
মযহারুল ইসলাম বাবলা ||
একমাত্র ধর্মীয়
ঐক্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একই রাষ্ট্রের বৃত্তে টিকিয়ে রাখা সম্ভব
হবে না বলেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ ঢাকায় এসে
রেসকোর্স ও কার্জন হলে ঘোষণা দিয়েছিলেন- পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা
হবে উর্দু। অর্থাৎ উর্দু ভাষা বা সংস্কৃতির বলয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকে বিলীন
করা সম্ভব হলেই পাকিস্তানের দুই অংশের অখ- ঐক্য স্থায়ীকরণ সম্ভব হবে।
বাঙালিকে উর্দু ভাষা-সংস্কৃতির বৃত্তে আবদ্ধ করা সম্ভব হলেই দুই হাজার
মাইলের ব্যবধানের বিচ্ছিন্নতার স্থায়ী অবসান ঘটবে। বাস্তবে সেটি হয়নি। যা
হয়েছে, তা-ই ছিল নিগূঢ় বাস্তবতা। একমাত্র ধর্মীয় বিভাজনে ভারত ভাগে
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম নিয়ে যারা আগাম বার্তা দিয়েছিলেন, ইতিহাসে তাদের
বার্তা সঠিক বলেই প্রমাণিত। পাকিস্তান সৃষ্টির বহু আগে থেকে জিন্নাহর
অপরিণামদর্শী রাজনীতির বিরুদ্ধে বিচণতার পরিচয় দিয়েছিলেন বিশিষ্ট কিছু
বাঙালি ব্যক্তিত্ব।
১৯৪৭ সালের ১৭ জুলাই হায়দরাবাদে মুসলিম লীগ রাজনীতিক
চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.
জিয়াউদ্দীন প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন- 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।'
১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকায় পৃথক দুটি সমাবেশে জিন্নাহর ঘোষণার পূর্বেই উর্দুর
পে বক্তব্য প্রদান করেন প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ। বাংলা ভাষাকে
হিন্দুদের ভাষা বলে তা মুসলমানদের জগৎ পরিত্যাজ্য, এমন বক্তব্যও প্রকাশ্যে
তারা দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষার পে দৃঢ় অবস্থান নেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্সহ
অনেকে। ড. জিয়াউদ্দীনের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন ড. মুহম্মদ
শহীদুল্লাহ্। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পে যারা দৃঢ়তর অবস্থান গ্রহণ
করেছিলেন, তাদের মধ্যে পথিকৃৎ প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক আবদুল হক। ১৯৪৭ সালের
জুন থেকে আগস্ট মাসে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় বেনামে 'বাংলা ভাষাবিষয়ক
প্রস্তাব', 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা', 'উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে', 'পূর্ব
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' প্রবন্ধ লিখেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর
পাকিস্তানের বাঙালি শিামন্ত্রী ফজলুর রহমান ১৯৪৯ সালে আরবি বর্ণমালায় বাংলা
লেখার পে জোর প্রচারণা চালিয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে আবদুল হক 'আরবি হরফে
বাংলা' নামক তির্যক নিবন্ধ লিখেছিলেন। ওই নিবন্ধ ২০ মার্চ ১৯৪৯ সালে দৈনিক
ইত্তেহাদে প্রকাশিত হয়েছিল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই বাংলা ভাষা,
সাহিত্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছিলেন পাকিস্তানপন্থি কয়েকজন
বুদ্ধিজীবী। তার সুফল যে তারা অর্জন করতে পারেননি। বাঙালি মুসলমান তার
জাতীয়তা পরিত্যাগ করে সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে প্রধান করে তুলেছিল বলেই
পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একাংশে পরিণত হয়েছিল। বাংলা ও বাঙালি জাতিসত্তার
বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির ক্রমাগত চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি
পুনরায় জাতিসত্তার চেতনা ফিরে পায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের
মধ্য দিয়ে। লেখক, দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বদরুদ্দীন উমর যথার্থই
বলেছিলেন, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি 'বাঙালি মুসলমানদের স্বদেশ
প্রত্যাবর্তন'। কংগ্রেস রাজনীতিক মওলানা আবুল কালাম আজাদও ১৯৪৬ সালে
বলেছিলেন, 'পাকিস্তান না পাওয়া পর্যন্ত কোনো যুক্তি মুসলমানের কানে ঢুকবে
না।' তার কথাটি সত্যে প্রমাণিত হতে বেশি সময় লাগেনি। ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে
মওলানা আজাদ সাংবাদিক সোরুস কাশ্মীরিকে সাাৎকারে বলেছিলেন, 'কিন্তু এ দাবির
(পাকিস্তান দাবি) আমি অন্তর্নিহিত বিপদ দেখতে পাচ্ছি। ...আরেকটি
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মি. জিন্নাহর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে বঙ্গদেশ।
তিনি জানেন না- বঙ্গদেশ বাইরের কোনো নেতৃত্ব মেনে নেয় না। আজ কিংবা কাল
তারা সে নেতৃত্ব অস্বীকার করবে। আমি মনে করি, পূর্ব পাকিস্তানের পে পশ্চিম
পাকিস্তানের সঙ্গে বহুদিন একসঙ্গে থাকা মোটেই সম্ভব নয়। এই দুই ভূখ-ে ধর্ম
ছাড়া আর কোনো বাঁধন নেই। আমরা মুসলমান- এই মর্মে কোথাও স্থায়ী রাজনৈতিক
ঐক্য গড়ে ওঠেনি।' মওলানা আজাদের কথা সেদিন দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিষাক্ত
হাওয়ায় কেউ কানে তোলেনি। মওলানা আজাদের মতো অনেকেই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ
নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। আবদুল গাফফার খাঁ, হুমায়ুন কবীরসহ আরও অনেকে
বলেছিলেন, দেশভাগ মুসলমানদের জন্য এক মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। তারা
বারংবার সাবধানবাণী উচ্চারণও করেছিলেন।
ধর্ম পরিবর্তন সহজ এবং মানুষের
পে এই পরিবর্তন তাৎণিক ব্যাপার মাত্র। কিন্তু জাতীয়তা পরিবর্তন কেবল অসহজই
নয়, অসম্ভবও। তাই জাতীয়তার ভিত্তি অধিক শক্তিশালী এবং স্থায়ীও বটে। বিজাতীয়
সংস্কৃতির বলয়ে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতিবান জাতির সংস্কৃতিকে সহজে পরাভূত করা
যায় না। এই সত্য কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না- ধর্ম পরিবর্তন করা সহজ
হলেও সংস্কৃতির বিনাশ ঘটানো যায় না। এর প্রমাণ আমাদের সামনেই রয়েছে। বাঙালি
সংস্কৃতির শক্তি কতটা প্রবল, তা নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণের প্রয়োজন
রাখে না। মওলানা আবুল কালাম আজাদ বাংলা-বাঙালিকে যথার্থই চিনতে ও বুঝতে
পেরেছিলেন বলেই দার্শনিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মন্তব্যটি করেছিলেন- 'বঙ্গদেশ
বাইরের নেতৃত্ব মেনে নেয় না। ক্রমেই বহিরাগত নেতৃত্ব অস্বীকার করবে।'
বাঙালি জাতি নিজেদের জাতীয়তা রায় সর্বোচ্চ ত্যাগের ইতিহাস গড়েছে, যেটি
বিশ্বে বিরল ঘটনারূপেই প্রতীয়মান। বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব-বীরত্ব ইতিহাসের নানা
েেত্র প্রমাণিত। ধর্মের বাতাবরণে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা-অহংকার
নির্মূল করা যায়নি এবং যাবেও না।
নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত