
এম হাফিজ উদ্দিন খান ||
অনস্বীকার্য
যে, করোনাদুর্যোগ প্রায় গোটা বিশ্বে এক ভিন্ন সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি
করেছে। আমাদের দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও
কিছু দেশে জনজীবন এখনও স্বাভাবিক হয়নি। আমরা যখন নানা েেত্র আশা ও অগ্রগতির
কথা শুনছিলাম, তখনই এই দুর্যোগ সবকিছু থমকে দিল। করোনা সংক্রমণ বিশ্বে
নানা খাতে যে আঘাত করেছে, তা পুরোপুরি সেরে উঠতে আরও সময় লাগবে। তবে এজন্য
নিজ নিজ েেত্র দরকার সমন্বিত প্রয়াস। আমাদের অনেক েেত্র সীমাবদ্ধতা আছে এবং
এর মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতি হলো বাড়তি উপসর্গ।
আমাদের সমাজে মনুষ্যসৃষ্ট
সমস্যা-সংকটও কম নয়। অগ্রগতির েেত্র প্রতিবন্ধক নানা রকম নেতিবাচকতার
সৃষ্টি হচ্ছে অসাধু-দুর্নীতিবাজদের কারণে। করোনাদুর্যোগকালে অনেক েেত্রই
আমরা অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতার নানা উৎকট চিত্র দেখতে পেয়েছি
সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে। এসব নেতিবাচক কর্মকা- আমাদের অর্থনীতির জন্য বাড়তি
চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী, দুর্নীতিবাজ লুটপাটের মোম
সময় হিসেবে বেছে নেয় দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিকে। করোনাকালে তা-ই আমরা
দেখেছি। এই দুর্যোগেও প্রবাসী কর্মীরা আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান
রেখেছেন- এই সত্য এড়ানোর পথ নেই। আবার করোনাদুর্যোগে আমাদের কোনো কোনো
বৈদেশিক শ্রমবাজারও আক্রান্ত হয়েছে। অনেক প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরে আসতে
বাধ্য হয়েছেন। এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য দুঃসংবাদ। বৈদেশিক মুদ্রা
অর্জনকারী আরেকটি অন্যতম ত্রে তৈরি পোশাক খাত। করোনাকালে তাদেরও পড়তে হয়েছে
ব্যাপক তির মুখে।
এর মধ্যেই কথা হয় জিডিপি নিয়ে। প্রথমেই বলতে চাই,
জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নয়নের একমাত্র মাপকাঠি নয়। বাংলাদেশ
পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) নিকট অতীতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে সাময়িক
হিসাব দিয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান
বলেছিল, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে অর্থবছরের শেষ দিকে তিন মাসে
অর্থনীতির ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং এর আগে থেকে কিছু সূচকের যে
দুর্বলতা ছিল, তাতে মোট দেশজ উৎপাদন বা প্রবৃদ্ধির ল্যমাত্রা অর্জন হওয়া
কঠিন। দুর্যোগকালে আমদানি-রপ্তানির সীমাবদ্ধতাসহ অর্থনীতির নানা েেত্র
বৈরী পরিস্থিতির যে ছায়া প্রলম্বিত হয়, প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য
কোনোভাবেই কাঙ্তি নয়। এমন তথ্য শুধু ভুল বার্তার পরিসরই বিস্তৃত করবে না,
এর আরও নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে পারে।
করোনাদুর্যোগে শিল্প খাতে উৎপাদন,
নির্মাণ খাতে স্থবিরতা, পর্যটন খাতে বিরূপতা, পরিবহন খাতসহ অর্থনীতি ও
মানুষের জীবন-জীবিকায় প্রত্য অবদান রাখে এমন আরও কিছু খাত সংকটময়
পরিস্থিতিতে পড়েছিল। এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ কেটে গেছে, তা বলা যাবে না।
বেসরকারি খাত আমাদের কর্মসংস্থানের অন্যতম ত্রে। এই খাত করোনার আঘাতে অনেক
বেশি তিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি প্রণোদনায় বেসরকারি খাত ধাক্কা কিছুটা সামাল
দিতে পারলেও ত শুকাতে সময় লাগবে। কর্মসংস্থানের ত্রে এ খাতে অনেকটাই
সংকুচিত হয়ে গেছে। এ খাতে বিশেষ নজর দিতে হবে কর্মসংস্থান বাড়াতে। যারা
কর্মহীন হয়েছেন, তাদের কাজে ফেরানোর জোরদার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। করোনার
কারণে বিদায়ী অর্থবছরের শেষ প্রায় চার মাস একমাত্র কৃষি খাত ছাড়া অন্য খাতে
অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায় স্থবিরই ছিল। কাগজে-কলমে হিসাবের চিত্র স্ম্ফীত
করে লাভ কী, যদি বাস্তবে এর সুফল পাওয়া না যায়?
অনেক কিছু বাড়িয়ে বলার
একটা অপপ্রবণতা আমাদের আছে- এ রকম অভিযোগ নতুন নয়। এও সত্য, আমাদের
অর্থনীতি গত অর্থবছরের প্রথম দিকে অনেকটাই ভালো করেছে। আমরা জানি,
পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন। এ েেত্র পরিসংখ্যান
ব্যুরোকে তাদের কথা মান্য করে চলতে হয়। হয়তো পরিসংখ্যানের েেত্র এ জন্যই
কারসাজির যে অভিযোগটা ওঠে, তা সর্বাংশে অসত্য নয়। তবে অসত্য পরিসংখ্যানের
কারসাজির সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে না।
রাজনৈতিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা রকম ইতিবাচক কথা সরকারি তরফে বলা
হলেও তা সাধারণ মানুষের কল্যাণে কতটা আসবে- এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই খুব
স্বাভাবিক। আমাদের নীতিনির্ধারকরা কেন পরিসংখ্যানগত ভুলের বৃত্তে ঢুকবেন
শুধু নিজেদের রাজনৈতিক সিদ্ধির আশায়?
আমরা সর্বাবস্থায়ই এটা বিবেচনায়
রাখব- মানুষের জীবনযাত্রায় কতটা স্বস্তি, শান্তি নিশ্চিত হলো। জনঅধিকার,
যেমন- স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের
আয়ত্তে কতটা এলো। আয়বৈষম্য কতটা দূর হলো, এটাও অবশ্যই অন্যতম বিবেচ্য।
বৈষম্য আমাদের সমাজে অন্যতম উপসর্গ হয়ে আছে। ওপরতলা-নিচতলার পার্থক্যের
বিষয়টি আমাদের বহু েেত্রই দৃষ্টিকটুভাবে এখনও দৃশ্যমান। এেেত্র বিশেষ নজর
শুধু নয়, আয়বৈষম্য নিরসনে কার্যকর পদপে নিতে হবে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত
আলোচনা-পর্যালোচনা কম হয়নি বটে, কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই দৃশ্যমান নয়।
সবকিছু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিবেচনা করলে
সবার জন্য সুফল নিশ্চিত হবে না। স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক
অধিকারের বিষয়ে করোনাদুর্যোগে নতুন করে অনেক কিছুই উন্মোচিত হয়েছে, যা
একেবারেই অনাকাঙ্তি-অনভিপ্রেত।
সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ও
গতিশীল করতে নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে এগোতে হবে। আত্মকর্মসংস্থানের ওপর জোর
দিতে হবে। মানুষ যাতে আত্মকর্মসংস্থানমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে- এ জন্য
পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা দরকার। শিল্প খাতের পাশে সরকারকে আরও পরিকল্পিত
কর্মপরিকল্পনা নিয়ে দাঁড়াতে হবে। উৎপাদনের চাকা করোনা-পরবর্তী প্রোপটে
অধিকতর গতিশীল করতে জরুরি দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনা। বিদেশে কর্মসংস্থানের
ব্যাপারে নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। যেসব দেশ করোনাদুর্যোগ কাটিয়ে ঘুরে
দাঁড়িয়েছে, সেসব দেশের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি সিঙ্গাপুর
আমাদের দেশ থেকে কর্মী নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দুষ্টচক্রের কারণে যাতে
তা ভ-ুল না হয়, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা চাই। আমাদের আরও গভীরভাবে নজর দিতে
হবে কৃষি খাতের দিকে। কৃষি খাতের সব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আরও দূরদর্শী
উদ্যোগ ও সহায়তামূলক কর্মসূচি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কৃষি খাত
করোনাদুর্যোগে অনেক বড় অবদান রেখেছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতেও
জোরদার উদ্যোগ দরকার।
চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, দণি কোরিয়াসহ বেশকিছু
দেশ অর্থনৈতিক তি সামলে উঠতে সফলতা দেখিয়েছে। আমাদের অন্যতম ব্যাধি
দুর্নীতির ব্যাপারে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। নির্মোহ অবস্থান নিয়ে
যথাযথ প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সমাজের স্তরে স্তরে দুর্নীতির যে
অপছায়া পড়েছে, তা যদি অপসারণ করা না যায় তাহলে কোনো উন্নয়নই অর্থবহ কিংবা
টেকসই হবে না। অর্থনীতির চাকা গতিশীল করতে বড় শিল্পের পাশাপাশি মাঝারি,
ুদ্র কিংবা অতি ুদ্র খাতগুলোর দিকে সরকারে দৃষ্টি আরও নিবিড় করতে হবে নতুন
পরিকল্পনা নিয়ে। মাঝারি, ুদ্র কিংবা অতিুদ্র খাতগুলোও কর্মসংস্থানের সুযোগ
সৃষ্টি করে। এসব খাত আবার যাতে চাঙ্গা হয় এবং মানুষ যাতে সেসব েেত্র কর্মে
ফের যুক্ত হতে পারে, এ প্রচেষ্টা দরকার। এই খাতগুলোর জন্য নীতিমালা সহজ
কিংবা নতুন নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়টিও সমগুরুত্ব দিয়েই ভাবতে হবে। তরুণ
উদ্যোক্তাদের নিয়ে আমরা সম্ভাবনার আলো জ্বালাতে পারি। তাদের নানা েেত্র
ভালো করার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে। উদ্যোক্তা যত বাড়াবেন, কর্মত্রেও
ততই সম্প্রসারিত হবে- এটাই স্বাভাবিক। দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থের কথা ভেবে
এবং সেই নিরিখেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণ
ঘটলে এর ইতিবাচক প্রভাব হবে লণীয়। এখন পর্যন্ত বেসরকারি খাতই কর্মসংস্থানের
বড় ত্রে। এই েেত্রর পরিসর আরও বাড়লেই মঙ্গল।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা