আপন আলোয়ে মাতৃভাষা ও ইসলাম
Published : Friday, 12 February, 2021 at 12:00 AM
গাজী মুহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির । ।
ভাষা আন্দোলন আর শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা পায়। ১৯৫২ সালে সালাম, বরকত, রফিক আর শফিউরের রক্তে ভেজা একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রাণের ভাষার ভাষা রক্ষা পেয়েছিল, যা পক্ষান্তরে ধর্ম তথা ইসলামও সমর্থন করে এবং উৎসাহ যোগায়। দেশ, মাটি ও ধর্মকে ভালবাসা প্রতিটি মানুষের নৈতিক ও ঈমানী দায়িত্ব। সুতরাং আপন আলোয়ে নিজের ভাষা, দেশ ও ধর্মকে ভালবাসা দেশের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। ভাষা হচ্ছে মানুষের আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা প্রকাশের বাহন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘খালাকাল ইনসানা আল্লামাহুল বায়ান’- তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ‘বয়ান’ শিখিয়েছেন। বাংলা আমাদের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা, রাষ্ট্রভাষা। এ ভাষার জন্য লড়াই করতে হয়েছিল ৬৯ বছর আগে। তাই ৫২’র ভাষা আন্দোলন জাতীয় ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়।
বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে ইসলামি মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হলে বাংলা ভাষায় পারদর্শিতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। দ্বীন প্রচারে বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক নবী-রাসূলকে তার জনগোষ্ঠীর ভাষায় সুপ-িত করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে পরিষ্কার করে বুঝাতে পারে’ (সূরা ইবরাহিম : ৪)।
সব ভাষাই মহান আল্লাহর সৃষ্ট ও তার নিদর্শন। ইসলামের কোনো পরিভাষা নেই। যে ভাষাতেই ইসলাম প্রবেশ করেছে সে ভাষাকে আপন করে নিয়েছে। ইসলামি ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ সে ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। সে ভাষায় সৃষ্টি করেছে সাহিত্য।
পৃথিবীতে যেমন নানা দেশ রয়েছে, তেমনি রয়েছে নানা জাতি, গোত্র, বর্ণ, ধর্ম ও ভাষা। এ পৃথিবীতে যত প্রাণী রয়েছে প্রত্যেকের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। এমনকি একই ভাষাভাষী মানুষের কণ্ঠস্বর, উচ্চারণভঙ্গি পৃথক। এটি সম্পূর্ণ আল্লাহতায়ালার কুদরতের নিদর্শন। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, আর তাঁরই (কুদরতের) অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে নভোম-ল ও ভূম-ল সৃষ্টি এবং পৃথক পৃথক হওয়া তোমাদের ভাষা ও বর্ণের। নিশ্চয় এতে (কুদরতের) নিদর্শনগুলো রয়েছে জ্ঞানবানদের জন্য (সূরা রূম : ২২)।
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে তার দেশের ভাষা প্রিয় ও মধুর। মাতৃভাষা বাংলা আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। কারণ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলে আনন্দ ও তৃপ্তি পাই। তা ছাড়া মাতৃভাষা বাংলা আজ আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে।
আল্লাহতায়ালা হলেন অন্তর্যামী, আমরা যে ভাষাতেই তাঁকে ডাকি না কেন তাতে তিনি সাড়া দেবেন। কালামে পাকে রয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন (সূরা বাক্বারা : ১৮২)’, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সব শোনেন, সব দেখেন (সূরা মুজাদালাহ : ১)’, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পূর্ণরূপে জানেন (তোমাদের) অন্তরের কথাও (সূরা মায়িদাহ : ৭)’।
হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত রাসূলদের আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে পাঠিয়ে মানুষকে হেদায়েতের জন্য যে ১০৪টি আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন তা প্রত্যেক রাসূলের কওমের ভাষায় নাজিল করা হয়েছে। প্রধান ৪টি আসমানি কিতাবের মধ্যে হজরত মূসা (আ.)-এর ওপর নাজিলকৃত তাওরাত লেখা হয় সুরয়ানি (হিব্রু) ভাষায় এবং সর্বশেষ মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল হয় হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর ওপর আরবি ভাষায়।
আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি সব রাসূলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই পাঠিয়েছি, যাতে তাদের (পরিষ্কারভাবে আল্লাহর হুকুমগুলো) বুঝাতে পারে (সূরা ইবরাহিম : ৪)’। কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবি এবং যাদের প্রথম এ গ্রন্থ বোঝানো হয়েছে তাদের ভাষা ছিল আরবি। আল্লাহতায়ালার ঘোষণা- ‘আমি একে নাজিল করেছি কোরআনরূপে আরবি ভাষায় যেন (আরবি ভাষা হওয়ার কারণে প্রথমে) তোমরা বুঝতে পার (সূরা ইউসুফ : ২)।
অতএব, পবিত্র কোরআনের আলোকে বোঝা যায়, পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষ সৃষ্টিগত সমান। অর্থাৎ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, বংশ ও ভাষা নিয়ে গর্ব করার কিছুই নেই। এগুলোর বিভক্তি শুধু পরিচয়ের জন্য। তবে আল্লাহর কাছে ওই ব্যক্তিই উত্তম যে ইমানদার, সৎকর্মশীল ও পরহেজগার।
আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবজাতি আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ আদম (আ.) এবং একজন নারী হাওয়া (আ.) থেকে (এ দিক দিয়ে তোমরা সবাই সমান) আর তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা একে-অপরকে চিনতে পার। বস্তুত, আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাশীল সে ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পরহেজগার’ (সূরা হুজরাত : ১৩)।
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিজেদের বাঙালি জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতি ভেবে, উর্দুকে শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবে মনে করে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ভাষা ‘বাংলা ভাষা’ তুচ্ছ করে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার অপপ্রয়াস চালায়। যার ফলে বাঙালি জাতি সেদিন এ জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন) বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
তাদের মধ্যে রফিক, বরকত, জব্বার সালামসহ আরও অনেক ছিলেন। পবিত্র কোরআন ও হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে- ‘তোমরা অন্যায়ভাবে কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা কর না, কারও ওপর অত্যাচার ও জুলুম কর না, আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না’।
এ দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে ভাষা ও স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু আফসোসের বিষয় আজও দেশের ভাষা বাংলা প্রচলিত হয়নি। ফেব্রুয়ারি এলে আমরা বকধার্মিকের মতো বাংলা ভাষার প্রেমিক বনে যাই। দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাকে উপেক্ষা করে ইংরেজিকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং বাংলাকে ইংরেজি এবং হিন্দির সঙ্গে মিলিয়ে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
যে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে এ জাতির বীর সন্তানরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছিল, সে মাতৃভাষা বাংলাকে এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ভালো লক্ষণ নয়। আমাদের সবাইকে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে আরও সচেতন ও যতœশীল হতে হবে।
যে কোনো সমাজের ঐতিহ্য, মেধা এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ ও লালনে ভাষা এক সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। অথচ অযতœ ও অবহেলায় বহু ভাষা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে এবং বহু ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে। ইউনেস্কোর এ ঘোষণা শুধু ‘অমর একুশের’ স্বীকৃতি নয় বরং পুরো পৃথিবীর সব জাতির মাতৃভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্তে অনেক ভাষা রক্ষা পাবে এবং বৃদ্ধি পাবে মাতৃভাষার মর্যাদা।
মাতৃভাষার লালন ও বিকাশের মাধ্যমেই মানবজীবনের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব, যা পক্ষান্তরে দেশ, সমাজ ও বিশ্বের জন্য সামগ্রিক কল্যাণই বয়ে আনবে। এ মুহূর্তে দেশের বিজ্ঞ ইসলামি জ্ঞানে সুপ-িত বিদগ্ধ লেখক সৃষ্টি করে সুস্থ সাহিত্য নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে ইসলামি চিন্তাবিদ ও আলেম সমাজকে। যারা নবীর উত্তরসূরি তাদের তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকার সময় নেই। আসুন প্রাণের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করি এবং ইসলামি সাহিত্য সৃষ্টি করে আগামী প্রজন্মের জন্য অবদান রেখে যাই।
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, প্রাবন্ধিক , সংগঠক ও চেয়ারম্যান- গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা।