাবের
জায়গাটা অনুভূতি নির্ভর। সৃষ্টি জগতে যত সৃষ্টি তা অভাবকে পূরণ করার
লক্ষ্যে। ধরি আমাদের দেশটিএকটা শরীর। তার শৈশব আছে, কৈশোর আছে এবং যৌবনের
যাপিত জীবনের ও পরিক্রমা আছে। অভাবকে কেন্দ্র করেই কষ্টের জায়গাটা তৈরী হয়।
আমাদের দেশ নামক শরীরটার বয়স এখন ৫০। যার দশ বছর কেটেছে শৈশব,পরের দশ বছর
কেটেছেকিশোর আলোয়, কিশোর আলোয় কেটেছে যুবকসময়। শরীরটাকে যদি প্রশ্ন করি, সে
জবাব দেবে সময় খেয়েছি সুখ খুঁজে খুঁজে, অধিকার খুঁজে খুঁজে। দু’চোখ মেলে
দেখতে পাচ্ছি ব্যর্থজীবনের প্রতিচ্ছবি। আমাদের অভাবের ধরণ হরেক রকমের। কোটি
কোটি মানুষের জীবন কাটে যাতনা-বিরহে ও দুঃখ-দুর্দশায়। তাদের অভাববোধের
জায়গাটা ব্যাপক ও খানা-খন্দেভরা। আশা-নিরাশার দোলাচালে কেমন করে যেন তারা
নিয়তির কাছে ভাগ্যকে সমর্পণ করে দেয়। আঁড়ালে-আবডালে চোখের কোণে জমিয়ে রাখে
যতসব যাতনা ও বেদনাবোধ। দুঃখকে মেনে নেওয়াই তাদের সহজাত প্রবৃত্তি । শত
দুর্যোগ-দুর্বিপাকে টিকে থাকার এবং লড়াইকরার মানসিক প্রেরণাপূর্ব পুুরুষদের
হাত থেকে এরা পেয়েছে। কৈফিয়ত-নালিশ ও অভিযোগ করার মতো জায়গাটা অধরাই থেকে
যাচ্ছে। হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে কিংবা তর্জমা করলে একটি সত্য বেরিয়ে আসে
যে, এদেশের মানুষের স্বভাব হচ্ছে এক শ্রেণির কালো পিপঁড়ের মতো। আমরা যেমন
লাভে লোভে ও স্বার্থে একা-একা সঙ্গহীন চিন্তায়-চৈতন্যে, কর্মে ও প্রয়াসে
যাপিত জীবন অতিবাহিত করি। ঠিক কালো পিপঁড়েরার ও জীবনচক্র এমনই। এদের
একা-একা নিঃসঙ্গ জীবন ধারে ও বাঁকে চলে। লাল পিপঁড়ের মতো আমাদের সংঘবদ্ধ
প্রয়াস নেই। সঙ্গশক্তি নেই, সংহতি প্রকাশের জায়গাটাও প্রশ্নবিদ্ধ। দলবদ্ধ
সহযোগিতা-সহায়তা,লেনদেন ও সমবেত প্রয়াস যা ব্যাক্তির ও সমষ্টির কল্যাণ
সুদৃঢ় হবে তা আমাদের সামাজিক আচরণে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। চিন্তায়,
স্বকীয়তায়, মনে, মননে মনীষায় অনুভবের জায়াগাটায় সম্পূর্নরূপে ভিন্ন।
সামাজিক ক্ষেত্রটিও চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যাক্তি স্বার্থের প্রাধান্যের
কারণে আমরা আমাদের মত পাল্টাই, ভোল পাল্টাই, উদ্দেশ্যের রং বদলায়, ঢংবদলায়,
সংকোচবোধ নেই, শরম নেই, লজ্জায় নিন্দায় সবশেষে ধিক্কারেও এদের কিছু যায়
আসে না। অনুগত হই, বাধিত হই, কৃতজ্ঞ হই দাসত্বের বন্ধনে। ব্যাক্তির ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র চেষ্টায় ও প্রয়াসে কেবল শোষণ-প্রবঞ্চনা, কাড়া-মারা-হানা
রীতি-রেওয়াজ ও পদ্ধতির উদ্ভব ঘটায়। সামগ্রিক উন্নয়নের চিন্তা করাও বরং
দূরুহ বটে। শত অভাব, দুর্যোগ-দুর্ভোগ থেকে আমাদের মুক্তি আবশ্যিক ও
জরুরি। যদিও মুক্তির পথ মসৃণ নয়, এটি শাপদসংকূলে ঠাসা। তা সত্ত্বেও মনের
মুক্তির পথ বের করতে হবে মানবদেরকেই। যেমন এটম বোমা আবিষ্কারের পেছনে
আইনষ্টাইনের প্রেরণা কার্যকর ছিল। কিন্তুু ওই আবিষ্কার ধ্বংসের কাজে
ব্যবহার হয়েছিল। কারণ ব্যবহারের সিদ্ধান্তটি বিজ্ঞানীরা নেন নি, যুদ্ধরত
রাজনীতিবিদেরাই নিয়েছেন। সেই সময়কার প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর মানুষেরা মহামতি
লেনিনকেই চাইবে, হিটলারকে না বলে দিবে। কোন আধ্যাত্মিক কারণে নয়, বরং
জীবনের প্রয়োজনে,বেঁচে থাকবার প্রত্যাশায়,শান্তি সুশৃঙ্খল,সংগবদ্ধ জীবনইতো
মানুষ আশা করে। ব্যাক্তিগত জীবন, সামাজিক জীবনে যখন এইরূপ সংঘবদ্ধ জীবন যখন
মানুষ পায় না, তখনই শুদ্ধ কিংবা পরিশুদ্ধ জীবনাচারে ঘটে বিপত্তি। স্বপ্নই
মৃত্যুর পথে হাটে। পরিসমাপ্তি কেবল হাটেনা সমাপ্তির মসৃণ পথে। মানবের
আশাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে জীবন পথের বাঁকে ও মোহনায়। শত প্রতিকূলতা
থাকা সত্ত্বেও সঞ্চয়ের আশায় কিছু কিছু মানুষ তাদের গচ্ছিত টাকা ব্যাংকে জমা
রাখে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি প্রধান শর্ত হলো এই সঞ্চয়কে উৎপাদনের কাজে
বিনিয়োগ করা। কিন্তুু আমাদের এই দরিদ্র রাষ্ট্রে ঘটেছে বিপরীত কর্মকাণ্ড।
ব্যাংকের গচ্ছিত অর্থ চলে যাচ্ছে ঋণ খেলাপীদের হাতে। তারা বিনিয়োগ না করে
বিলাসী জীবন ভোগের মানসে অপচয় করছে, এমনকি বিদেশেও দিচ্ছে পাঠিয়ে। কানাডার
বেগম পাড়া ও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম হচ্ছে পাচারকৃত টাকায়। এ যেন গোপনে
গোপনে মহা উৎসব চলছে টাকা পাচারের কারবারে। ৩০ লক্ষ শহীদের বুকের
তাজারক্তের বিনিময়ে যে লাল সবুজের পতাকা সম্বলিত যে পবিত্র রাষ্ট্রটি পেলাম
এই পূণ্যভূমিটির প্রতি ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের কোন বিশ্বাসই নেই।
বিশ্বাস জন্মেছে যে, এদেশের মানুষের কোনো ভবিষৎ নেই। উন্নত জীবনের আশায়
দরিদ্র পিড়ীত মানুষের টাকা লুট করে বিদেশের ব্যাংকে জমাকরে টাকার পাহাড়
করা। ফলে পুঁজিবাদের খপ্পরে বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মতো এক
বিপুল জনগোষ্ঠি। ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। আমাদের
জাতিগতভাবে লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অতি সমৃদ্ধশালী হলেও এদেশের
বেশিরভাগ মানুষ সুন্দরভাবে তাদের সুদীর্ঘ জীবনটিকে ভোগের মাহিমায় স্বার্থক
সাবলীল মানুষ হিসেবে ভাবতে জানেনা। জীবনের স্বরূপ উৎঘাটন করে জীবনকে
উপলব্ধির ওউৎসাহের নোঙরে ভাসাতে জানেনা। এদেশের মানুষের ভেতরের সবচেয়ে বড়
মূলধন হচ্ছে যে, শত দুর্ঘটনা-দুর্বিপাকে এরা দাঁত বের করে খিল খিল করে
হাসতে জানে। পরান জুরে গাইতে জানে, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”।
দুঃখে-দহনে এবং সিক্তে তাদের যাপিত জীবন। নিয়ন্ত্রনহীন দ্রব্যমূল্যের
উর্দ্ধগতিতে মিতব্যয় শব্দটি ও যাদুঘরের পথে হাটছে।না হয় চির নির্বাসনে চলে
যাবে। মিতব্যয়ী হওয়ার আদর্শ ভাবনাটুকু মুছে যাবে, বাঙালির যাপিত জীবনের
ডায়েরি থেকে। ৬০ টাকা কেজি দরের সয়াবিন তৈল ২০০ টাকা, আটা-ময়দা, মোরগীর
মাংসের বাজারে উর্দ্ধগতির যে অস্থিরতা, সেখানে যাপিত জীবন জিম্মি হয়ে
যাচ্ছে। ক্রয় ক্ষমতা আশ্চার্যরকমভাবে থমকে আছে। মানুষের মৌল ও মানবাধিকার
যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, ঠিক তেমনি মৌলিক চাহিদাগুলো ভোগ করার যেন অধিকার
হারিয়েছে। চরম অস্থিরতাই এখন মানুষের নিয়তি। দুর্ভাবনায়-দুর্বিপাকে চলছে
মানুষের জীবন। অভাবক্লিষ্ট জীবন সে যায়ই হোক স্বস্থির কোনো খবর নয় বরং টিকে
থাকাটাই স্বস্থির খবর। প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত:আমাদের চারপাশে কোনো না কোনো
অঘটনের ঘটনা ঘটছে। সামাজিক অনাচার, অনিয়ম, অবৈধভাবে দখল, লুন্ঠন এর মতো
জঘন্যতম ঘটনা ঘটছে, তা অভাবকে কেন্দ্র করে। অভাব, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা
মানুষের চর্চার মধ্যে নেই বললেই চলে। এইসব দেখে দেখে মানুষ অভ্যস্থ হয়ে
উঠেছে।নিপীড়িত ও নিরণ্ন মানুষের ঘরে,অনিয়ম স্থায়ীভাবে আসন পেতে বসেছে । যার
ফলে কোন দুঃখই মানুষকে পীড়া কিংবা যাতনা দিতে পারেনা। বরং দুঃখকে মেনে
নেওয়াই এদেশের মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই কবির কথায়,‘দুঃখ করো না
বাঁচো’। আমাদের চিরায়ত সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম সমস্যা হচ্ছে যে, কোন
অপরাধ কিংবা দুর্ঘটনা ঘটলে দেখি এবং দুঃখ অনুভব করি। কিন্তুু তার কারন
দেখিনা। তা প্রতিকারের পথ খুঁজি না । এসব কারণে আমাদের সমাজ আজ সৃষ্টিশীল
সমাজ নয়। ভাবনায় থাকে ভোগেই যতসব সুখ। এরকম একটি উদাহরণ আমার শৈশবে আছে,যা
স্মৃতির ঝাপিতে জমা আছে দারুণভাবে। ঘটনাটি এমন- আমাদের গ্রামে আমাদের একটি
যৌথ দিঘি আছে। এই দিঘির জলে আমার ছোটবেলা কেটেছে নানাভাবে। কখনো সাতরানো
কখনো খেলাধূলা ও হৈ-হোল্লর করে অন্যান্য শিশু-কিশোরদের সাথে-সময় কেটেছে
আনন্দঘন পরিবেশে। একদিন গ্রামের জেলে পল্লির জেলেরা দিঘিটিতে মাছ ধরার জন্য
দিঘিতে জাল ফেলেছে, আমরা সবাই দিঘির পাড়ে বসে বের জালের মাঝখানে বড় মাছের
লাফালাফি দেখছিলাম আর আনন্দে চিৎকার করছিলাম। এইটা এই মাছ লাফদিয়েছে, ঐটা
ওই মাছ লাফ দিয়েছে বলে। মাছ লাফদিয়ে কখনো জেলের শরীরে পড়লে সেই জেলে বেহুশ
হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি কতবার-কতসময়। জাল টেনে যখন জেলেরা দিঘির ধারে নিয়ে
আসলেন, জালের ভেতর একটা বিরাট বোয়াল মাছ ধরা পড়েছে দেখে, আমরা সবাই আনন্দে
আত্মহারা। বলা দরকার আমাদের দিঘিটির মালিক ২০টি পরিবার কিন্তুুএকটা বোয়াল
মাছ সবাই নিতে চায়। এত বড় বোয়াল মাছটির দিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে রইলাম এবং
বোয়াল মাছটি আমি নেব বলে চিৎকার করতে থাকলাম। এরই মধ্যে শার্ট প্যান্ট পড়া
মোটা সোটা এক গোঁফ ওয়ালা ভদ্রলোক আসলেন মাছটি কিনতে। তিনি মুরুব্বীদেরকে
বললেন আপনারা অনেক পরিবার। মাছিটি ভাগ করেলে ২০ ভাগ করতে হবে। ফলে আপনারা
কেহই যথেষ্ট পরিমান পাবেন না। তার চেয়ে ভালো আপনারা অন্যমাছ নিয়ে যান, আমি
এই মাছটি কিনে নেই, যেই কথা সেই কাজ, মাছটি বিক্রি হয়ে গেল। তাৎক্ষনিক আমরা
সবাই নীরব হয়ে গেলাম। সেই শার্ট প্যান্ট পড়া ভদ্রলোকটি মাছটি নিয়ে গেল যেন
শবযাত্রী। সেই থেকে আজকে পর্যন্ত যখনই দিঘির পাড়ে আসি সেই দৃশ্যটি আমাকে
বোবা করে দেয়। পারিবারিক সামাজিক শিক্ষা থেকে আমরা অভাকে আমাদের স্বাভাবীক
চেতনায় মিশিয়ে ফেলেছি। আমাদের অনুভবের জায়গাটা এমনই বিশ্বস্ত ও নিরাপদ
হয়েছে যে, আমাদের অভাব আছে কিন্তুু কষ্ট নাই। সবশেষে ১৯৭১ সালে এই
বাংলাদেশের মানুষ রুখে দাড়িয়েছে কিন্তু সময় যেতে যেতে ৫০ বছর গেল আমরা এখনো
যে উঠে দাঁড়াতে পেরেছি তা হলফ করে বলা যাবে না। হ্যাঁ পেরেছিল সেই আধুনিক
চিন দেশ, জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। বেজিং শহরের তিয়েন শেন স্কোয়ারের
বিশাল সমাবেশে মাও সে তুঙ ঘোষণা করেছিলেন“চীনা জাতি উঠে দাঁড়িয়েছে”।
শাহীন শাহ্
অধ্যাপক কলাম লেখক ও প্রাবন্ধীক
০১৭২০-১৮৩০৩৯