মোস্তফা মামুন ||
ছেলের
ভর্তির জন্য কয়েকটা স্কুল ঘুরে মনে হলো, এরা আসলে স্কুল নয়, দোকান খুলে
বসেছে। নাম আলাদা করে বলতে চাই না। বলে লাভ কী। নামে আলাদা হতে পারে, কাজে ও
ধর্মে সবাই এক। দেখে দেখে মনে হলো, আগে ওদের জন্যই একটা স্কুল খোলা দরকার,
যেখানে ওরা নিজেরা শিখবে।
আগেই জানতাম। তবু কথা বলে নিশ্চিত হলাম ধর্ম
যেমন ওপর থেকে নির্ধারিত হয়, এখানেও গলদ আসলে ওপরেই। এদের অর্থমুখিতা
ঠেকানোর কোনো চেষ্টা তো নেই-ই; বরং নানা ছিদ্র বের করে রাখা হয়েছে, যা দিয়ে
এরা দিব্যি টাকাকড়ি বাগিয়ে নিতে পারে।
বাংলাদেশে যেকোনো জায়গাতেই ফরম
বিষয়টা একটু অদ্ভুত। আপনি ফরম পূরণ করতে গেছেন, মানে ঠেকাটা আপনারই, কাজেই
আপনাকে পেয়ে বসবে। ফরমে এমন সব জিনিস জানতে চাওয়া হবে, যার কোনো মানে নেই।
হয়তো আপনি চিরকুমার সংঘের সদস্য হতে গেছেন, দেখবেন ওরা আপনার বৈবাহিক
অবস্থা জানতে চাইবে। যাই হোক, স্কুলের ফরমে মা-বাবা এদের পরিচয়ের বাইরেও
আরো দুই-তিনজনের বিস্তারিত দিতে হবে। দেওয়া হলো। ফোন নম্বর দিতে হবে আরো
বেশি এবং তাদের সঙ্গে আবার ঠিক পারিবারিক সম্পর্ক থাকা চলবে না। মা-বাবা,
এর বাইরে দুজন আত্মীয়/অভিভাবক এবং তার পরও নাকি জরুরি যোগাযোগের নম্বর
লাগবে। জরুরি যোগাযোগের নম্বর অর্থ, জরুরি সমস্যায় যোগাযোগ করা হবে। এখন
যদি সন্তানের জরুরি সমস্যার সময় তার মা-বাবা এবং চাচা-মামা এ রকম চারজনকে
খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে বুঝতে হবে পুরো দুনিয়াতেই জরুরি অবস্থা চলছে।
সেদিন ছয়জন কেন, ছয় শ নম্বরে যোগাযোগ করেও কোনো লাভ নেই। তবু অনেকের ফোন
নম্বর রাখতে হবে। ওই যে বললাম, যে ফরম পূরণ করছে তারই ঠেকা। অতএব ঠ্যাক দাও
যত সম্ভব।
এসবের চেয়েও মারাত্মক দাবি আছে একটা। অভিভাবকের মাসিক আয়
লিখতে হবে। এটা প্রায় সব স্কুলের ভর্তি ফরমে থাকে বলে এবং অনেক দিন ধরে
চলছে বলে এই নিয়ে কেউ খুব একটা ভাবে না। দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে যাওয়া আর
কী। কিন্তু প্রশ্নটা দেখেই মেজাজটা বিগড়ে গেল। বাচ্চা স্কুলে পড়বে, স্কুলের
চাহিদা হচ্ছে মূলত ওর বেতন, সেটা পেলেই তো হয়। তবু রোজগার জানতে চাইছে।
এবং এর মধ্য দিয়ে শুরুতেই সূক্ষ্মভাবে একরকমের একটা শ্রেণিভেদ তৈরি করে
ফেলা হচ্ছে। স্কুলের প্রশাসনের কর্তার কাছে বিষয়টা জানতে চাইলাম। ব্যবসায়ী
প্রতিষ্ঠানের মতো করে চালানো হয় বলে কাস্টমার কেয়ার কর্মকর্তা টাইপের
মানুষদের নিয়োগ করে রাখা হয়। তিনি বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, ‘এটা আসলে অপশনাল।
চাইলে কেউ না-ও দিতে পারে।’
‘কিন্তু ফরমে তো লেখা নেই যে ওটা অপশনাল।’
এরা এত সহজে হারেন না, ‘চাইলে কেউ না-ও লিখতে পারে। না লিখলে আমরা কোনো আপত্তি করি না।’
‘এটা ফরমে থাকাই উচিত না। আর ঐচ্ছিক হলেও লিখে দেওয়া উচিত।’
ভদ্রলোক
একটুখানি অপ্রস্তুত হয়ে শেষে সেই কথাটা বললেন যেটা এ দেশে এখন মোম যুক্তি।
‘এটা তো আসলে শুধু আমাদের স্কুলের ব্যাপার নয়। ওপরের সিদ্ধান্ত। সব
জায়গাতেই এ রকম হয়।’
‘ওপর’কে ধরলে অবশ্য ওরা ধরা দেবে না। ওমা এসব হচ্ছে
নাকি, কারা করছে—শিা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তারা এ রকম ভঙ্গি করে
বলবেন, ‘অচিরেই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ এই ব্যবস্থা নেওয়ার
প্রক্রিয়াটা রুহুল কবীর রিজভীর হুংকারের মতো, প্রতিদিন শোনা যায়, কোনো দিন
দেখা যায় না। যাই হোক, ওদের এই না জানার মতাটাও অবাক করার মতো। টেলিভিশনে
স্কুলগুলোর অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে প্রায়ই কর্তাব্যক্তিরা আসেন। আর কোনো
অভিযোগের কথা শুনে এমন অবাক হয়ে যান দেখতে বেশ লাগে।
আয়ের সঙ্গে পেশারও
উল্লেখ করতে হয়। এরও দরকার নেই। একজন রিকশা চালিয়েও যদি দামি স্কুলে
বাচ্চাকে পড়াতে পারে কোনো অসুবিধা তো নেই। আবার কে জানে হয়তো আছে। এ জন্যই
এসব জেনে নেওয়া হয়। যদি তেমন কারো ছেলে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে গিয়ে ভদ্রলোকদের
পরিবেশকে দূষিত করে ফেলে! যদিও প্রকৃতপে শিা আর শিাব্যবসাটা একাকার হয়ে
পুরো বিষয়টা এরই মধ্যে দূষিত হয়ে গেছে।
কখনো কখনো মনে হয়, এত টাকা একটা
বাচ্চার পেছনে মানুষ কিভাবে খরচ করে! টাকা পায়ই বা কোথায়? বেশির ভাগ লোক
কোথা থেকে টাকা পায় সেটা আমরা জানি। দুর্বৃত্তায়িত সমাজে বড় উপার্জনের পথটা
সাধারণত ঘৃণ্য। এই বড় উপার্জনের মানুষগুলো নানাভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে
চায়। দামি স্কুলে বাচ্চাকে পড়ানো স্ট্যাটাসে পয়েন্ট বাড়ানোরও একটা উপায়।
এরা তাই আয়ের ঘর দেখলে খুশি হন। চাহিদামতো টাকা ঢালেন। বাণিজ্যমুখী
স্কুল-কলেজের সঙ্গে ওদের মিলে যায় খুব। দুই পরে জন্য উইন-উইন সিচুয়েশন।
মাঝখানে চাপা পড়েন বোকা মানুষরা, যারা এখনো সততা-নীতি-নৈতিকতার মতো পুরনো
ব্যাপারস্যাপার নিয়ে ভাবেন।
প্রশ্ন করবেন, ওদের এই দামি স্কুলে পড়ানোর
দরকার কী! সরকারি স্কুল তো আছে। আছে। কিন্তু সন্তানের বিষয়ে সবারই স্বপ্ন
একটু বড় থাকে। টাকার জোরেই হোক, আর যেভাবেই হোক—এসব স্কুল ভালো ভালো শিক
জোগাড় করে ফেলে বলে একটা আকর্ষণ তো আছেই। তার চেয়েও বড় কথা, ঢাকা শহরে ঠিক
বাসার পাশে সরকারি স্কুল খুঁজে পাওয়া কঠিন। ছোট বাচ্চা, ঢাকার যানজট এবং
অনিরাপত্তা মিলিয়ে অনেক দূরে পাঠানো যায় না। কয়েক বছর আগে গুলশান-বনানী
এলাকায় থাকা এক বন্ধু আফসোস করতে করতে বলছিল, ‘কী অবাক ব্যাপার চিন্তা কর,
এটা বাংলাদেশ, কিন্তু এই অঞ্চলে একটা ভালো বাংলা মিডিয়াম স্কুল নেই।’
‘কিছু তো আছে।’
‘যে দু-একটা আছে, সেগুলোয় এত লড়াই যে পাওয়াই যায় না। ভাব, বাংলাদেশে থাকি কিন্তু বাংলা মিডিয়ামে চেয়েও বাচ্চাকে পড়াতে পারছি না।’
ইংলিশ
মিডিয়ামে বাচ্চা ভর্তি করাল। আর দেখা হলেই আফসোস করতে থাকল, ‘ছেলে এখন
ইংরেজির মতো বাংলা বলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলে, ট্যাগোর...।’
ওর আফসোস
দেখে মনটা ভিজে গিয়েছিল। যে রবীন্দ্রনাথের ‘শাহজাহান’ কবিতা আবৃত্তি করতে
করতে নিজেই প্রায় শাহজাহান হয়ে যায়, ওর জন্য ট্যাগোর মেনে নেওয়া একটু
কঠিনই।
তবু সোজা বাংলায় বললে, দায়ে পড়ে সবাই-ই সব মেনে নিচ্ছি। আর এই
মেনে নেওয়াটা কুফল হয়ে অন্যভাবে বেরোচ্ছে। শুরু থেকেই এই টাকা খরচ গায়ে
লাগে। শিা যেহেতু চড়া দামে কিনতে হচ্ছে, কাজেই সবাই ধরে নেয় এটা একটা
বিনিয়োগ। বিনিয়োগ যখন তখন মুনাফারও চিন্তা আসবে। সেই শুরু থেকেই তাই আমরা
সন্তানদের টাকা উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে তৈরির একটা উদ্যোগ নিই। ওরা এভাবেই
টাকা তৈরির যন্ত্র হয়। মানবীয় গুণের মানুষ আর হয় না। মাঝেমধ্যে মনে হয়,
সমাজের এই যে বিকৃতি, লোভ, হানাহানি—এসবের কারণ বের করতে বেশি গবেষণার
দরকার নেই। স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে বসে থাকলেই সব
স্পষ্ট হয়ে যাবে।
অনেক মন খারাপের কথা বলে ফেললাম। শেষে তাই একটা কৌতুক।
এক স্কুলে বাচ্চাদের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য শিক বাচ্চাদের জন্য পরীার
আয়োজন করলেন। একটা ছবি দেখানো হবে সবাইকে, দেখে এর মানে বলতে হবে। ছবিটা
হচ্ছে দুটি বিড়ালের, মা এবং বাচ্চা বিড়াল, দুজনেরই মন খারাপ।
একজন ছবিটি দেখে বলল, ‘ওর মা ওকে জোর করে খাওয়াতে চাচ্ছে, কিন্তু বাচ্চাটা খেতে চাচ্ছে না। তাই দুজনেরই মন খারাপ।’
শিক
বুঝলেন, এই বাচ্চাটি কোনো ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানের। এই পরিবারের সন্তানরা
মনে করে মা যে জোর করে খাওয়াতে চান সেটাই পৃথিবীর প্রধান সমস্যা।
আরেকজন দেখে বলল, ‘আসলে ওর মা বাচ্চার জন্য খাবার জোগাড় করতে পারেনি। সে জন্য মায়ের মন খারাপ। খাবার না পেয়ে বাচ্চার মন খারাপ।’
এই
বাচ্চাটি কোন পরিবারের বুঝতে শিকের বাকি থাকল না। তিনি পরীা বন্ধ করলেন।
কিভাবে এমন বিপরীতমুখী মানসিকতার বাচ্চাদের মধ্যে সমতা আনা যায়, চিন্তা
শুরু হলো এই নিয়ে।
আমাদের বিজ্ঞ কর্তাব্যক্তিরা শুনবেন না জানি। তবু
বলি, শিক-শিাপ্রতিষ্ঠানের কাজ এটাই। বাচ্চাদের চোখে পুরো পৃথিবীকে সমান ও
সুন্দর করে দেখানোর।
লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক