জুলফিকার নিউটন ||
পূর্বে প্রকাশের পর
মহব্বত বা প্রেমের তিনটি সংজ্ঞা সুফী তত্ত্বজ্ঞরা নির্দেশ করেছেন। প্রথমত প্রেম হচ্ছে প্রেমাষ্পদের জন্য এক প্রকার অস্থির আকাঙ্ক্ষা, একটি আবেগ এবং আকর্ষণ। এ অর্থে প্রেম হচ্ছে সৃষ্ট জীবসমূহের পরস্পরের প্রতি আনুকূল্য এবং মমতা। দ্বিতীয়ত, প্রেম হচ্ছে মানুষের উপর বর্ষিত আল্লাহর করুণা। যাকে আল্লাহ নির্বাচন করেন তাকে তিনি মমতা করেন এবং তাকে বৈশিষ্ট্য দান করেন। আল্লাহর বিবিধ ঐশ্বর্যে তিনি বিভূষিত হন। তৃতীয়ত, প্রেম হচ্ছে কোনো কল্যাণ কর্মের জন্য প্রশংসা। মানুষ যখন কোনো কল্যাণ কর্ম সাধন করে তখন আল্লাহর তরফ থেকে তার উপর আল্লাহর প্রশংসা বাণী উচ্চারিত হয়। কোনো কোনো দার্শনিক বলেন যে আল্লাহর ভালোবাসা আল্লাহর গুণাবলীর সঙ্গে যুক্ত। আল্লাহর যে সমস্ত গুণাবলী কোরান শরীফে বর্ণিত হয়েছে যার অজস্রতা ভাষায় উল্লেখ করা যায় না সে সমস্ত অজস্রতা থেকেই আল্লাহর ভালোবাসার স্বরূপ প্রকাশ পায়। মানুষের প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা মানুষের প্রতি তার সুখ কামনার মতো এবং করুণার মতো। আল্লাহর বিভিন্ন ইচ্ছার মধ্যে প্রেম হচ্ছে একটি ইচ্ছা যাকে আরবীতে বলে ইবাদাত। আল্লাহর ইচ্ছার ব্যাখ্যাসূত্রে আরো অনেক শব্দ আমরা ব্যবহার করি, যেমন, ‘সন্তুষ্টি', ক্রোধ, করুণা' ইত্যাদি। আল্লাহর ইচ্ছা হচ্ছে একটি অনন্তকালীন প্রজ্ঞা, যার সাহায্যে তিনি তার কর্মপ্রবাহ চালিত করেন। মানুষের প্রতি আল্লাহর ভালোবাসার ফলে এ পৃথিবীতে মানুষের সন্তুষ্টি বিধান ঘটে এবং পরজগতে মানুষ শাস্তি থেকে মুক্ত হয়। আল্লাহর ভালবাসা থাকলে মানুষ পাপ থেকে মুক্ত হয় এবং এ ভালোবাসার সাহায্যে সে সমস্ত কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন হয়। সুফী সাধক মাওলানা রুমি বলেছেন যে কোনো মানুষকে আল্লাহ যখন বিশেষত্ব দান করেন, তখন সে বিশেষত্ব দানের মধ্য দিয়ে তার প্রেম প্রকাশ পায়। আল্লাহর ভালোবাসা হচ্ছে আল্লাহর বাণীর সততা এবং সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠা। এ বাণীর প্রতি মানুষের যখন পূর্ণ আসক্তি দীপ্যমান হবে, তখনই মানুষ আল্লাহর ভালোবাসা পেয়েছে ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর ভালোবাসা পেলে মানুষ পবিত্র হয় পরিচ্ছন্ন হয় এবং আনন্দে দীপ্ত হয়। কিন্তু আল্লাহর প্রতি মানুষের ভালোবাসা কি করে প্রকাশ পায়? এ ভালোবাসার প্রকাশ ব্যাকুলতার মধ্যে, বিনয়ের মধ্যে, শ্রদ্ধার মধ্যে এবং সার্বক্ষণিক ধ্যাননিমগ্নতার মধ্যে। যে মানুষ আল্লাহকে ভালোবেসেছে সে পরমকে লাভ করেছে। সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো বস্তুর প্রতি তার আর আকর্ষণ নেই। সে সমস্ত পার্থিব আকাভক্ষা এবং কামনাকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর গুণাবলীর দ্বারা গুণান্বিত হবার জন্য ব্যাকুল হয়। পৃথিবীতে যে মানুষ মানুষকে ভালোবাসে সে ভালোবাসার শেষ তো প্রাপ্তিতে। কিন্তু আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার তো শেষ নেই। সেখানে অনবরত প্রত্যাশা হয়েছে। সুতরাং একজন সুফী-সাধক সর্বমুহূর্তে এ প্রার্থনা করেন, “হে আল্লাহ, আমাকে আরো দাও, আরো দাও। আমি অসম্পূর্ণতায় বিপর্যস্ত হচ্ছি। আমাকে তুমি প্রাণময়তায় সম্পূর্ণ কর। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসে সে আল্লাহর কায়ফিয়াত বা স্বভাবকে আয়ত্ত করতে চায় এবং মৃত্যু চিন্তায় অধীর হয় না। কিন্তু মৃত্যুকে একটি অনিবার্যতার মধ্যে আনন্দে গ্রহণ করে। এই মৃত্যু হচ্ছে পার্থিব আকাক্ষার মৃত্যু এবং পার্থিব ইচ্ছার মৃত্যু। মৃত্যুর কারণে মানুষ অনন্তের নিকটবর্তী হবার সাধনা করতে পারে। পার্থিব প্রেমে সমমনাদের মধ্যে আকর্ষণ প্রকাশিত হয়, যেখানে দৈহিক পরিতৃপ্তি রয়েছে, কিন্তু আল্লাহর প্রতি প্রেম হচ্ছে এমন একটি তাৎপর্যের উল্লাস যা আল্লাহর গুণাবলীর আসক্তির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। বিখ্যাত সুফী-সাধক সুমনূন আল মুহীব বলেছেন যে প্রেম হচ্ছে একটা ভিত্তি, যে ভিত্তি স্থাপিত করে মানুষ আল্লাহকে পাবার চেষ্টা করবে। মানুষের বিভিন্ন আশ্রয় আছে, অর্থাৎ বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন আশ্রয়ে মানুষের প্রকাশ ঘটে। সকল আশ্রয়ই হচ্ছে ধ্বংসের। একমাত্র প্রেমের আশ্রয়ই হচ্ছে প্রশান্তির। প্রেমকে সাফওয়াত' নামেও অভিহিত করা যায়। সাফওয়াতের অর্থ হচ্ছে ‘পবিত্রতা'। সুতরাং সাফওয়াতের অবস্থা যিনি পেলেন তিনি সুফী। মনসুর হাল্লাজকে যখন ফাঁসীকাষ্ঠে জড়ানো হয়েছিল সে মুহূর্তে তিনি বলেছিলেন, “হাসব আল ওয়াজিদ, ইফরাদ আল ওয়াহিদ” অর্থাৎ এটাই যথেষ্ট যে প্রেমিক একক সত্তার সঙ্গে মিলিত হবে অর্থাৎ প্রেমিকের আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। সে প্রেমাষ্পদের অস্তিত্বের মধ্যে বিলীন হবে। এভাবে প্রেমের বিচিত্র অভিব্যজ্ঞান সূফী তত্ত্বজ্ঞরা দিয়েছেন। আমার জীবনে আমি একজন অনন্যসাধারণ সুফী তত্ত্বজ্ঞের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। তাঁর জীবনধারার কথা স্মরণ করেই প্রেমের মহিমান্বিত রূপের কথা বললাম। তাকে আমি আমার শৈশব এবং কৈশোরে দেখেছি এবং আমার কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও তাকে ঘনিষ্ঠভাবে কাছে পেয়েছিলাম। তাঁর নাম সৈয়দ মাইনুদ্দিন আহমদ আল হাসানী। শুভ্র কান্তি, দীর্ঘ দেহী, গৌরাঙ্গ পুরুষ তিনি ছিলেন। শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখে সর্বদাই একপ্রকার সান্ত্বনার হাসি ফুটে থাকতো। তিনি পূর্ণভাবে সুফী সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আমাদের পরিবারে সুফী সাধনমার্গের অনুশীলন ছিল।
আমাদের পারিবারিক জীবনের সকল সংকটের মুহূর্তে তাকে আমি দেখেছি। সংসার করেছেন কিন্তু সংসারে তার কোনো আসক্তি ছিল না। বৈষ্ণব গানে আছে যে শ্রীরাধিকা স্নান করছেন, কিন্তু তার বেণী যেমন ছিল তেমন থাকছে, পানিতে ভিজছে না। অর্থাৎ সংসারের সকল উদ্যমের সঙ্গে জড়িত থেকে সংসারী হচ্ছেন না। সৈয়দ মাইনুদ্দিন আহমদ আল হাসানীকে এ উপমায় পরিচিত করতে আমার ভালো লাগছে। আল্লাহর প্রতি তার আকর্ষণ ছিল সম্পূর্ণ, যে আকর্ষণকে আমরা যথার্থ প্রেম বলে আখ্যায়িত করতে পারি। যদি আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রয়াস আমি কোনো মানুষের মধ্যে প্রত্যক্ষ করে থাকি তাহলে তিনি হচ্ছেন সৈয়দ মাইনুদ্দিন আহমদ আল হাসানী। আমরা তাঁকেই যথার্থ প্রেমিক বলি যখন প্রেমিক আপন গুণাবলী সম্পূর্ণ মুছে ফেলে প্রেমাস্পদের গুণে গুণান্বিত হয়।
সৈয়দ মাইনুদ্দিন আহমদ আল হাসানীকে ধ্যানরত অবস্থায় আমি দেখেছি। মনে হয়েছে তাঁর সমগ্র তনু বিগলিত হয়ে একটি অলৌকিক দীপ্তিতে ভাস্বর হয়েছে। আমার বিশ্বাস হয়েছে যে তিনি আল্লাহর সঙ্গে নির্বিরোধী তত্ত্ব নির্মাণ করেছিলেন। আল্লাহর রূপে প্রেমাস্পদ হচ্ছে একটি মৌল প্রজ্ঞা এবং একমাত্র অস্তিত্ব। যাকে আরবীতে বলা হয় বাকী’। প্রেমিক হচ্ছে ‘ফানি' অর্থাৎ নিঃশেষ। তাই প্রেমের সার্থকতা নির্ভর করে মৌল অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্যে এবং আপন ব্যক্তি স্বরূপের গুণাবলীর বিস্মরণের মধ্যে। কোনো প্রেমিক আপন গুণাবলীকে জাগ্রত রেখে প্রেমকে বিকশিত করতে পারে না। যেহেতু প্রেমাস্পদের সৌন্দর্য তার প্রয়োজন, তাই আপন সত্তার বিলোপ সাধন করে সে প্রেমাস্পদের সৌন্দর্য দ্বারা অভিসিঞ্চিত হয়। আবু ইয়াজীদ বিসতামী বলেছেন, প্রেমের ক্ষেত্রে প্রয়োজন আপন বৃহৎকে ক্ষুদ্র করা এবং প্রেমাস্পদের ক্ষুদ্রকে মহৎ করা। অর্থাৎ আমি নিজেকে মহৎ ভাববো না, আমার অস্তিত্বকে তাৎপর্যপূর্ণ ভাববো না, ভাববো যে আমি ক্ষুদ্র এবং নিঃস্ব এবং আমার সম্পূর্ণতা আসবে প্রেমাস্পদের কাছে আপনাকে সমর্পণ করলে। এ বিচারেই স্বকীয় কৃতিকে ক্ষুদ্র করে আমি প্রেমাস্পদের কৃতিকেই একমাত্র লক্ষ্যগোচর করবো।
ব্যাকুলতা প্রেমের একটি অভিব্যঞ্জনা। আমি যে মহৎ প্রজ্ঞাকে চাই তার কোনো পরিমিতি নেই। সুতরাং তাকে কেউ সম্পূর্ণ আয়ত্ত করতে পারে না কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত হিসাবে আয়ত্ত করবার কামনায় অধীর থাকে। এভাবে ব্যাকুলতা আমাদের সম্পদশালী করে, কেননা ব্যাকুলতার কারণে ক্রমান্বয়ে আমরা আপনাকে অধিক থেকে অধিকতর পরিশুদ্ধ করি, পরিমার্জিত করি, পরিতৃপ্ত করি এবং পরিজ্ঞাত করি। প্রেম হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশের মান্যতা এবং অমান্যতার প্রতিকূলতা।
আমার শিক্ষা জীবনে এহেন সুফি সাধকদের ব্যক্তির সান্নিধ্য আমাকে অনেকভাবে প্রভাবিত করেছে। আমি যে তাঁকে অনুসরণ করতে সক্ষম হয়েছি তা নয়। তবে পবিত্রতা এবং পরিচ্ছন্নতাকে চাক্ষুস দেখে আনন্দিত হয়েছি। সকল শ্রেণীর লোক তার কাছে এসে অভয় পেত এবং আশ্বাস পেত। এভাবে তিনি বহু পথভ্রষ্ট মানুষকে সৎ জীবনযাপনের জন্য অনুকূল পরিবেশের সন্ধান দিয়েছেন। পরীক্ষার আগে যখন তার কাছে দোয়া নিতে যেতাম তখন তিনি একাগ্রতার কথা বলতেন এবং পরিচ্ছন্ন স্মরণ ক্ষমতার কথা বলতেন। বলতেন তুমি যদি একাগ্র হয়ে পাঠ গ্রহণ কর, তাহলে দেখবে গ্রন্থের পাতাগুলো সুস্পষ্ট চিত্র হয়ে তোমার স্মৃতিকে আন্দোলিত করছে। তাঁর কথার তাৎপর্য যে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতাম তা নয় তবে অনুভব করতাম শিক্ষা জীবনে একাগ্রতা নিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন। একদিন তিনি বলেছিলেন, তুমি যা পাঠ করবে তা তোমাকে অনুভব করতে হবে অর্থাৎ সত্যের কথা অথবা আনন্দের কথা যখন তুমি পাঠ করবে তখন সত্য এবং আনন্দকে অনুভব করতে হবে। তিনি তার দীর্ঘ জীবনে প্রেমের একটি প্রত্যয়ের স্বাক্ষর রেখে গেছেন যা এখনো আমাকে উদ্বুদ্ধ করে।
চলবে.....