ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রবিবাসীয়......
Published : Sunday, 17 January, 2021 at 12:00 AM, Update: 17.01.2021 1:05:53 AM

তিনজন তিনজনা

রবিবাসীয়......আনোয়ারুল হক ||
তিনজন তিনদিক থেকে এলো কান্দিরপাড়ে। একসাথে ঢুকলো সুখেনের দোকানে। নাস্তা খাবে একসাথে, তারপর ক্লাশে যাবে। একজনের নাম সুমন, কমল এবং জামান। সুমন অর্থনীতে থার্ড ইয়ার অনার্স, কমল একই ইয়ারে বাংলা এবং জামান ইংরেজিতে পড়ে। সুমন ঝাউতলা থেকে, কমল মোগলটুলির লালা দিঘীর পূর্ব পাড় থেকে আর জামান প্রফেসর পাড়া থেকে রোজ রোজ কান্দিরপাড় এসে একসাথে হয়। ক্লাশ করার চেয়ে ওদের মধ্যে আড্ডাটাই হয় বেশি। ছাত্র রাজনীতিতে ওদের সম্পৃক্ততা নেই। তবে যে কোন দলের মিছিলে যেতে তাদের উৎসাহেরও কমতি নেই। এমন কোন দলের নেতা নেই যাদের সঙ্গে এই তিন জনের আবদার, মেলামেশা নেই।
জাসদ নেতা শিব নারায়ণ দাস, যাকে সবাই শিবু দা বলে ডাকে, তিনি দল নিয়ে মিছিল করতে করতে কান্দিরপাড় গোল চত্বর, লিবার্টি সিনেমা হলের দিকে যেতে যেতে হাতের ইশারায় কেবল ডাক দিতে দেরি, আর এই তিনজনের মিছিলে যোগ দিতে দেরি হয় না। ঠিক তেমনি, ছাত্রলীগের নাজমুল হাসান পাখি ভাই কিংবা ছাত্র ইউনিয়নের বাকের ভাই ডাক দিলেও তাদের মিছিলে গিয়ে শ্লোগান তুলতে ওরা এক মিনিটও কার্পণ্য করে না।
সব কিছুতেই ওদের উৎসাহ নদীর জলের জোয়ারের মতো। দু’কূলপ্লাবী। কেবল নিজে ভাসে না, অন্যকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আজ কান্দিরপাড় গোল চত্বর, টাউনহলের সামনের রাস্তা, ভিক্টোরিয়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শাখার রানীর দিঘীর পাড় জুড়ে মিছিলে মিছিলে সয়লাব। জাসদ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সব কটি দলই নিজেদের- কে কত দলে ভারি তা দেখাবার জন্য আজ যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচন হতে আর দেরি নেই। তারিখ ঘোষণা হয়ে গেছে। চারিদিকের হাওয়া গরম। বন্য বাইসনের নাকের ভিতর দিয়ে ধেয়ে আসা গরম বাতাস যেন উড়ছে চারিদিকে।
তবে যত গর্জে তত বরষে না। মিছিলে যতই হাঁকডাক হোক না কেন, মিটিং মিছিলের পরে এই ছাত্রনেতারা আবার কলেজ রোডে এই সুখেনের দোকানে এক টেবিলে বসে চা, সিঙারা খায়। হাসাহাসি করে। তিন বন্ধু দেখলো, তাদের পাশের টেবিলে এসে স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে বসলো জাসদ ছাত্র নেতা শিবু দা। মাথায় গোল করে ব্যা-েজ বাঁধা। গতকাল বিকেলে শিবু দা মিছিল নিয়ে আসছিলেন রানীর দিঘীর পশ্চিম পাড় ধরে কান্দিরপাড়ের দিকে। ছাত্র ইউনিয়নের বাকের ভাই, এহসান ভাই, গোলাম ফারুক ভাইরা যাচ্ছিলেন কান্দিরপাড় মোড় থেকে কলেজের দিকে। চলেই যাচ্ছিলো পাশাপাশি মিছিল দুটো দুই দিকে। হঠাৎ কী হলো কে জানে, এহসান ভাই দৌড়ে গিয়ে হাতের বাঁশের লাঠিটা দিয়ে শিবু দা’র কপাল বরাবর, ঠাস্ ঠাস! লেগে গেল হৈ চৈ।
-এহসান কী করিস্, কী করিস্ বলতে বলতে বাকের ভাই দৌড়ে গেলেন শিবু দা’র দিকে। পাঁজাকোলা করে রক্তাক্ত শিবু দাকে নিয়ে ছুটলো তিনি এবং আরেক ছাত্র সদর হাসপাতালে।
যতই আঘাত পাক না কেন, শিবু দা’ কী আর বিছানায় শুয়ে থাকার মানুষ! ঘুম ভেঙে উঠেই এসে গেছেন চায়ের দোকানে, আড্ডায়। তার একটু পরেই এলেন বাকের ভাই আর এহসান ভাই। এলেন পাখি ভাই। চারজন বসলো এক টেবিলেই। শিবু দা’র মুখটা গম্ভীর। মাথার ব্য-েজের কোনায় এক চিলতে রক্তের দাগ।
চা নাস্তার অর্ডার দিলেন বাকের ভাই। বরাবরের মতো হাসি মুখ তার। ফর্সা চেহারার সুদর্শন ছাত্র নেতা সকলের প্রিয়জন। পাখি ভাই অন্য তিনজনের তুলনায় শরীরে কিঞ্চিত মোটা, পেটটা দৃশ্যমান আগে চলে, গায়েবায়ে যেমন তিনি বড় মনটা তার ততোধিক বড়, সদালাপি, হসিমুখ। এহসান ভাই তাদের ঠিক বিপরীত। দুষ্টুমিতে সেরা। গতকালের মারামারিটা গায়ে পড়ে তিনিই লাগিয়েছেন।
পাশের টেবিল থেকে ওদের দেখে সুমন তার বন্ধু দুইজনের দিকে ইশারা করলো,
-দেখ দেখ গতকাল মারামারি করলো তো আজ সকালেই এক টেবিলে, হা হা হা..
নিজেদের টেবিলে বসে ওরা শুনলো, পাখি ভাই শিবু’দাকে জিজ্ঞেস করছেন,
শিবু দা’ কেমন আছো ? শরীর কেমন ?
শিবু দা’ খুব শুদ্ধ ভাষায় যেমন চমৎকার বক্তৃতা দেন তেমনি কথাও বলেন শুদ্ধ উচ্চারণে। ছোটখাট মানুষ, তীক্ষè বুদ্ধীদীপ্ত ঝকঝকে কালো ফ্রেমের চশমার ভিতরে দুটি চোখ, মুখে খোঁচাখোঁচা কালো দাড়ি, কালো কিন্তু কমনীয়। পাখি ভাইয়ের প্রশ্নে চোখ তুলে একবার এহসান ভাইয়ের মুখের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে বাকের ভাইকে ছুঁয়ে পাখি ভাইয়ের মুখে থেমে বললেন,
আর থাকা ! তোমরা আমাকে দয়া করে যেমন রেখেছো, তেমনই আছি। মাথা ফাটিয়েছো, জানটা যে নাওনি, সে তোমাদের দয়া। অপার করুণা।
বাকের ভাই এহসানের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে শিবু দা’কে সান্ত¡না দিলেন,
তেমন বেশি কিছু হয়নি শিবু দা। জানবেন, এহসানের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেবো।
এহসান ভাই বাকের ভাইয়ের মুখে শাস্তির কথাটা শুনে তেমন ঘাবড়ে গেলেন বলে মনে হলো না। বললেন,
আইচ্ছা শিবু দা, ইতান, মানে হইলো আপনের তো মিছিলে থাকনের কথা ছিল না। আপনে থাকলেন কেন্ ? আর থাকবেন তো থাকবেন, এক্কেবারে মিছিলের সামনে ক্যান ?
পাখি ভাই এহসান ভাইকে ধমক দিলেন,
সেই জন্য তুই মাথায় বাড়ি দিবি ?
এহসান ভাই সারে-ারের মত হাত কচলে বললেন,
কী করমু, মিছিলের সময় শিবু দা’রে দেখলে আমার মাথা গরম হইয়া যায়। কেন জানি মারতে ইচ্ছা করে..
জবাবটা শুনে বাকের ভাইও অবাক বিস্ময়ে এহসান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
এহসান, এইটা কোন কথা বললি তুই ? মাপ চা, মাপ চা শিবু দা’র কাছে। জলদি..
সাথে সাথে এহসান ভাই শিবু দা’র হাত জোড় হাতের তালুতে পুরে অনুনয়,
শিবু দা, আমার ভুল হইয়া গেছে, মাপ কইরা দেন। আমি আর কোন দিন আপনারে মারুম না। মাপ কইরা দেন দাদা। প্লিজ প্লিজ!
শিবু দা’ এহসান ভাইয়ের অনুনয়ে বিগলিত হলেন। গভীর জলের স্বরে বললেন,
থাক থাক আর মাফ চাইতে হবে না। ভুল করেছো, আর করো না। তোমরা তো ছেলেমানুষ!
তারপর মিটমাটে উপসংহার টানলেন পাখি ভাই,
শিবু দা, আর কী খাবেন, বলেন-
এসবে আবার শিবু দা কার্পণ্য করেন না। বলেন,
খাওয়াও তোমাদের যা খুশি। নিজে তো আর খেতে পারবো না। সেই সাধ্যিও নেই। তোমরা খাওয়াচ্ছ বলেই তো খাচ্ছি। আজ আবার দুপুরে বিকেলে রাতে মিটিং আছে। বাইরেই তো খেতে হবে।
দোকানী সুখেন সুযোগ বুঝে লুচি, হালুয়া, সিঙাড়া, ডাল-ভাজি সব এনে চারজনের সামনের টেবিলে জড়ো করতে লাগলো। ব্যবসাটা ভালই বুঝে সুখেন।
বড় ভাইদের নাটকের মিলনাত্মক দৃশ্য খাওয়ার পর্বে তাঁদের রেখে ওরা তিনজন, সুমন, কমল, নাসির বের হয়ে এলো দোকান থেকে। বিল দিল না কেউ। সুখেন চিল চিৎকার দিল,
-ও সুমন দা, বিল দিব কেডা ?
-লিখে রাখ সুখেন দা। পরে দেব।
-কত আর লেখতাম। পুরান খাতা তো শেষ কইরা নতুন খাতা জোড়া দিছি। আর কত ?
বাকের ভাই তাঁদের টেবিল থেকে হাত তুলে সুখেনকে নিরস্ত করলো। ইশারায় বললেন, তিনি দেবেন।
কুতজ্ঞতার হাসি বাকের ভাইয়ের দিকে মেলে দিয়ে তিন যুবক হাত তুলে সালাম দিল পরিত্রাণ কর্তাকে। তারপর বের হয়ে আফতাব ব্রাদার্সের সামনে এসে সিগারেট ধরালো তিনজনেই। কী আরাম!
ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তাদের চোখ কলেজ রোডের রাস্তায় হুড তোলা প্রতিটি রিক্সার দিকে। সরকারি মহিলা কালেজের মেয়েরা, যারা যাচ্ছে, আসছে তাদের দিকে। সুমন একগাল ধোঁয়া ছেড়ে কবিতা আওড়ায়,
‘মোড় ঘুরতেই নোয়ালে মাথা, আমি দেখলাম চুলের সিঁথি
শ্যামলা বরণ, চোখ দুটো তার কেমন কেমন মন উথলায়।’
কমল জিজ্ঞেস করে, কার কবিতা রে ?
ফজল মাহমুদের।
দুই.
সরকারি মহিলা কলেজের সামনে থেকে রিক্সা নিলো ওরা তিনজন। তিন বান্ধবী। কামরুন্নাহার শিরিন, রাজিয়া সুলতানা শিরিন এবং জাহানারা বেগম শিরিন। তিনজনেই শিরিন হওয়ায় সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল। তিনজনেই ক্লাশ না করে এক রিক্সাতেই উঠে বসেছে প্রজাপতি পাখা মেলে।
মফস্বল শহরের রাস্তায় ছেলেরা হামেশাই তিনজন একত্রে রিক্সায় উঠে, কিন্তু মেয়েরা সাধারণত দ্বিধা করে। আজ কী হলো এদের, তিনজন একসাথে কান্দিরপাড় রওয়ানা হয়েছে এক রিক্সায়। তিনজনের মধ্যে দুজন খুব উত্তেজিত। দুইজনের কারণ আছে। তবে তৃতীয়জন কিছু জানে না, এবং কোন কারণ নেই বলে নির্লিপ্ত।
ছেলে মহল মানে যারা চিনে তারা তিন শিরিনকে চেনার জন্য কারুন্নাহার শিরিনকে বলে, লাল শিরিন, রাজিয়া সুলতানা শিরিনকে কমলা শিরিন আর জাহানার বেগম শিরিন হলো চকলেট শিরিন। লাল শিরিনের গায়ের রঙ ফর্সা অতি সুন্দর। কমলা শিরিনের রঙ কমলার মতেই, যাকে লাল বলা যায় না। মনোহরা। আর চকলেট শিরিনের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, কুমড়ো লতার মতো বলে সে হচ্ছে চকলেট শিরিন। তিনজনের উচ্চতা সমান, একই বিষয়ে পড়ে আর সারাক্ষণ একে অপরের সঙ্গে আলাপ, খুনসুটি করে যাতে বিষয়ের কোন অভাব হয় না।
এক রিক্সায় আজ সকালের তিনজন শিরিন লাল নীল বেগুনী আকাশে উড়া ঘুড়ির মতন হাওয়ায় উড়তে উড়তে রানীর দিঘির দক্ষিণ পশ্চিম কোণা অতিক্রম করলো। আর কী কথায় হিহিহি করতে করতে যাচ্ছে।
রিক্সাটা মোড় ঘুরলো একটু জোরের উপর। লাল শিরিন চেঁচিয়ে উঠলো,
এই থামো, থামো। এখানে রাখো রিক্সা। পাইছি রে। আয় তোরা।
লাল শিরিন মাঝখানে উঁচুতে বসা ছিল। সে আগে অনুচ্চ লাফ দিয়ে রিক্সা থেকে নামলো। তারপর নামলো কমলা ও চকলেট শিরিন। সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাড়াতে কমলা লালকে বললো,
নামলি কেন ? কী হইসে ?
কী হইবো আর? ঐ দেখ্ তোর নাগর ? লাল বললো।
সরে এসে প্যানোরমা উল্টোদিকে দাঁড়ানো ছিল সুমন, কমল ও জামান। তারাও দেখলো চকলেট, লাল, কমলা শিরিনদের। এদিকেই আসছে ওরা। দেখে, কমল সাঁই করে উল্টো ঘুরে এক দৌড়ে ঢুকে গেল আফতাব ব্রাদার্সের বইয়ের দোকানে। সুমন কিছু বুঝার আগে জামানও সরে গেল সুখেনের চায়ের ড়োকানের রান্নাঘরে।
ততক্ষণে লাল শিরিন সুমনের মুখোমুখি। সুমনকে দাবড়ানি দিল সে,
এই সুমন, কমল কোথায় রে ?
এইখানেই তো ছিল, কোথায় জানি গেল.. ’ বললো সুমন।
যাও ধরে আনো ওকে, ওর চুল ছিঁড়বো আমি..’ লাল শিরিনের বজ্র কণ্ঠ ঝড়লো বাতাসে।
কমলা শিরিনও হেঁকে বললো, জামান কোথায় ? ওকে তো দূর থেকে দেখলাম আমি তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে।
সুমন আমতা আমতা করে,
ছিল তো এখানেই, এখন তো নেই!
নেই মানে ? কোথায় গেল ? ওকে আমি মজা দেখাবো। সাহস কত বড়। আমাকে চিঠি দেয়! জানে না সে ?
এতক্ষণে বুঝে গেছে সুমন। ঘটনা ওলটপালট হয়ে গেছে। একজনের চিঠি চলে গেছে অন্যজনের কাছে। হতেই পারে, তিনজনেরই নাম যে শিরিন। তার মধ্য থেকে আসল জনকে খুঁজে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
সুমন লালকে বললো, ভুল হয়ে গেছে হয়তো। কমল এলে আমি বলবো তাকে, তুমি যে তাকে মারতে এসেছিলে।
কী ? বলছো তুমি ? মারতে এসেছি আমি ? লাল ক্ষেপলো।
ফোঁস করে ওঠে কমলা শিরিন,
মারবে না তো কী ? কার চিঠি কাকে দেয় ঠিক নেই। মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওর।
সুমন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না যেন। বললো, কার চিঠি ? তোমরা ঠিক বলছো তো ?
চকলেট শিরিন দুই বান্ধবীর উত্তেজনা উপভোগ করে। মিটিমিটি হাসে। একটু মন খারাপ ভাবও আসে তার মনে। ওকে কেউ চিঠি লিখে না বলে। সুমন লাল এবং কমলা শিরিনের ঝাল ঝাল কথার ফাঁকে চকলেট শিরিনের দিকে তাকায়। হাসে, মন ভোলানো হাসি।
বলে, ভাল আছো তুমি ?
মুখে উত্তর না দিয়ে চোখের ভাষায় জবাব দেয় চকলেট শিরিন। মনে মনে জিজ্ঞেস করে,
আমি ভালো আছি, তুমি ?
জবাব জানতে হয় না কোন কোন প্রশ্নের। জিজ্ঞেসও করা হলো না। তার আগেই লাল শিরিন ও কমলা শিরিন দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সায় উঠে গেল। সেখান থেকে দু’জনে দু’টি কাগজের দলা সুমনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চকলেটকে বললো, জলদি রিক্সায় ওঠ্। কলেজে ফিরবো। মোল্লার মাথা চিবিয়ে খাবো।
তিন.
মোল্লা সরকারি মহিলা কলেজের সবচেয়ে বয়ষ্ক পিয়ন। চার আনা, আট আনা দিলে তাকে দিয়ে যে কোন কাজ করানো যায়। মেয়েরা ওকে কেউ ডাকে দাদু, কেউ কাকু। কেউ ডাকে, মোল্লা। গেইটের বাইরে থেকে চানাচুর, ফুচকা, আচার, শেন পাপড়ি, রেশমি মিঠাই সব তাকে দিয়ে আনানো যায়। দেওয়া যায় প্রেমপত্রও। কমল বহু ভেবে চিন্তে লাল শিরিনকে একটা চিঠি দিয়েছিল সেই চিঠি গিয়ে পড়েছে কমলা শিরিনের হাতে, আর জামান দিয়েছিল কমলাকে, সেই চিঠি গিয়ে পড়েছে লালের হাতে।
ভুল করেছে মোল্লা। অবশ্য মোল্লাকে যেমন বলা হয়েছে, চিনিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে তেমনই করেছে। তার ভুল ছিল না। ভুল ছিল এই সমস্থ উল্টাপাল্টা ঘটনা ঘটানোর পিছেনে যে কলকাঠি নাড়ে, তার।
সেদিন কলেজে আসার সময় কমল জামান দুজনেই লাল শিরিন এবং কমলা শিরিনকে দেখেছে, শীতের সকাল, তাই লাল শিরিন গায়ে চাপিয়েছে লাল কার্ডিগান আর কমলা শিরিন নীল কার্ডিগান। সেইমত মোল্লার হাতে চিঠি দেবার সময় কমল বলেছে, লাল উলের জামা গায়ে যে শিরিন, তার হাতে দিবা, বুঝছো ?
মোল্লা মাথা নেড়েছে, বুঝেছে।
জামান মোল্লার হাতে চিঠি দেবার সময় বলেছে, নীল উলের জামা পড়ে আছে যে শিরিন, তার হাতে দিবা এই চিঠি। ব্ঝুছো ? মোল্লা নেড়ে বলেছে, বুঝছে।
তারপর মোল্লা ডান হাত পেতেছে, বকশিস দেন।
কমল এবং জামান চার আনা করে দুজনে মোট আট আনা দিয়েছে মোল্লাকে।
কিন্তু মোল্লার তো কোন দোষ নেই।
সেদিন ক্লাশের অবসরে লাল শিরিন কমলা শিরিনকে বললো,
এই, তোর কার্ডিগানটা তো খুব সুন্দর। কে বানাইছে রে ?
যে ই বানাক, তোর পছন্দ হইছে ? পড়বি ? তো আয়, বদলা বদলি করি।
এরপর লাল গেলো নীলের জায়গায় আর নীল এসে চাপলো লালের গায়ে।
ফলে, যা হবার তাই হয়েছে। একজনের চিঠি আরেকজনের হাতে গেছে !
সুমন ওরা চলে যেতেই কমল ও জামানকে দেখলো, গুটি গুটি পায়ে ওর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বললো,
দুজনেই ভাগলি ক্যান ? শালারা, প্রেম করতে চাইবি, সমস্যা ফেস্ করবি না ! ভীতুর ডিম সব!
চার.
এইসব ছেলেমানুষি ঘটনার পর কুমিল্লা শহর অনেক বদলেছে। উন্নয়নের জোয়ারে শহরের চেহারাটাই গেছে পাল্টে। সুমন, কমল, জামানরাও গেছে বদলে। কে কতটুকু বদলেছে তাই যেন দেখা হয়ে গেল সেদিন। ওদের সকলের ছোট বেলার স্কুল মডার্ণ স্কুল, ২০২০ এ্যালামনাইয়ে। যে যেখানে ছিল খবর পেয়ে ছুটে এলো সবাই। সবার বিয়ে হয়েছে। সংসার হয়েছে। সবাই ভালো আছে। চাকুরি, বউ, বাচাচাদের নিয়ে কেউ অসুখী নয়। এসেছে লাল শিরিন, কমলা শিরিন, চকলেট শিরিন। এসেছে সিনেমার প্রডিউসর সুমন, বিগ মার্চেন্ট কমল এবং ব্যাঙ্কার জামান।
একেকজন একেকজনকে দেখে ফিরে গেল তাদের ফেলে আসা পুরনো দিনগুলোতে। লাল শিরিন বিয়ে করেছে তার পছন্দের মানুষকে। কমলা শিরিনও তাই। আর চকলেট শিরিনের কোন পছন্দের মানুষ ছিল না বা হয়নি বলে বাবা মায়ের পছন্দের পাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে বিয়ে করে সেও সুখে আছে।
দুপুরে লাঞ্চের পর কলতলায় হাত ধুতে গিয়ে চকলোট শিরিনের সাথে দেখা হয়ে গেল সুমনের। সেই আগের মত হাসি বিনিময় হলো। কিন্তু কোন কথা হলো না। হাত ধুয়ে নরম জেসমিনের গন্ধ আশেপাশে ছড়িয়ে দিয়ে চকলেট শিরিন ফিরে যেতে যেতে সুমনের দিকে ফিরে তাকাল একবার। সেই সময় সুমনও তাকাল ওর দিকে।
আবার সেই হাসি বিনিময়। কোন কথা হলো না।
কেউ টের পেল না, শুধু চকলেট শিরিন টের পেল, তার বুকের বাম পাশে একটা চিনচিনে ব্যথা যা ছিল গোপনে গোপনে, চল্লিশ বছর পরে মনে মনে কথা বলে সে, আমি ভালো নেই। তুমি ভালো আছো, সুমন ?
একটু দূরে কলতলায়, সুমন একটু বুঝি আনমনা হলো, হাত ধুয়ে এসে চকলেট শিরিনকে খুঁজে বের করে বললো,
খুব ভালো লাগছে তোমাকে দেখে। খুব।
পানপাতা মুখ, শ্যামলা রঙের চকলেট শিরিন আগের মতই হাসলো।
বললো, আমারও।

১৬. ০১. ২০২১
বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা।



শুভ জন্মদিন কথাশিল্পী আনোয়ারুল হক

আনোয়ারুল হক, কবি কথাশিল্পী নাট্যকার গবেষক। আনোয়রুল হকের জন্ম ১৯ জানুয়ারি ১৯৫২, কুমিল্লার মোগলটুলি নানাবাড়িতে।
গল্প কবিতা গবেষণায় সমর্পিত আনোয়ারুল হক লেখনিতে অব্যাহত আছেন আজকের এই দিন পর্যন্ত । কুমিল্লার কাগজ পরিবারের পক্ষ থেকে আনোয়ারুল হককে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
জীবনমুগ্ধ এই  শিল্পী ২০১২ থেকে গল্পই লিখছেন নিয়মিত। গল্প এই লেখকের অন্তরের ভিতর বাহিরের জীবন অবলোকনের ভাষা, সহজ সরল কথকতায় যা তিনি বইয়ের পৃষ্ঠার মত তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে। শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি লেখালেখি তাঁর মানসিক আহার। রাষ্ট্র সমাজ সংসার ও মানুষকে তিনি দেখেন মানবিক চোখ দিয়ে। তাঁর চোখ হতাশা যেমনি দেখে তেমনি আশার আলোও দেখে। এই দেখা সংক্রমিত হয় পাঠকের মনে যখন সে পাঠ করে তাঁর গ্রন্থের গল্প। তাঁর কলম চলে সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও। তাঁর লেখা সাবলীল। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস যা তাঁর জীবনের আলোয় দেখা। কবিতা তাঁর প্রেম। যা সবসময় অধরা। আর নাটকের অন্যতম উপাদান নিজের ও অপরের জীবন। এইসব নিয়ে বেঁচে থাকা, বেঁচে আছেন আনন্দে-বিরহে, শুভকামনায় প্রিয়জনদের।
যাঞ্চা করেন সবসময় প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী, বন্ধু শুভানুধ্যায়ী সকলের আন্তরিক আশীর্বাদ সবসময় সুস্থ ও সুন্দর জীবনের  কথাশিল্পী আনোয়ারুল হককে নিয়ে লিখেছেন এ সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল কবি হালিম আব্দুল্লাহ এবং গল্পকার কাজী মোহাম্মদ আলমগীর।

আনোয়ারুল হক যেভাবে বেড়ে ওঠেন
জন্ম ১৯ জানুয়ারি ১৯৫২, কুমিল্লার মোগলটুলি নানাবাড়িতে।
পৈত্রিক ভিটা : নতুন চৌধুরি পাড়া (কবরস্থানের উত্তরপাশ সংলগ্ন)। বর্তমান আবাস : বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা।
বেসরকারি ও সরকারি কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে শিক্ষকতা করেছেন আটত্রিশ বছর কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম, সাতকানিয়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর সরকারি কলেজে। বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে প্রফেসর পদে অবসর নিয়েছেন ২০১০ সালে। শিক্ষকতা জীবনের শুরু ১৯৭৮ এ কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের ইস্পাহানী স্কুল ও কলেজে বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে। যা আজও অব্যাহত আছে স্বাদ বদলের ভিন্ন মাত্রায়।
বর্তমানে খ-কালীন রিসোর্স প্রফেসর পদে অধ্যাপনা করছেন হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এ।

লেখালেখি শুরু কবিতা দিয়ে। বেড়ে উঠেছেন ৬৯ থেকে ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান অর্জন বাংলাদেশ -এর রক্তাক্ত অভ্যুদয়ের তরল অনল বুকে করে। প্রাইমারি স্কুল আওয়ার লেডি অব ফাতেমা কনভেন্ট ১৯৬২-১৯৬৫, মাধ্যমিক কুমিল্লা জিলা স্কুল ১৯৬৫-১৯৬৯, উচ্চ মাধ্যমিক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ১৯৬৯-১৯৭৫/১৯৭৬, এম এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৬-১৯৭৭ পর্যন্ত। শুরুতে কবিতা, তারপর লিখেছেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ‘জনান্তিক নাট্য সম্প্রদায়’ এর জন্য ‘মিউজিক্যাল ড্রামা’, মঞ্চ নাটক।

লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ :
অনিয়ম ফিরে এসো (মঞ্চনাটক, মিউজিক্যাল ড্রামা) ১৯৭৯
আগুন আগুন খেলা ( মঞ্চনাটক) ১৯৭৯
নজরুল নার্গিস প্রসঙ্গ : নবমূল্যায়ন (গবেষণা গ্রন্থ) ২০০০
কাশবন প্রকাশন, ঢাকা
নজরুল ও তাঁর বৈরীপক্ষ (গবেষণা) ২০০১
নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা
লাবণ্য শুধু তোমার জন্য (কবিতা) বইমেলা ২০০৭
মেঘমালা, ঢাকা
অনুভবে তুমি আছো (গল্পগ্রন্থ) বইমেলা ২০০৭
মেঘমালা, ঢাকা
মাছের চোখে জলের শরীর (কবিতা) বইমেলা ২০১২
মিজান পাব. ঢাকা
নজরুলের বিতর্কিত অধ্যায় ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (প্রবন্ধ) বইমেলা ২০১৫
মিজান পাব. ঢাকা
ডেটলাইন ৬ নভেম্বর ১৯৭১ (মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস) বইমেলা ২০১৬
মীরা প্রকাশন, ঢাকা
প্রেমজ (গল্পগ্রন্থ) বইমেলা ২০১৭
কুমিল্লার কাগজ প্রকাশনা, কুমিল্লা।
আমি যুগে যুগে প্রেমে ও বিপ্লবে (নজরুল বিষয়ক প্রবন্ধ ও নাটক)
নজরুল পরিষদ, কুমিল্লা ২০১৯
ফুলকন্যা (গল্পগ্রন্থ) বইমেলা ২০১৯
ঐতিহ্য, ঢাকা।
ক্রসফায়ার (গল্পগ্রন্থ) প্রকাশিতব্য, বইমেলা ২০২১
গল্পকার, ঢাকা।


আনোয়ারুল হক ঃ শরীর ও মনের কথাশিল্পী

রবিবাসীয়......কাজী মোহাম্মদ আলমগীর।
বাংলা ছোট গল্পের বয়স খুব বেশি হয় নি। তাকে বাংলা সাহিত্যের কনিষ্ঠ সন্তান বলা হয়। তাই বলে বয়স একবারে কমও হয় নি। এর রয়েছে বিশাল বৈচিত্র। জীবনের নানা অন্দি সন্ধির পরিচয় আমরা বাংলা ছোট গল্পের শরীরে-অন্তরে লক্ষ্য করি। কোন প্রকার ভান-ভণিতা ব্যতিত, সহজ সরল গল্প যেমন পাঠকের হৃদয়ে মগজে ঢুকে পড়ে তেমনি জটিল কৌশল, বহু বিভঙ্গি আশ্রিত গল্পও পাঠকের চিন্তায় আশ্রয় করে নেয় অবলিলায়। কথা সাহিত্যিক গল্পকার আনোয়ারুল হক তাঁর গল্প সমূহে জীবনের বহুবিধ প্রশ্ন উত্থাপণ করেছেন। অধিকাংশে নাম পুরুষ বয়ানে মানব মানবীর চিরায়াত সম্পর্ককে প্রাদান্য দিয়েছেন। ঠিক একেই কারণে আনোয়ারুল হকের গল্প গ্রন্থের নাম ‘ প্রেমজ’  ‘ফুল কণ্যা’ ইত্যাদি। তিনি কষ্ট করে জোর করে গল্প লিখেন না। অভিনবত্বের  পেছেনে ছুটেন না। চমকে দিবেন বলে গোঁ ধরেন না। জীবন যেমন তেমন রেখেই এর বিভিন্ন পরতে আলো ফেলেন। ফর্মের জন্য তাকে চিন্তা বা দুশ্চিন্তা করতে হয় না। ফর্ম বিষয়ের সঙ্গে মিশে থাকা অস্তিত্ব তাই আনোয়ারুল হকের গল্পের ফর্ম তাঁর বিষয়ের সঙ্গে থাকা সহোদর। ভাষা সেখানে বাধ সাধেনি।
প্রফেসর আনোয়ারুল হকের জীবনের অভিজ্ঞান শিক্ষদান। তিনি সেই অভিজ্ঞানের কথা তাঁর গল্পে দ্বীধাহীন চিত্তে বলেছেন। কোথাও তিনি উত্তম পুরুষে স্ব-শরীরে হাজির থেকেছেন। অন্য নামে নিজেকে আড়াল করেননি। তাই তিনি বলতে পারেন -‘ চাঁদপুর কলেজের প্রথম দিকের দিনগুলো আমার সুখে যায় নি। সুখের হবেই বা কী করে! নব্বইয়ের সেই সময়টা তো  তখন অ-সুখের ।’ তিনি আনোয়ারুল হক রাজনীতি সচেতন।
 গল্পে শ্লেষ প্রয়োগে তিনি নিজেই দায়িত্ব নেন। ‘ঢেঙ্গা বাবু ’ ‘গাজীর টাংকি’ ... ইত্যাদি, কালের তাৎক্ষণিক পথবার্তা তার লেখা থেকে বাদ পড়ে না। তিনি নিজের সম্পর্কে নিশ্চিত বলেই বলতে পারেন-‘মানুষের মুখ দেখা আমার কৌতুহল এবং আগ্রহের বিষয়। রাস্তায় বের হলে অথবা কোথাও কোন কাজে যেখানে যাই সুযোগ পেলে নারী অথবা পুরুষ, তাদের মুখ অবলোকন করি, অবশ্য কাউকে বিব্রত না করে।’(দ্রষ্টব্যঃ গল্প, বিছানা কান্দিতে এখন আর কেউ কাঁন্দে না)
আনোয়ারুল হক তাঁর গল্পের শরীরে তাঁর শহরকে সরাসরি উল্লেখ করেন। কোথাও অন্য নামের আশ্রয় নেননি। তিনি কর্মসূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ছিলেন। তিনি স্থানিক নাম সমূহ বিকৃত করেন না। যদিও এরুপ কোন স্বতসিদ্ধ নিয়ম নেই। তবু বলতে হয়, তাতে গল্পের ভূগোল পাঠকের চিনতে সুবিধা হয়। চরিত্র সমূহের সঙ্গে পাঠক একাত্মতাবোধ করেন।
বিশ্ব যখন বাজার বা বাজার যখন আজ বিশ্ব তখন আনোয়ারুল হক সহজ সরলভাবে বাজরে ঢুকে যান। গল্পের জন্য ঢুকেন। ‘সারমেয় সমাচার’ এবং‘ না মানুষ’ গল্পের ভূমি বাজার। বাজার সম্পর্কে ভালো মন্দের ধর্মীয় নিষেধও তিনি তাঁর গল্পে স্থান দেন।  ভিক্টোরিয়া কলেজ রোড, জিলা স্কুল রোড, নিউ মার্কেট, মোগলটুলি ইত্যাদি তাঁর স্মৃতির আসকারায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি তাঁর শহরের ইতিহাস ও প্রত্নচিহ্ন গল্পের বাঁকে বাঁকে বসিয়ে দেন।
অনোয়ারুল হক দেখেন, চারদিক দেখেন। কেমন দেখেন, পরখ করা যাক। জমিনের সকল শস্য দেখার দরকার নেই। একটি কী দুটি শস্য করতলে নেয়া যাক। ‘না মানুষ’ গল্পের জগতমোহন চক্রবর্তী কুমিল্লা জিলা স্কুলের নামকরা জনপ্রিয় প-িত স্যার। মনিরুল জগতমোহনের ছাত্র। মনিরুল একদিন তার নানার নিকট জানতে চেয়েছিল- ‘ জ্বিন দেখা যায় কি না?’ নানা বলেছিল -‘ যারা খারাপ কাজ করে তারা দেখতে পায় না।’ মনিরুল জ্বিন দেখবেই। সে শাহ সুজা মসজিদের আজানের মিম্বরের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। জ্বিন তাকে দেখতেই হবে। একদিন মনিরুলের হিসু পায়। মনিরুল হিসুর চাপ সামলাতে পারে না। হিসু খালাস করতে গিয়ে মনিরুল অদৃশ্য চড় খায়। বেহুশ হওয়ার আগে মনিরুল খনখনে গলা শুনতে পায়, কে যেনো বলে ‘বেতমিজ’। ‘তারপর দিন চারেক প্রবল জ্বর, প্রলাপ বকা, খাওয়ার অরুচি, ভয় পাওয়া ইত্যাদি সেরে যখন মনিরুল সুস্থ হলো তখন তাকে ঠিক সুস্থ বলা গেলো না।’
এবার তো থামতে হবে। আনোয়রুল হকের জমিনের শস্য কতটুকু পাকা দেখতে হলে পার্শ্ববর্তী জমিনের প্রতি দৃষ্টি যাবে এ কথা অবান্তর নয়।
দুটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। প্রথমটি  শৈবাল মিত্রের ‘রহস্যের নাম মরা ইঁদুর’। দ্বিতীয়টি ‘একজন সরকারি কেরানীর মৃত্যু’ ( দ্য ডেথ অফ আ গভর্নমেন্ট কার্ক ), লেখক আন্তন চেকভ। তিনটি গল্পে তিনজন মৃত্যুবরণ করে।
আনোয়ারুল হকের গল্পে মৃত্যুবরণ করে জগতমোহন চক্রবর্তী। শৈবাল মিত্রের গল্পে মৃত্যুবরণ করে কিশোরী পাল। আন্তন চেকভের গল্পে মৃত্যুবরণ করে ইভান দিমিত্রিচ। একজন শিক্ষক, একজন ময়রা, একজন কেরানী।
ছাত্র মনিরুল জগতমোহনের শরীরের উপর পতিত হয়ে যে অপরাধ করে এর জন্য বারবার ক্ষমা চায় । ক্ষমা চাইতে চাইতে মনিরুল শিক্ষক জগতমোহনকে অতিষ্ট করে ফেলে। অতিষ্ট শিক্ষক মনিরুলের হাত থেকে রক্ষা পেতে আত্মহত্যা করে। অথচ  চেকভের  গল্পের কেরানী মরে হাঁচির অপরাধে ক্ষমা চাইতে চাইতে। ময়রা কিশোরী পাল মরে মিষ্টির বারকোসে ইঁদুর মরলে, মানসিক চাপে। আনোয়রুল হক বিষয়টিকে একবারে ওল্টো স্থাপন করলেন। তিন ভূবনের তিন বাসিন্দা। আনোয়ারুল হক এগিয়ে রইলেন বদলে ফেলার অভিনবত্বে।
জীবনে  লুকিয়ে থাকে বিপুল সারপ্রাইজ - অ্যবসার্ডিটি। তিনটি গল্প পাশাপাশি পাঠ করলে পৃথক এক আনোয়ারুল হককে  ভাবতে হয়।
জগতমোহনের চাকরি পাওয়া অংশটির বর্ণনা সামাণ্য খাটো হলে গল্পটি ঋজু এবং টানটান হতো - এ কথার পরও নিশ্চিত বলা যায় এ গল্প অন্য এক ধী সম্পন্ন কথা সাহিত্যিককে চিনতে আগ্রহী করে তোলে। ‘না মানুষ’ গল্পটি ‘প্রেমজ’  গ্রন্থের সঙ্গী হয়ে এর অন্য উজ্জ্বল মুখখানি  প্রেমজ পোষাকে আবৃত হয়ে রইলো।
আরও একটি গল্পের কথা বলে শেষ করবো। গল্প ‘অসুখের কথা’, এ গল্পে কোন এক অপরিচিতার সহবস্থান বা পার্শ্ববর্তী অবস্থান ভাষাকে করেছে গতিময়, পাঠকের আগ্রহকে করেছে তীব্র। ভাষার সৌন্দির্যে থেকেই তিনি মধ্যবিত্ত মনোজগতের দ্বিধান্বিত রসায়নের বর্ণনা দেন আপন কণ্ঠে। তিনি বলেন, ‘ নিজেকে সামলে স্বাভাবিক থাকার জন্যই এক সময় আমি ভাবতে শুরু করলাম, অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। দুই কন্যার পিতা গৃহী মানুষ। ইজ্জত হারানোর ভয়  আমাদের সবচেয়ে বেশি কাবু করে যায় সারা জীবন। লোক চক্ষুর আড়ালে পরনারীতে আসক্তি আমাদের চাপা থাকে না। অন্যের পরকীয়া চর্চা চায়ের টেবিলে  আমাদের প্রচুর আনন্দ দেয়।’
এ শুধু লেখকের একার অবস্থা কি? তিনি তো ‘ আমাদের’ শব্দটি ব্যবহার করে জানান দিয়েছেন, এ পুলক, এ রিরংসা, মোহন আনন্দের দ্বার খুলে আমরা কেউ কাউকে দেখাই না। নারীর সান্নিধ্য সম্পর্কে এ গল্পে তিনি প্রায় চ্যালেঞ্জ করেন -‘আমি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব আমার ভালো লাগছে না?’
নিজের প্রতি এমন চ্যালেঞ্জ যিনি দিতে পারেন তিনিই অধিকার রাখেন মানব মানবীর চিরায়ত সম্পর্ক বর্ণনার। এমনভাবে বলতে গিয়ে ব্যক্তি আনোয়ারুল হক এবং শিল্পী আনোয়ারুল হককে গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনায় নিমজ্জন হতে পারে পাঠকের। এই মনোটোনাস থেকে মুক্তির উপায় শিল্পী আনোয়ারুল হককে মনে রেখে তাঁর গল্প পাঠ করা ।  

গল্পকার আনোয়ারুলহক চেনা জীবনের রূপকার

রবিবাসীয়......হালিম আবদুল্লাহ||
আনোয়ারুল হক এমন এক জীবনের গল্প বলেন যে জীবন তাঁর ও আমাদের। যাপনের সুখ-দুঃখ, সামাজিক বিন্যাস  ও টানাপোড়ন, প্রেম ও অপ্রেম সব এসে তাঁর শিল্প চেতনায় জড়ো হয়। যাকে বলি মানুষের জীবন আনোয়ারুল হক সে জীবনকে আরও জীবন্ত করে তোলেন।
দুর্বোধ্যতা তাঁর নেই। তথাকথিত আধুনিক সাহিত্য রীতির কলা-কৌশল তাঁর শিল্প ভাবনাকে ভারাক্রান্ত করে না। তিনি সরল কথাটি সরল ভাবেই বলেন। সবচেয়ে দুর্গম যে মানুষের মন, সেখানেও বাস করে আরেক সরল জীবন। আনোয়ারুল হক সেই সরলতাকেই তাঁর শিল্পের উপজীব্য করেন।
তাঁর গল্পের চরিত্ররা রক্ত-মাংসের। কোরবানির হাটে গরু বিক্রি করতে আসা কিশোরি ও তার বাবা, মাঝরাতে পুলিশের হাতে আটক হওয়া নিরপরাধ মধ্যবিত্ত, টাউন হলে নাটক দেখতে আসা তরুণি সকলেই যেন আমাদের ঘরের মানুষ। তাদের জীবনাচরণ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, তাদের আতঙ্ক ও মুক্তির আনন্দ আমাদের অভিজ্ঞতাকে অতিক্রম করে যায় না। চেনা জীবনের কথা চেনা ভাষাতেই তিনি তরতর করে বলে যান।
ইতোমধ্যে বাংলা ছোটগল্পে অনেক ধারা-উপধারার জন্ম হয়েছে। রবীন্দ্র রীতিকে অতিক্রম করে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। অনেক সার্থক রীতির প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পশ্চিমের নানান তত্ত্ব ও নিরীক্ষা আমাদের ছোট গল্পকে কখনো পরিপুষ্ট করেছে, কখনো পুষ্টিহীন মেদের জন্ম দিয়েছে। গল্প বলার ধরন, নতুন নতুন জীবন ভাষ্য আমাদের ভাবনা জগতকে তাড়িত করেছে। মানুষের পরিবর্তিত জীবন অভিজ্ঞতা গল্পে ঠাঁই পেয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভৌগোলিক সংঘাত, সামাজিক বৈষম্য, জীবনের ভাঙন গল্পের বিষয় বস্তু হয়েছে। সবচে  যে বড়ো হয়ে উঠেছে মানুষের জীবন ও জীবন অভিজ্ঞতা। মানুষই একমাত্র আন্তর্জাতিক। আনোয়ারুল হক তাঁর গল্পে সেই আন্তর্জাতিকতার বয়ান দেন। মানব জীবনকে বিশ^ নিরীখে ধরতে চান। প্রেম, ঘৃণা, লালসা, হতাশা মানব বৈশিষ্ট্যের অনিবার্য উপাচার। আনোয়ারুল হক এইসব মানবাচার নিয়ে গল্পের ডালা সাজান।
তাঁর একটা গল্প নিয়ে কিছু বলা যাক। গল্পের নাম ‘পিংপং।’ অন্তর্জালিক সামাজিক বাস্তবতায় খেই হারানো মানুষের চিরকালীন মূল্যবোধে ফিরে যাওয়ার গল্প ‘পিংপং।’ নামেই চমৎকারিত্ব, অস্থিরতার আভাস। বিভ্রান্ত এই সময়ে এক ডাক্তারের বিপথগামীতা, সেই ডাক্তারের স্ত্রীর সঙ্গে সাব্বির নামে এক যুবকের অন্তর্জালিক অনৈতিকতা - সর্বোপরি এক সামাজিক মনোবৈকল্য গল্পটিকে বাস্তবতা দিয়েছে। ডাক্তারের চেম্বারে এসে ডাক্তারের স্ত্রীকেই সাব্বির তার রোগের কারণ বলে উল্লেখ করে। সাব্বিরের মোবাইলে ডাক্তার তাঁর স্ত্রীর নগ্নছবি দেখতে পান। সেই সব ছবিতে আছে সাব্বিরের জন্য অনৈতিক যৌন আমন্ত্রণ, বহুগামী স্বামীর প্রতি এক হতাশাগ্রস্ত নারীর আত্মঘাতী প্রতিশোধ আকাক্সক্ষা। ডাক্তার সাব্বিরকে বিয়ে করার নিদান দেন, স্ত্রীর কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য নিজে আকুল হয়ে ওঠেন। এই যে ফিরে আসার আকুলতা, ভাঙনের বিপক্ষে অবস্থান তাতে গল্পকারের মনোজগতটির আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি চান সত্য ও সুন্দর টিকে থাকুক। কেদ  ও হতাশার পথ অতিক্রম করে মানুষ পুনর্বার তার মনুষ্যত্বে ফিরে আসুক। আনোয়ারুল হক মনুষ্যত্বের জয় চান, তাই মানুষের ভিতরের সুন্দর মানুষটাকে খুঁজে বেড়ান। শুভ ও সুন্দরের পথেই তাঁর পরিযায়ন।
‘প্রেমজ’ ( আগষ্ট ২০১৭, কুমিল্লার কাগজ প্রকাশনী, কুমিল্লা )ও ‘ফুলকন্যা’ ( ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ঐতিহ্য, ঢাকা ) আনোয়ারুল হকের দুটি গল্প সংকলন। ‘প্রেমজ’তে গল্পআছে আটাশটি, ‘ফুলকন্যা’তে ষোলোটি। আনোয়ারুল হক তাঁর নিজস্ব ভাষা শৈলীতে গল্পগুলোকে  সাজিয়েছেন। কোথাও কোনো মেদ নেই। সরল ভাষায় তিনি কেবল গল্প বলে যান। গল্পই দর্শন হয়ে ওঠে, গল্পতেই কাল ও সমাজ এসে ধরা দেয়।
“নিরীক্ষার চাইতে জীবনের ঐশ^র্যই আনোয়ারুল হকের গল্পে বেশি ঠাঁই পেয়েছে। তাঁর গল্পের চরিত্র গুলো পাঠককে একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়  ঠিকই, কিন্তু গল্প শেষে  ঘটনা আর একমুখী থাকে  না - আরও কোন দিকে বিচরণ করতে পারত - সেই সম্ভাব্য ঘটনাগুচ্ছ মৃদুভাবে  হাতছানি দেয়। সে কারণে পড়তে পড়তে পাঠক মূল গল্পের মধ্যে থেকেই নিজের গল্প গেঁথে গেঁথে এগুতে থাকবেন। এই আবহ পাঠককে  তাঁর সাহিত্য মেজাজে  বিচরণের ক্ষেত্রটিকে  আরও প্রসারিত করে।
আনোয়ারুল হক সমকালীন বিষয়ের গল্পেও মানুষের চিরকালীন প্রবৃত্তিকেই চিহ্নিত করতে চেয়েছেন - যে কারণে তাঁর গল্পগুলো শুধু ঘটনায় আটকে �