আবুল কাসেম ফজলুল হক ।।
বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতির জন্য ভাষিক উন্নতি অপরিহার্য। ভাষিক উন্নতির সঙ্গে যুক্ত থাকে চিন্তাগত ও জ্ঞানগত উন্নতি। চিন্তা ও জ্ঞানকে কোনোক্রমেই ভাষা থেকে আলাদা করা যায় না। জাতীয় জীবনে আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির ভিত্তি তৈরি হয় চিন্তাগত, জ্ঞানগত ও ভাষাগত উন্নতি দ্বারা।
এখন বাংলাদেশে ভাষিক বাস্তবতা এমন যে এখানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার গুরুত্ব এবং বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পে যাঁরাই কিছু বলতে কিংবা করতে যান তাঁদেরই সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলো থেকে ও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক মহল থেকে অভিহিত করা হয় ইংরেজিবিরোধী বলে। ইংরেজির উপযোগিতা ও বাংলার অনুপযোগিতা সম্পর্কে বলা হয় অনেক কথা। বাংলাকে খাড়া করা হয় ইংরেজির প্রতিপ রূপে। বাংলা ভাষার উন্নতির প্রতি বাংলাদেশের সব বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের ও ইংরেজি জানা লোকদের প্রচ্ছন্ন দৃষ্টি দরকার। বাংলাদেশে ইংরেজিকে দেখতে হবে বাংলার অপরিহার্য সম্পূরক রূপে। বাংলার সম্পূরক আরো কিছু ভাষা ছিল ও আছে। যেমন—আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ইত্যাদি। সব জীবন্ত ভাষাই অপরাপর ভাষা থেকে শব্দ, রীতি, ভাব ও চিন্তা গ্রহণ করে বিকাশশীল থাকে।
ইংরেজি ভাষার রয়েছে সুবিশাল জ্ঞানভা-ার। ইংরেজি অবশ্যই আমাদের ভালো করে শিখতে হবে। ইংরেজি ভাষার প্রগতিশীল মহান জ্ঞানভা-ারকে ব্যবহার করার যোগ্যতা আমাদের অর্জন করতে হবে। ইংরেজির মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারা বাংলা ভাষার জ্ঞানভা-ারকে সমৃদ্ধ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পাশ্চাত্য প্রযুক্তি গ্রহণের জন্যও ইংরেজি অপরিহার্য। তবে বাংলাদেশের সব নাগরিককেই সমভাবে ইংরেজি শিখতে হবে, তা নয়। বাংলাদেশে ইংরেজি শেখার এবং ইংরেজির মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণের আরো উন্নত ব্যবস্থা আমরা চাই। আমার ধারণা, শুধু কা-জ্ঞানহীনরাই ইংরেজির বিরোধিতা করতে পারে।
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ইংরেজি প্রথম ভাষা। ভারতে মনে হয় ইংরেজি ভাষা রাষ্ট্রভাষার ও প্রাদেশিক ভাষাগুলোর ওপরে স্থান নিয়ে আছে। তবে সেখানে রাষ্ট্রভাষা ও প্রাদেশিক ভাষাগুলোও বিকাশমান আছে। দণি আফ্রিকা ও তানজানিয়ায়ও ইংরেজি রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষা। এই কটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশেই ইংরেজি প্রথম ভাষার কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষার স্থান নিয়ে নেই। এই দেশগুলোতে ইংরেজির অবস্থা এক রকম নয়, এবং এক রকম হবেও না। ইংরেজি ব্যবহারকারী জাতিগুলোর মধ্যেও উন্নত-অনুন্নত আছে। ইংরেজি নিলেই কোনো জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যে সৃষ্টিশীল ও উন্নত হয়—এ কথা একটুও ঠিক নয়। ইংরেজি গ্রহণ করলেই কোনো জাতি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত হয়ে যাবে—এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। যে ইংরেজি বিশ্বগ্রাসী তা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ইংরেজি। যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যকে যতই ছাড়িয়ে যাচ্ছে, দুই রাষ্ট্রের ইংরেজিতে ততই পার্থক্য ঘটছে। এই দেশগুলোতে আদিবাসীদের কিংবা ুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর আলাদা ভাষাও আছে। সেসব ভাষা বিকাশশীল নয়। সেগুলো বিলীয়মান ভাষার তালিকাভুক্ত। ুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে রাখা হয়েছে দুর্গত অবস্থায়।
বাংলাদেশে ইংরেজির পাশাপাশি আরো কিছু বিদেশি ভাষা শেখার ব্যবস্থাকে বাস্তবসম্মত ও উন্নত করতে হবে। গোটা শিাব্যবস্থাকে আমূল সংস্কারের দ্বারা উন্নত করতে হবে। আমাদের দেখা দরকার ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও দণি আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর ভাষানীতি। তলিয়ে দেখা দরকার, ইংরেজি এত উন্নত ভাষা হওয়া সত্ত্বেও কেন তারা তাদের রাষ্ট্রভাষা ত্যাগ করে ইংরেজি গ্রহণ করছে না। দেখা দরকার, কিভাবে তারা ইংরেজির সমস্যার সমাধান করছে। এসব দেশের কোনোটিতেই সব শিার্থীকে ইংরেজি কিংবা অন্য কোনো বিদেশি ভাষা শেখানো হয় না। তাদের অভিজ্ঞতা দেখলে আমাদের বুদ্ধি জাগতে পারে। আমরা কোনোটার অনুকরণ করব না; তবে অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকেও শিা গ্রহণ করে আমরা আমাদের উন্নতির পথ প্রশস্ত করব।
একটু অনুসন্ধান করলেই দেখা যায়, প্রতিটি উন্নত জাতি নিজের রাষ্ট্রভাষার সর্বাঙ্গীণ উন্নতিতে অত্যন্ত যতœবান। নিজেদের রাষ্ট্রভাষার উন্নতির সঙ্গে তারা তাদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উন্নতিকে এক করে দেখে। নিজেদের রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে গোটা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যতœবান যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। তারা পৃথিবীর সব ভাষা থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তত্ত্ব-তথ্য আহরণ করে ইংরেজি ভাষাকে সমৃদ্ধ করে আসছে। তাদের দেশে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকার নানা ভাষা শেখার ও নানা বিষয় শেখার ভালো ব্যবস্থা আছে। প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার উন্নতির জন্য আমাদের সচেতন ও যতœবান হওয়া দরকার। বাংলাদেশে বাংলা ভাষার প্রয়োজন অন্য কোনো ভাষা দিয়েই মিটবে না। সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য অবশ্যই বাংলা ভাষাকে আমাদের উন্নত করে চলতে হবে। উন্নতির কোনো সংপ্তি উপায় নেই। ইংরেজির পাশে আরো অন্তত পাঁচ-সাতটা বিদেশি ভাষা ভালো রূপে শেখার ব্যবস্থা বাংলাদেশে করতে হবে। একালে পৃথিবীর সব দেশেই উচ্চ শিতি লোকরা নিজেদের ভাষার অতিরিক্ত অন্তত একটি ভাষা শেখে এবং জাতীয় প্রয়োজনে সে ভাষাকেও কাজে লাগায়।
বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য অবশ্যই নানা ভাষা থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তত্ত্ব-তথ্য আহরণ করতে হবে। বাংলা আমাদের প্রথম ভাষা এবং বাংলাই আমাদের অস্তিত্বের ও উন্নতির মূল অবলম্বন। বাংলা ভাষা আমাদের উৎপাদন, সৃষ্টি ও জীবনযাত্রার কেন্দ্রীয় অবলম্বন। শিা, চিন্তা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের উন্নতির সবচেয়ে মূল অবলম্বন ভাষা—যেকোনো ভাষা নয়, আজন্মলালিত ভাষা, বিকাশশীল মাতৃভাষা। অন্য ভাষারও গুরুত্ব আছে, তবে সেগুলোর স্থান বিকাশকালীন মাতৃভাষার পরে।
বিকাশশীল ভাষা ও বিলীয়মান ভাষার মধ্যে পার্থক্য আছে। বাংলাদেশে আমরা বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রা করব আর বিকাশশীল বাংলা ভাষাকে বিলীয়মান মাতৃভাষায় পরিণত করব—এটা কি কোনো সুষ্ঠু নীতি হতে পারে? বিলীয়মান ভাষাগুলোকে কতটা রা করা যাবে? সেগুলোর উন্নতি কতটা সম্ভব?
বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ছাড়াও আছে ৪৫টি ুদ্র জনগোষ্ঠীর পাঁচটি মাতৃভাষা। এই ৪৫টি ুদ্র জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের সামান্য বেশি। আবার কিছু লোকের মধ্যে আছে উর্দু ভাষা। আরবি, সংস্কৃত ও পালি ভাষার সঙ্গে রয়েছে ধর্মীয় অনুষঙ্গ। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও জাতিসংঘের প্রভাবে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রয়োজনে বাংলাদেশে অনেক জায়গায় কার্যকর রয়েছে শুধু ইংরেজি ভাষা। বাংলাদেশের যে নাগরিকরা বাংলাভাষী নন, অথচ বাংলাদেশে বাস করেন, তাঁরাও বাংলা শেখেন, শিখতে বাধ্য হন। ুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর শিশুরা জন্মের পর থেকেই তাদের ভাষা ও বাংলা ভাষা দুটিই শেখে। তাদের বলা যায় দ্বিভাষিক। তাদের ভাষা বিকাশশীল নয়, বিলীয়মান ভাষারূপে তালিকাভুক্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে শিার মাধ্যম হিসেবে বাংলা বাদ দিয়ে শুধু তাদের গোষ্ঠীগত ভাষায় যদি তাদের শিার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাহলে কি তাদের উন্নতির সুযোগ বাড়বে? আমাদের মতে, ‘জাতিসংঘের আদিবাসী নীতি’ সম্পূর্ণ ভুল। বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রা করা যাবে না। এ কাজে ইউনেসকোর আয়োজন অবশ্যই সফল হবে না। আদিবাসীদের চিরকালের জন্য আদিবাসী করে রাখা কিংবা আদিবাসীদের চিরকাল আদিবাসী রূপে রাখা একটুও উচিত নয়। তাদের মানবজাতির মূল ধারায় আসতে দিতে হবে। তাদের উন্নতির অফুরন্ত সম্ভাবনা আছে। উন্নতি করতে হলে তাদের অবশ্যই মানবজাতির মূলধারায় আনতে হবে। যে রাষ্ট্রে তারা বসবাস করে, সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা তাদের শিখতে হবে। তাদের চলা উচিত মূলত নিজেদের বুদ্ধিতে, শুধু এনজিও ও সুধীসমাজ-সংগঠনের পরামর্শ অনুযায়ী নয়। তারা যদি শামুকের মতো, ঝিনুকের মতো নিজেদেরকে নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ রাখে তাহলে তারা উন্নতি করতে পারবে না। বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রা করার জন্য, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাগুলোকে রা করার জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আয়োজন সফল হবে না। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট দিয়ে কোনো সুফল হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে শত শত বছর ধরে প্রচলিত আদিবাসী নীতি ন্যায়সংগত নয়। প্রান্তিক ুদ্র জনগোষ্ঠীগুলো যাতে বঞ্চিত না হয়, প্রতারিত না হয়, তার জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রের সরকারকে ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ন্যায়সংগত নীতি অবলম্বন করতে হবে।
১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করার পর থেকে দেখা যাচ্ছে সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলোর বিশিষ্ট নাগরিকরা ও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা বাংলা ভাষার প্রতি উদাসীন এবং বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলো রা করার কাজে তৎপর। নানা কৌশলে দেশবাসীকে তাঁরা ধারণা দিচ্ছেন যে বাংলা শুধু গান, কবিতা, নাটক ও গল্প-উপন্যাসের ভাষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য বাংলা ভাষা উপযোগী নয়। সরকার ইংলিশ ভার্সন চালু করেছে। বিচার বিভাগের উচ্চ পর্যায়ে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। এসব দেখে মনে হয়, রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষা সংবিধানে স্বীকৃতি পেলেও বাস্তবে সরকার ক্রমে ইংরেজির দিকে চলে যাচ্ছে। অন্ধ ইংরেজিপ্রীতি ও বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞার ভাবও অনেকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। এসব শুভ লণ নয়। বাংলা যথেষ্ট উন্নত ভাষা। দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়, এমন ২০০ ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান উৎকর্ষ বিচারে এখনো ওপরের দিকেই আছে। এই ভাষাকে ছেড়ে, রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা না করে ইংরেজির দিকে যাত্রা তিকর হচ্ছে। বাংলাই আমাদের প্রথম ভাষা, রাষ্ট্রভাষা। ইংরেজি আমাদের দ্বিতীয় ভাষা। ইংরেজি শিখতে হবে। বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞাযোগ্য মনে করে ইংরেজির দিকে যাওয়া কল্যাণকর হবে না। বাংলা ভাষার উন্নতি সাধনে আমাদের মনোযোগী থাকতে হবে। প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিচার বিভাগে, উচ্চশিায়, গবেষণায়, ব্যাংকিংয়ে বাংলা চালু করতে হবে।
লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, আহমদ শরীফ অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়