কাগজে-কলমে অন্ততপক্ষে বলা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে একটি ছিল শ্রীলঙ্কা। জাতিসংঘের তালিকা অনুযায়ী, উন্নয়নের দিক থেকে পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশেরই সমকক্ষ ছিল এই দ্বীপরাষ্ট্র। কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানেই দেশটির পুরো চিত্র একেবারেই পাল্টে গেছে।
দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশটিতে খাদ্য সংকট সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। একই সঙ্গে জ্বালানি, ওষুধসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে। কখনও কখনও দিনে ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে।
গত দুই মাসে ডলারের বিপরীতে দেশটির মুদ্রা প্রায় অর্ধেক মূল্য হারিয়েছে। বৈদেশিক রিজার্ভ ৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে, ২০১৯ সালে ছিল ৯০০ কোটি ডলার। গত মাসে শ্রীলঙ্কা স্বীকার করেছে যে, তারা আর বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে।
এমন অবস্থায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না পেয়ে তাদের মনে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। আর এই ক্ষোভ এখন তীব্র বিক্ষোভ আর সংঘাতে রূপ নিয়েছে। যার ফলে ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। এমনকি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং তার মন্ত্রিসভাও নড়বড়ে হয়ে গেছে।
গত কয়েকদিন ধরে বিক্ষাভ আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে আগুন লাগানো হয়েছে অর্ধশতাধিক নেতার বাড়িগাড়িতে। একরাতেই বিক্ষোভের আগুনে পুড়েছে শ্রীলঙ্কার অন্তত ৩৩ সংসদ সদস্যের বাসভবন। গত সোমবার (৯ মে) রাতে শাসক দলীয় নেতাদের অন্তত ৩৩টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। নেতাদের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে অভিযোগে বেশ কিছু বেসরকারি সম্পত্তিতেও হামলা চালানো হয়েছে। দ্বীপরাষ্ট্রটিতে বেছে বেছে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বাড়ি-গাড়িতে হামলা চালাচ্ছে ক্রুদ্ধ জনতা।
সদ্য পদত্যাগকারী লঙ্কান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের মেদামুলনায় অবস্থিত পৈতৃক বাড়ি এবং কুরুনেগালায় অবস্থিত বাসভবনেও আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা। রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি হামলার শিকার হচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারাও। এরই মধ্যে লঙ্কান পুলিশের সিনিয়র ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (এসডিআইজি) দেশবন্ধু টেন্নাকুনকে মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
এদিকে চলতি সপ্তাহেই নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে যাচ্ছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে। এসময় তিনি নতুন প্রধানমন্ত্রীও নিয়োগ দেবেন। চলমান সহিংস আন্দোলনের জের ধরে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দেশটির মন্ত্রিসভা ভেঙে পড়ে।
শ্রীলঙ্কাকে এই দিন কেনো দেখতে হলো? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে ২০১৯ সালের শেষের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। সে সময় ইস্টার সানডেতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পরেও ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় দেশটি। তিনটি গির্জা এবং তিনটি বিলাসবহুল হোটেলে হামলা চালানো হয়। এতে আড়াই শতাধিক মানুষ নিহত হয়। ওই হামলার কারণে পর্যটন খাত কিছুটা গতি হারায়। দেশটির অন্যতম আয়ের উৎসই এই পর্যটন খাত। হামলার আগের মাসেও যেখানে ২ লাখ ৪৪ হাজার পর্যটক দেশটিতে ভ্রমণ করেছে সেখানে ওই হামলার পর এই সংখ্যা ৩৮ হাজারে এসে দাঁড়ায়।
এরপর আবার করোনা মহামারির কারণে পর্যটন খাতে আরও বড় ধাক্কা আসে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার কারণে দুই বছর ধরে দেশটিতে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।
সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালে। সে সময় স্টার সানডের হামলাকে কেন্দ্র করে শ্রীলঙ্কানরা এমন একজন ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন যিনি নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কঠোর হাতে দমন করবেন বলে ধারণা করা হয়েছিল।
গোতাবায়া রাজপাকসে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এর এক বছর আগেই তিনি এক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে সক্ষম হন। ফলে দেশে তার বেশ জনপ্রিয়তা ছিল।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর গোতাবায়া তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। মাহিন্দা রাজাপাকসে এর আগে ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন।
শুধু বড় ভাইকেই নয় রাজপাকসে পরিবারের অনেককেই সরকারের বিভিন্ন পদে বসান গোতাবায়া।
কিন্তু সরকারের বিভিন্ন পদে থেকে রাজাপাকসেরা বেশ কিছু ভুল পদক্ষেপ নিয়েছেন। দেশটিতে মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করা হয় এবং অন্যান্য শুল্ক বাতিল করা হয়।
মহামারির কারণে একদিকে পর্যটন খাতে ধস নামে অন্যদিকে সরকারি রাজস্ব কমে যায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহও মারাত্মকভাবে হ্রাস প্রায়। তার ওপরে ঋণের বোধা শ্রীলঙ্কাকে আরও জর্জরিত করে ফেলে। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতির ধস ঠেকানো সম্ভব হয়নি। এখন নতুন করে বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
দেশজুড়ে জনমনে রাজাপাকসে পরিবার নিয়ে যে ক্ষোভের জন্ম হয়েছে তা থামাতে এখন মাহিন্দার পর গোতাবায়ে রাজাপাকসেকেও ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই তার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ চলছে।
আর এই মুহূর্তে বিরোধীদেরও উচিত জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখা এবং শ্রীলঙ্কাকে এর দুর্দশা থেকে বের করে আনার কিছু দায়িত্বও তাদের নেওয়া উচিত। এই মুহূর্তে সবকিছুতেই কালো ছায়া নেমে এসেছে বলে মনে হতে পারে, তবে ভোটাররা সেই রাজনীতিবিদদেরই পুরস্কৃত করবেন যারা বর্তমান অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পাবেন। আপাতদৃষ্টিতে বলা যায় দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েই রাজাপাকসেরা প্রথমে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু নিজের হাতেই তারা সেই জনপ্রিয়তা নষ্ট করেছেন। এবার দেশের অন্যান্য রাজনীতিবিদদেরও এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য জনগণকে সহায়তা করতে হবে, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। নিজেদের দেশ রক্ষার জন্যই তাদের এখন সব স্বার্থ ত্যাগ করে এগিয়ে আসতে হবে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, ডেইলি মিরর