জুলফিকার নিউটন ।।
যদি বলি আলাউদ্দিন আল আজাদ (৬ মে ১৯৩২ - ৩ জুলাই ২০০৯) আমাদের আধুনিক লেখকদের মধ্যে অন্যতম একজন তা হলে হয়তো মিথ্যা বলা হয় না। আধুনিকতাকে তিনি অর্জন করেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা বিশাল বিশে^র মাধ্যমে মননে গ্রহণের মধ্যে দিয়ে। তাই তাঁর অভিজ্ঞতা দৈশিক একই সঙ্গে বৈশি^ক; অভিজ্ঞতার সামাজিক ভিত্তি এসেছে তাঁর চেনা বাংলাদেশ থেকে আর অভিজ্ঞতার মননজাত ভিত্তি এসেছে আন্তর্জাতিক ধ্যানধারণার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে। সেজন্য তাঁর উপন্যাস কিংবা গল্প বহুস্তর বিশিষ্ট; বহু ও বিভিন্ন অর্থ ঐ সবে তিনি ভরে দিয়েছেন, চেনা বাংলাদেশ এভাবেই আতঙ্কের উন্মুলতার এক দুনিয়া হয়ে উঠেছে, যেখানে তেশইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০), শীতের শেষরাত বসন্তের প্রথম দিন (১৯৬২), কর্ণফুলী (১৯৬২), ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪), খসড়া কাগজ (১৮৬), শ্যামল ছায়াল সংবাদ (১৯৮৬), পাটরানী (১৯৮৬), স্বাগত ভালোবাসা (১৯৯০), অপর যোদ্ধারা (১৯৯২), পুরানা পল্টন (১৯৯২), পুরুদ্রুজ (১৯৯৪), ক্যামপাস (১৯৯৪), অনূদিত অন্ধকার (১৯৯১), অন্তরীক্ষ বৃক্ষরাজি (১৯৯৩), প্রিয় প্রিন্স (১৯৯৫), স্বপ্নশিলা (১৯৯২), কালো জ্যোৎøায় চন্দ্রমল্লিকা (১৯৯৬), বিশৃঙ্খলা (১৯৯৭), ঠিকানা ছিলনা (১৯৯৮), তোমাকে যদি না পাই (১৯৯৮), হলুদ পাতার ঘ্রাণ (১৯৯৯), কায়াহীন ছায়াহীন (১৯৯৯) উপন্যাস সমূহে মানবিক চরিত্রে বদলে যায়, মানুষগুলির আর্তিতে যে-নিজেই উদভ্রান্ত। মানবিক স্তর থেকে সামাজিক স্তর ভিন্ন, আরোপিত সমাজ ব্যবস্থা কী করে মানুষকে উচ্ছিন্ন করছে সেই ভাবনায় সৈয়দ টালমাটাল। কিংবা সামাজিক স্তর থেকে মননের স্তর ভিন্ন, যেক্ষেত্রে ভাবনা মানুষকে অপরাধ চেতন করে তোলে, যে অপরাধ ব্যক্তির দায়ভাগ, দায়িত্বের অন্তর্গত, নিজে অপরাধী না হয়েও অপরাধের অংশীদার। আমরা কি সবাই তা নই? মানবিক স্তরে? সামাজিক স্তরে? মননের স্তরে? শেষ পর্যন্ত সব স্তর কি একাকার নয়?
আলাউদ্দিন আল আজাদ ঘটনাগুলিকে গেঁথে তুলেছেন মনের দিকে, সেজন্য ঐ সব স্তর পরস্পর কিংবা পরস্পরের সম্পূরক; বই শেষ করে আমরা অভিভূত হয়ে যাই, ভাবি; ভাবতে-ভাবতে নিজেদের আবিষ্কার করি। ঐ আবিস্কারের আলোকে অনেকদূর দেখি, সমাজটা জীবনটা বিশ^টা বিদ্যুৎ চমকের মতন জ¦লে ওঠে, বিদীর্ণ হয়, সমাজের জীবনের বিশে^র কিংবা মননের সমাজের মানবিক অস্তিত্বের সম্পর্কের নিবিড়তায় জটিলতায় অন্তদের্শীয় গভীরতায় নাড়া খাই। ঘটনা, সেজন্য তাঁর কাছে কাহিনীর বিস্তার নয়। সব বিরোধী স্তরের উদ্ভাসন। বহুলস্তর সম্পন্ন তাঁর গল্প উপন্যাস আমাদের ভাবতে শেখাায়, অভ্যন্তরে তাকাতে শেখায়, তাঁর কাছে আমরা পাঠ নিই জীবন সম্বন্ধে বিনীত হয়ে।
আলাউদ্দিন আল আজাদের মনোভুবনের পরিধি কিংবা কল্পনাত্মক বাস্তবের ভিত্তি কি? তিনি গভীরতর অর্থে সমাজসচেতন, নিবিড়তর অর্থে নৈতিক প্রশ্ন ও সমস্যায় ব্যাপৃত। সত্তা, তাঁর কাছে, একমাত্র নির্দেশক, সেইসঙ্গে অন্তিম অন্বিষ্ট। সত্তাকে আমরা খুঁজে চলি অনবরত সমাজের মধ্যে। আমাদের ওপর ভর করে, ঘিরে সমাজ আছে, সেজন্যই আমাদের নিরূপণ করছে নিরঙ্কুশভাবে। বিভিন্ন সামাজিক দৃশ্য/ঘটনা/ টানাপোড়েন একটি শক্তির মতন; আতঙ্ক, শূন্যতা, বীভৎসতার উৎস ঐ শক্তিই, আমরা বুঝি, চমকে উঠি। বলা কি যায় না সাহিত্যের কাজ এখন কাব্যিক, কবিতার পথে; বিশাল সামাজিক তথ্যাবলী নিয়ে মিনার নির্মাণ নয়, ঐ সবের ভাার/প্রভাব/জের ব্যক্তির চৈতন্যে নিরূপণ করা তার ব্রত। আগের যুগের ঔপন্যাসিক রহস্যাবৃত্ত কিংবা দুর্জ্ঞেয় প্রতিবেশ আমাদের বোঝাতে সাহায্য করেছেন, তখন তাঁর কাজ পৃথিবীর সম্পর্কে সত্তা ব্যাখ্যান করা; ঐ সত্তা ঘিরে আছে, আচ্ছন্ন করেছে পৃথিবী। ঐ সত্তার অন্বেষণা অনুভূতির মধ্যে দিয়ে, ব্যক্তিক ভক্তির মধ্যে দিয়ে, ঐ অনুভূতি/ভঙ্গি অনির্ণীত সমাজ পটভূমিতে সত্তাকে কেবলি নিরূপিত, নির্মিত করে থাকে।
আলাউদ্দিন আল আজাদের কাছে সমাজ বাস্তব সত্তার মতন, সবকিছুই সমাজ নিয়ে। হয়তো তাঁর বিশ্বাস ব্যক্তি ও সমাজ সমগ্রতার মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত করেছে। আত্মকরুণায় চামড়া ভিজিয়ে, রক্তমাংসের হাল ছিঁড়েছিঁড়ে ঐ দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হওয়া যায়। সেজন্য তাঁর মেজাজ যোদ্ধার, পলাতকের নয়। সত্তা তাঁর ভাবনার কেন্দ্র, ভিত্তি, ভূমি; সমাজ নির্ভরশীল ব্যক্তিসত্তার বোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন, অনুভূতির ভুবনে বাস করতেও সেইসঙ্গে তিনি নারাজ। তিনি, একপক্ষে, আধুনিক জীবনের ওপর চূড়ান্ত রায় দিয়ে রক্ষণশীল মতকে খেপিয়ে তুলতে দ্বিধা করেননি, অন্যপক্ষে পরিস্থিতির সম্মুখে আমাদের অসহায় বাস্তবতার বোধ উপস্থাপিত করে বৈপ্লবিক মত থেকেও দূরে সরে গেছেন। সত্তা একান্তভাবে নেতিবাচক নয়, সত্তার মধ্যে পরিবৃদ্ধির বীজ লুকানো। আলাউদ্দিন আল আজাদের মানুষের ভাবকল্প বিপদের সম্মুখে উদ্যমহীন নয়, নোঙর ছেঁড়া নৌকো অবিকল নয়, কর্মতৎপর সে। সত্তার ওপর তিনি সঙ্গতভাবেই জোর দিয়েছেন, সেইসঙ্গে চাপিয়েছেন সমষ্টিবদ্ধ সৃষ্টিশীলতার দায়িত্ব। ঐ সমষ্টিবদ্ধ সৃষ্টিশীলতা, খুব সম্ভব, আলাউদ্দিন আল আজাদের মতে, আমাদের সংস্কৃতির/সমাজের ভিত্তি, ভূমি, কেন্দ্র। যদি সমাজ হত্যাপ্রবণ হয় কিংবা ধ্বংসশীল, সেক্ষেত্রে সত্তা সম্বন্ধে যে-কোনো প্রশ্ন তোলা সঙ্গত। এই হচ্ছে আলাউদ্দিন আল আজাদের মৌল সমস্যা, সেইসঙ্গে প্রাথমিক অন্বেষা।
তিনি ভেবেছেন ব্যক্তি চৈতন্য নিয়ে। তাঁর কাজে সমাজের অস্তিত্ব অনির্দেশিত ধ্বংসশীল পরিস্থিতির যোগফল হিসাবে এসেছে। তাঁর প্রয়াস সত্তাকে মুখোমুখি করা সমাজের/বিশে^র এবং সত্তা ও তার প্রয়োজন সকলের সঙ্গে ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত করা। এভাবেই আলাউদ্দিন আল আজাদ সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ছিঁড়েখুঁড়ে দেখতে চেয়েছেন রাজনৈতিক/অর্থনৈতিক স্তরেরও অধিক। মানুষের নিয়তি : মৃত্যু এবং ধ্বংসের সঙ্গে বাস করা; সেজন্য একমাত্র কাজ : মৃত্যুর/ধ্বংসের শর্ত মেনে নেয়া, মৃত্যু/ধ্বংসের সঙ্গে অব্যবহিত বিপদে/আতঙ্কে বাস করা, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া উন্মুলভাবে টিকে থাকা, সত্তার বিদ্রোহী তাগিদ মেনে দিকচিহ্নহীন পরিব্রাজনায় বেরিয়ে পড়া। সমাজ/মূল্যবোধ পতনশীল/ধ্বংসশীল, এই হচ্ছে আলাউদ্দিন আল আজাদের কল্পনাত্মক বাস্তববোধ; সমাজ/মূল্যবোধ আর ক্ষমতা সম্পন্ন নয়, সেজন্য মানুষকেই কেন্দ্রে আসতে হবে ফিরে-ফিরে, যুদ্ধ সংকুল কল্পনাত্মক বাস্তববোধের বিগ্রহ হতে হবে বারে-বারে। সেজন্য আমাদের সতত বিনয়ী হতে হবে কিংবা বিপদ আসন্ন জীবনযাপন করতে হবে। আকাক্সক্ষা কিংবা ক্ষোভ কিংবা আর্তি কিংবা ব্যর্থতার বোধ আমাদের জানতেই হবে। জীবন অপরাধী হোক কিংবা উল্টোটাই, সমাজ দম-বদ্ধ করা বলেই দায়িত্ব হচ্ছে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মণ্ডল পরিভ্রমণ; রুগ্ন বলেই সবাইকেই বর্তমানে বেঁচে থাকতে হয়। নিয়তি : বিদ্রোহের পতাকা ওড়ানো কিংবা মেনে নেয়া। নিয়তি : মেনে নেয়া কিংবা বিদ্রোহের পতাকা ওড়ানো। এই হচ্ছে বৃত্ত, বারে-বারে ফিরে-ফিরে।
আসলে আলাউদ্দিন আল আজাদ গভীরভাবে নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে ভেবেছেন। সাম্প্রতিক শিল্পের ঐ প্রবণতা সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সর্বত্র, বিশে^, আমাদের মতন দেশে ক্ষয় এসেছে, যা-এত দিন নিরাপদ মনে হয়েছে তা আর নয়; ঐ ক্ষয় যুক্তি মেনে আসেনি, এসেছে অনুভূতির অনির্দেশিত তরঙ্গে-তরঙ্গে। আমরা কী করে, কোথা থেকে, কেমন করে নৈতিক নির্দেশনা পাব? পতনশীল ঐতিহ্য থেকে? অবাধ ঝোঁক থেকে? এই হচ্ছে আমাদের প্রশ্ন, আমাদের ঐতিহাসিক চারিত্র। আলাউদ্দিন আল আজাদ ঐ প্রশ্নের সকল কৌণিকতা জানেন, জবাবও খুঁজেছেন তীব্র আবেগে, সেজন্য সৈয়দ দ্রষ্টা। ঐ চূড়ান্ত প্রশ্ন নিয়ে ভেবেছেন বলেই তাঁর মধ্যে আমরা খুঁজে পেয়েছি বৈপ্লবিকতা, ঐ নৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রবণতার মধ্যে তিনি নিজেকে সংলগ্ন করেছেন প্রেমিকের নিষ্ঠায়। তাঁর কল্পনাত্মক বাস্তববোধের নৈতিক বৈপ্লবিকতার ভিত্তি এখানেই, তাঁর আবেগের উৎস এবং শক্তি এখানেই।
আলাউদ্দিন আল আজাদের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ব্যক্তি। ব্যক্তির উৎকর্ষ মূল্যবোধের উৎস এবং এই ব্যক্তির বিকাশ গুটিপোকার মতন। সমাজ এই ব্যক্তির বিরোধী কেন্দ্র, তার দরুন অ-সামাজিক ব্যক্তিত্ব অমন ব্যক্তি ভাবনাদর্শের প্রতীক, স্ব-অধীন তার ভাবনাবৃত্তির পরিধি। সংস্কৃতি, সভ্যতা, মূল্যবোধ, সবকিছুর বিচারের পটভূমিতে অ-সামাজিক ব্যক্তিত্বের কারুকাজ। অবশ্য এ বিচার যুক্তিআশ্রয়ী, কিন্তু অ-সামাজিক ব্যক্তিত্বে বিপরীতবোধ প্রবল, সেজন্য যুক্তিপদ্ধতি থেকে যে মূল্যবোধের উৎসারণ তার নির্ভর শেষ পর্যন্ত মনের উপর, আর মন ব্যক্তি নিজেই তৈরি করে নেয়। আলাউদ্দিন আল আজাদের মননে এই ভাবনার প্রভাব অপরিসীম। ক্লাইভ বেল ও বার্ট্রাণ্ড রাসেল মেঘের মতন ছায়া ফেলে আছেন ভাবনার এই আকাশে। ভিক্টোরীয় নীতিবোদ সেই সঙ্গে উদারনৈতিক মতবাদ ইউরোপের পরিমণ্ডলেক্লাইভ বেল ওবার্ট্রাণ্ড রাসেলকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে, আলাউদ্দিন আল আজাদের ওপর সেই প্রভাবের অভিঘাত প্রবল ও বলীয়ান, সেই প্রভাবের কারুকাজ তাঁর ভাবনার পরতে-পরতে জড়ানো, সূক্ষ্ম শালীন মর্যাদাবোধে তিনি দীপ্ত, কিন্তু ঐ পরিমণ্ডল শেষ বিশ্লেষণে বাংলাদেশে কোথায়? এই অর্থে তিনি ঐ প্রভাবের বাইরে, এখানেই তাঁর স্বকীয়তা, এমনকি ব্যর্থতাও।
উদারনৈতিক মতবাদ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ পর্যায়ের দর্শন। ভিক্টোরীয় নীতিবোধে ঐ শ্রেণীর সংকোচন সংকেত। ক্লাইভ বেল ও বার্ট্রাণ্ড রাসেল, দুজনের ওপরই, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ও সংকোচন পর্যায়ের দর্শনের অভিঘাত প্রবল। স্ববিরোধিতা তাই তাঁদের মেজাজে। ব্যক্তি সবকিছুর উৎস, মন সব উৎকর্ষের মূল, সূক্ষ্ম শালীন রুচি, সুন্দরের জপ, এই সবই বিপরীত বোধে আক্রান্ত। ঐ বিপরীত বোধের উৎসে আছে ব্যক্তি বনাম সমাজের দ্বন্দ্ব। সেই বিপরীত বোধ ইউরোপের পটভূমিতে যে তীব্র তিক্ত ব্যক্তিবাদের জন্ম দিয়েছে, সেখানে আছে সন্দেহ, দ্বিধা, কোলাহল ও কল্লোল, সেখানে ব্যক্তি নিজের সহস্র সূক্ষ্ম সব ভাবনায় দীর্ণ, চারপাশে অন্ধ শূন্যতার আবর্ত, ব্যক্তি সেই আবর্তে ক্লাইভ বেল দ্বীপ, সে-দ্বীপ বুঝি সুন্দরের, স্বাস্থ্যের, অমৃতের, কিংবা ব্যক্তি সেই আবর্তে বাট্রান্ড রাসেলের মতন সমাজ-ছাড়া নৈরাজ্যিক স্বাধীনতার নিশেনবরদার।
ইউরোপীয় সভ্যতার খণ্ড-বিখণ্ড, শিকড়ছেঁড়া ব্যক্তিপ্রত্যয় আলাউদ্দিন আল আজাদের ভাবনায় অন্তরিত, ঐ ব্যক্তিপ্রত্যয় ও যুক্তিপদ্ধতি তিনি শুদ্ধ করে নিয়েছেন, তাই ঐ ব্যক্তিপ্রত্যয়ে ও যুক্তিপদ্ধতিতে কালের স্পর্শ নেই, যেন চিরন্তণ, অমোঘ এই মানদণ্ড। সেজন্য তার প্রয়োগফল অসামাজিক ও অবাস্তব হয়েছে। বাংলাদেশের সমাজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের মূল্যায়নে তাই বিরোধিতা দানা বেঁধেছে। মানব-ধর্মের মহিমা তিনি কীর্তন করেছেন তাঁর কীর্তনে তাই চিরকালের মানুষের আকুতি স্পন্দিত হয়েছে, তাঁর কালের যুক্তি অযুক্তিতে গ্রথিত, বিশ্বাস-অবিশ্বাসে আলোড়িত বাংলাদেশের মানুষের জন্য তিনি উপঢৌকন দিয়েছেন শুভবোধের, নিরঞ্জন বুদ্ধির, কিন্তু বিশ^াস-অবিশ্বাসে উচ্চকিত, যুক্তি-অযুক্তিতে বিদ্ধ মানুষ তাঁকে বুঝি পাঠ করেনি, আর সেই নিঃসঙ্গ দূরত্বের শিখর থেকে তাঁর শুভ্র হৃদয় নিশেনের মতন তিনি দিয়েছেন উড়িয়ে, যদি মানুষ দেখে, যদি একবার দেখে।
আলাউদ্দিন আল আজাদ মিতবাক কণ্ঠ আমাদের প্রবন্ধ রাজ্যে হয়ত অনন্য, কারণ প্রবন্ধ রাজ্যে কোলাহল শোনা যায়, কিন্তু কণ্ঠ শোনা সত্যিই বিরল। তিনি যে কল্পিত ব্যক্তির আরাধনা করেছেন সে-ব্যক্তি তাঁর মধ্যে মূর্ত হয়েছে; সংযত বাক, সহনশীল, কৌতুকে স্নিগ্ধ, যুক্তিনম্র। তাঁর ব্যক্তিত্বের এ সব গুণ প্রতিফলিত তাঁর রচনায়। এ সবই তাঁর ভাষাকে অনুপম করে তুলেছে। তিনি ভাবতে ভাবতে শব্দকে জুড়েছেন। যখনই তাঁর ভাবনার আবেগে ঢেউ লেগেছে তখনই তাঁর ভাষা হয়ে উঠেছে কবিতাস্পর্শী। তাঁর বক্তব্য বন্ধুর আলাপচারীর মতো কিংবা পরিহাসপ্রিয় নির্জন এক অধ্যাপকের মতো, যিনি ভেবে-ভেবে থেমে-থেমে কথা বলেন, চিন্তাকে নিয়ে খেলা করেন, যুক্তির পরম্পরায় বক্তব্য গেঁথে তোলেন। তিনি অমিতাচারের বিরোধী, আবেগবান তিনি, কিন্তু আবেগউত্তাল নন, যুক্তিবিশ্বাসী কিন্তু হৃদয়কে উপেক্ষা করে নেয়, তিনি বক্তব্যে দৃঢ়, কিন্তু গোঁড়া নন, কৌতুক ভালবাসেন কিন্তু ব্যঙ্গপ্রবণ নন। এই ব্যক্তিত্ব বিরল।