ড. কবিরুল বাশার ||
স্বাস্থ্য
অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য মতে,
১৬ জুন ২০২২ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগী ৬৬১
জন, ২০২১ সালে এই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২৩৫ এবং ২০২০ সালে ছিল ৩১৬ জন। গত তিন
বছরের আক্রান্ত সংখ্যা তুলনা করলে দেখা যায় ২০২১ সালের তুলনায় এ বছর প্রায়
তিন গুণ এবং ২০২০ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ রোগী বেড়েছে; যদিও রোগীর
প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
এ তো গেল বাংলাদেশের হিসাব। আমরা
যদি জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে তাকাই তাহলে
দেখা যায়, ডেঙ্গু এ বছর বড় আঘাত হানতে চলেছে পৃথিবীতে।
বর্তমানে ডেঙ্গু
আক্রান্তের শীর্ষে অবস্থান করছে ব্রাজিল, যে দেশে ১১ লাখের বেশি মানুষ
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশের ভিয়েতনাম,
ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কায়
উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে। এই
সংখ্যা আরো বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
পৃথিবীব্যাপী ডেঙ্গুর আঘাত এবং
বাংলাদেশে এর প্রাদুর্ভাবের সূচনা ইঙ্গিত দেয় বাংলাদেশে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর
মাসে ডেঙ্গু ভয়াবহ হতে চলেছে। গত বছরের তুলনায় আমরা এ বছর এডিস মশার ঘনত্ব
ঢাকায় বেশি পেয়েছি এবং এর আগেই আমরা ঘোষণা দিয়েছি, ডেঙ্গু এ বছর বেশি হতে
পারে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, এডিস মশার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া এবং ডেঙ্গু
ভাইরাস সেরোটাইপ-৩ সংক্রমণের কারণেই পৃথিবীজুড়ে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা
বাড়ছে। মানুষের অবহেলা, উপযুক্ত পরিবেশ, মশার সহনশীলতা এবং প্রজননক্ষমতা,
ডেঙ্গু সেরোটাইপ-৩ বেড়ে যাওয়া—এসব মিলিয়ে পৃথিবীতে ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়ে
যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯৮টি
ওয়ার্ডের ১১০টি স্থানে প্রাক-মৌসুম এডিস মশার ঘনত্বের জরিপ করেছে স্বাস্থ্য
অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। প্রতিবছর তিনবার (প্রাক-মৌসুম, মৌসুম ও
মৌসুম-পরবর্তী) এডিস মশার ঘনত্বের জরিপ করা হয়ে থাকে। এডিস মশার ঘনত্বের
মাত্রা থেকে অনুমান করা যায় এডিস মশাবাহিত রোগ, বিশেষ করে ডেঙ্গু ও
চিকুনগুনিয়া কেমন হতে পারে। ২০২২ সালের প্রাক-মৌসুম জরিপে ঢাকা শহরের ৪.৫৩
শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার ঘনত্ব পাওয়া গেছে। এ বছর প্রাক-মৌসুম এডিস মশার
ঘনত্ব গত বছরের প্রাক-মৌসুম এডিস মশার ঘনত্বের তুলনায় বেশি। এ বছর এডিস
মশার ঘনত্ব বলে দেয় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
এরই মধ্যে
আমরা জেনেছি, কোনো পাত্রে সাত দিন পানি জমে থাকলেই সেখানে এডিস মশা
জন্মানোর আশঙ্কা থাকে। গত কয়েক বছরে গবেষণায় আমরা দেখেছি, ঢাকা শহরে
নির্মাণাধীন ভবনের বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি, লিফটের গর্ত, টাইলস
ভেজানোর চৌবাচ্চা, ড্রাম, বালতি, ওয়াসার মিটার রাখার জায়গা ইত্যাদি স্থানে
এডিস মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া দইয়ের পাত্র, পানির জার, ভাঙা কমোড,
বেসিনসহ যেকোনো ছোট-বড় পাত্র যেখানে দুই সেন্টিমিটার পানি জমা হতে পারে
সেখানেই এডিস মশার প্রজনন হতে পারে।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি স্ট্রেইন
(ডেন-১, ২, ৩ ও ডেন-৪)-এর যেকোনোটি দিয়ে ডেঙ্গু হতে পারে। আর এই ভাইরাস বহন
করে এডিস প্রজাতির মশা। এডিস মশার দুটি প্রজাতি ঢাকা শহরে দেখা যায়। তার
মধ্যে একটি হলো এডিস ইজিপ্টি, আরেকটি হলো এডিস অ্যালবোপিকটাস। এডিস
ইজিপ্টিকে নগরের মশা বা গৃহপালিত মশা বলা হয়ে থাকে। এ মশাটি নগরীর বাড়ি এবং
আশপাশে বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানিতে জন্মায়। ইজিপ্টি মশা ডেঙ্গুর
প্রধান বাহক। আমাদের দেশে ৯৫ শতাংশ ডেঙ্গু ছড়ায় ইজিপ্টি প্রজাতির এডিস মশা।
ডেঙ্গুর সেকেন্ডারি বা এপিডেমিক বাহক হচ্ছে এডিস অ্যালবোপিকটাস।
অ্যালবোপিকটাস মশা বিভিন্ন পাত্র ছাড়াও গাছগাছালিযুক্ত এলাকায় গাছের কোটর,
কলাগাছের দুই পাতার মাঝখানে, কচুপাতার মাঝখানে, কাটা বাঁশের গোড়ায় জমে থাকা
পানিতে জন্মায়।
বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার
ঘনত্ব আরো বাড়বে। তাই এখনই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ জোরদার করে ডেঙ্গু
মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন হলে ডেঙ্গু
নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পরামর্শক দল তৈরি করে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ
ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
অ্যাডহক ভিত্তিতে কাজ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা
সম্ভব নয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। ডেঙ্গু
নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে পাঁচ থেকে ১০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা ও তার
বাস্তবায়ন। আর এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সারা বছর
ধরে চলমান থাকতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মহাপরিকল্পনায় সমন্বিত মশক
ব্যবস্থাপনা বা ইন্টিগ্রেটেড মসকুইটো ম্যানেজমেন্ট বাস্তবায়ন করতে হবে।
সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার চারটি মূল পিলারকে একসঙ্গে সারা বছর বাস্তবায়ন
করতে পারলেই এডিস মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা নিয়ন্ত্রণ
করা সম্ভব।
প্রকৃতপক্ষে জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া সিটি করপোরেশন বা
পৌরসভার একার পক্ষে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়া দুষ্কর। তাই এ প্রক্রিয়ায়
জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে
সামাজিক সংগঠনগুলোকে উদ্বুদ্ধ করে এ কাজ করানো যেতে পারে।
স্থানীয়
সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, সিটি করপোরেশন এবং নগরবাসীর সম্মিলিত
কার্যক্রমের মাধ্যমে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ এবং ডেঙ্গু থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
চলুন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে এখনই জোর কার্যক্রম শুরু করি।
লেখক : কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক ও অধ্যাপক প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়