শিক্ষা সাধনায় আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)
Published : Friday, 12 February, 2021 at 12:00 AM
মুফতি ইবরাহিম সুলতান । ।
হিজরি পঞ্চম শতাব্দীর ধর্মীয় আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)। অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত এই আলোর সারথী ৪৭১ হিজরি মোতাবেক ১০৭৮ খ্রিস্টাব্দে কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণে অবস্থিত জিলান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। তারপর উচ্চশিক্ষা লাভে ৪৮৮ হিজরিতে সে সময়ের বিদ্যানগরী বাগদাদ গমন করেন। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি একাধিক বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন।
বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ইতিহাসবিদ হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, ‘তাফসির, হাদিস, ফিকহসহ আবদুল কাদের জিলানি ছিলেন তেরোটি শাস্ত্রে পারদর্শী।’
উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) যখন বাগদাদে গমন করেন, তখন তাঁর মা মাত্র ৪০ দিনার হাতে তুলে দেন। অল্পদিনেই সে অর্থ ফুরিয়ে গেলে তীব্র অর্থসংকটে দিন কাটাতে থাকেন তিনি। এমনকি মাঝেমধ্যে ক্ষুধার যন্ত্রণায় তিনি নদীর তীরে বেরিয়ে পড়তেন। সেখানে বিভিন্ন গাছের পাতা, পড়ে থাকা ফলের খোসা এবং কাঁটাযুক্ত একপ্রকারের সবজি খেয়ে দিন কাটাতেন।
একবার বাগদাদে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে টানা কয়েক দিন তিনি নদীর তীরে খাদ্য সংগ্রহে দিন কাটাতে থাকেন। কষ্টের সেই দিনগুলোর বর্ণনা তিনি এভাবে ব্যক্ত করেন, ‘দুর্ভিক্ষের সময় খাবারের আশায় আমি একবার নদীর তীরে বের হলাম। কিন্তু অনেকেই দেখি সেদিন আমার আগে চলে এসেছে। গাছের পাতা ও ফলের খোসাসহ খাদ্য জাতীয় যা কিছুই সামনে পাচ্ছে তা সংগ্রহ করছে। কিন্তু সংকোচে সেদিন আমি কিছুই সংগ্রহ করতে পারিনি। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা আবর্জনা থেকে কিছু কুড়াতে গেলে সেখানেও অনেকের ভিড় জমে যেত। ফলে উপায় না দেখে শূন্য হাতেই বাগদাদ নগরীর রায়হানিন বাজারের ‘ইয়াসিন মসজিদে’ গিয়ে আমি উঠি। ক্ষুধার যন্ত্রণা, ক্লান্তি আর শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে মসজিদের এককোণে বসে পড়ি। সে সময় আমার কাছে মনে হয়েছিল আমি যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছি। ঠিক এমন সময় অনারব এক যুবক মসজিদে প্রবেশ করল। তার সঙ্গে ছিল রুটি আর গোশত। সে এক কোণে বসে খেতে শুরু করল। নিজের কাছে খুব লজ্জা লাগল যে সে যখনই লোকমা মুখে উঠাত নিজের অজান্তেই আমি হাঁ করে ফেলতাম। তখন নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললাম, এ কী করছি আমি! যুবক ছেলেটি আমার এসব কা- লক্ষ্য করে কাছে এসে বলল, ভাই, বিসমিল্লাহ একটু নাও। আমি অস্বীকৃতি জানালাম। সে খুব জোর দিয়ে আল্লাহর নামে কসম করে বলল, নাও ভাই! আমার মন এতে রাজি হলেও পরক্ষণেই আমি আবার মনের বিরোধিতা করি। তখন সে আবারও কসম দিয়ে বলল, ভাই, দাওয়াত কবুল করো। সব শেষে আমি তার দাওয়াত গ্রহণ করি।
খাবারের মাঝে সে আমার পরিচয় জানতে জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কী? তুমি কোত্থেকে এসেছ? বললাম, আমি ফিকহ শাস্ত্রের একজন তালিবুল ইলম। জিলান থেকে এসেছি। সে বলল, আমিও জিলান থেকে এসেছি। আচ্ছা, তুমি কি আবদুল কাদের নামে কোনো জিলানি যুবককে চেনো? বাবার নাম আবু আবদুল্লাহ সাওমায়ি। জবাবে বললাম, আমিই তো সে যুবক। এ কথা শুনে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। সে বলল, আল্লাহর শপথ, আমি বাগদাদে এসেছি তোমার কাছে। কিছু অর্থ দিয়ে তোমার মা আমাকে পাঠিয়েছেন। তোমার সম্পর্কে আমি অনেককেই জিজ্ঞাসা করেছি। কিন্তু কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেনি। এই তিন দিন হলো, আমার নিজের খরচের অর্থও শেষ হয়ে গেছে। ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রণায় তোমার মায়ের দেওয়া আমানত খরচ করতে শুরু করেছি। এই রুটি গোশত সেই অর্থেই কেনা। তুমি আমার প্রতি দয়া করো, তৃপ্তির সঙ্গে খাও। এ খাবার তোমারই। আমি তোমার মেহমান। খাওয়ার শুরুতে যেমন তুমি ছিলে আমার মেহমান। আর আমার অনন্যোপায় অবস্থা বিবেচনা করে তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি তাকে শান্ত করলাম। এরপর অবশিষ্ট খাবার আর কিছু অর্থ দিয়ে তাকে বিদায় জানালাম। (যাইলু তাবাকাতিল হানাবিলা ২/২০৩-২০৪)