
যে অভাব পূরণ হবে না
--------------------------আলহাজ্ব ওমর ফারুক ||
৫২
তে ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম। জাকির ভাই (মরহুম জাকির হোসেন) ছাত্র ইউনিয়নের
প্রেসিডেন্টও ছিলেন, সেক্রেটারিও ছিলেন। পাকিস্তান আমল থেকেই ন্যাপ ছিল।
জাকির ভাই প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন পরে ন্যাপ করেন। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আমি এবং
জাকির ভাই ন্যাপে আসি। পরে আমি ছাত্র ইউনিয়নে চলে যাই। জাকির ভাই ন্যাপে
থেকে যান। মূল কথা আমি এবং জাকির ভাই সারাক্ষণ ছাত্র ইউনিয়নের কাজ করতাম।
৬৫ সাল থেকে ছাত্র ইউনিয়ন খুবই শক্তিশালী এবং রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
৬৯-এর গণআন্দোলনে জাকির ভাই ১১ দফার আন্দোলন করতে গিয়ে জেল খাটেন।
অন্যান্যদের সঙ্গে জাকির ভাইও ২০/২৫ দিন জেলে ছিলেন। তাদের মুক্তির জন্য
মাইনুল হুদা ভাই তৎকালীন ডিসির পুরনো অফিসের বারান্দায় আমরণ অনশন করেন। পরে
তারা মুক্তি পান। জাকির ভাই ন্যাপের বিভিন্ন পদে ছিলেন। ন্যাপের জয়েন্ট
সেক্রেটারি, সাধারণ সম্পাদক, পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রের প্রেসিডিয়াম নেতা
হিসাবে মৃত্যুবরণ করে। জাকির ভাই পুরো সময় রাজনীতি করতেন। জাকির ভাই একজন
ভালো সংগঠক ছিলেন। তাঁর কোন কাজে আলেসেমী ছিল না। খেয়ে না খেয়ে কাজ করতেন।
তখনতো চাঁদা দেয়ার লোকজন ছিল না।
আমার মনে পড়ছে, এডভোকেট আফজল খানের
পরের বারই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে আমাদের পার্টি কেবিনেট পায় (ভোটে পাস
করে), এ ধারা অব্যাহত ছিল। প্রথমবার সহ সভাপতি মোস্তফা কামাল (ফুলু ভাই),
পরের কেবিনেটে সহ সভাপতি আবু তালেব (সিলেটে কমিশনার পদে, চাকরি শেষ করেন)
পরের কেবিনেটে আমি সহ সভাপতি এবং জিএস মাসুদুর রহমান (প্রয়াত)। জাকির ভাইসহ
আমরা ৬২ তে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলি। ৬৬ তে ছয়
দফায় অংশগ্রহণ করি। ৬৯ এ ১১ দফা আন্দোলনে আয়ূববিরোধী কর্মসূচিতে আমি ছিলাম
বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার আহবায়ক, জাকির ভাই ছিলেন আহবায়ক কমিটির নেতা। ৭০ এর
নির্বাচনে আমরা (জাকির ভাই এবং আমি) অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদের পক্ষে কাজ
করি। মোজাফ্ফর আহমেদের মার্কা ছিল কুঁড়ে ঘর। নির্বাচনী এলাকা ছিল চান্দিনা
(দক্ষিণ) এবং দেবিদ্বার। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাকির ভাই ছিল প্রথম ব্যাচে।
আমি দ্বিতীয় ব্যাচে। জাকির ভাই প্রশিক্ষণ নেয় আসামের তেজপুরে। সোনামুড়ার
তামসা বাড়িতে যুদ্ধে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে অভ্যর্থনা রিক্রোটিং অফিসের কাজ
চলতো। আমি দ্বিতীয় ব্যাচে যাই। আমি যুদ্ধ করি চৌদ্দগ্রামে বেতিয়াড়ায়
কুমিল্লার কমা-ার হিসেবে। জাকির ভাই যুদ্ধ করেন দেবিদ্বার-জাফরাবাদ,
এলাহাবাদ অঞ্চলে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের কাজ ছিল মানুষকে সাহায্য
করা, ঘর-বাড়ি তৈরি করা, মেরামত করা। ব্যক্তিগত উদ্যোগ বা ব্যক্তিগত ভূমিকায়
কোন কাজ করতাম না। আমাদের সকল কাজ ছিল যৌথ। হয়তো কেউ কাজ বেশি করেছেন কেউ
কম করেছেন কিন্তু সকল কাজ যৌথভাবে করা হয়েছে। ন্যাপ-কমিউনিস্ট, আমাদের
মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব ছিল না। আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতাম- ফলে আমাদের
মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব ছিল না। আমি তো জীবনের এ পর্যায়ে এসে আওয়ামীলীগ করছি।
কিন্তু আমাদের মধ্যে, জাকির ভাই এবং আমার মধ্যে একটুও বন্ধুত্ব নষ্ট হয়নি।
বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার কোন প্রশ্ন উঠেনি। আমাদের সম্পর্ক গভীর ছিল। বিশ্বাস
এবং আস্থার জায়গা মজবুত ছিল।
আমাদের মধ্যে আড্ডা হতো বই কেন্দ্রিক।
একটা বইকে পাঁচ ভাগ করে পাঁচজনে নিতাম। প্রথম ভাগ পড়ে প্রথম জন আলোচনা
করতো। তারপর দ্বিতীয় তৃতীয় এভাবে আলোচনা চলতো। আমাদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা
নিয়ে আড্ডা মারার সময় হতো না। সমাজ পরিবর্তনের বিষয় নিয়ে আমরা ভাবতাম।
এখনো সেইসব বিষয় নাড়া দেয়।
জাকির ভাই বিয়ে করলো শেষ বয়সে। জাকির ভাই যে
কখনো বিয়ে করবেন আমরা কল্পনাও করিনি। আমি জাকির ভাইয়ের বিয়েতে কালো স্যুট
পড়ে গিয়েছিলাম। বিয়েটা হয়েছিল মতিঝিল রঁদেভু-সুন্দরম হোটেলে। এখন সেই হোটেল
আছে কি না জানি না। বিয়েতে মন্ত্রী আকবর হোসেন উপস্থিত হয়েছিলেন। আকবর
হোসেন জাকির ভাইকে বলেছিলেন- তুই তাহলে বিয়েটা করলি।
সেই সব কথা আমি বলে
শেষ করতে পারবো না। জাকির ভাই নেই আমি ভাবতে পারি না। আমার সঙ্গে জাকির
ভাইয়ের দেখা হতো। অসুস্থকালে টেলিফোনে কথা হতো। শেষেতো খুব বেশি অসুস্থ
ছিলেন। কথাবার্তা হতো না। আমাদের সঙ্গে যারা ছিল তাদের অনেকে আজ নেই। তাদের
মধ্যে সৈয়দ আহমাদ বাকের, অধ্যাপক দেলোয়ার, নীলিমা পাল, ফরিদ ভাই, আবুল ফজল
মানিক, শিউলী, নজির ভাই, মাসুদুর রহমান, মিথিল বানু, রাজু ভাই, কাজী মমতাজ
উদ্দিনসহ অনেক নেই। আজ তারা কেউ নেই- আমি বেঁচে আছি।
জাকির ভাইয়ের অভাব
পূরণ হবে না। তিনি মানুষের জন্য ভাবতেন নিজের জন্য ভাবতেন না। জাকির
ভাইয়ের মতো মানুষ জন্ম নিক। জাকির ভাইয়ের আদর্শ অনুসরণ করুক। মানুষের মধ্যে
সততা থাকুক-মানুষ সততা নিয়ে বড় হোক- এ আমার কামনা।
সৎ আদর্শবান জাকির হোসেন১৯৬৮ সনে যখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া
কলেজে ভর্তি হই তখন ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। ইপসু- ইস্ট পাকিস্তান
স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সদস্য হিসাবে প্রথম জাকির হোসেনের সাথে পরিচয়। তখন তিনি
কেতার দুরস্ত কোট টাই পড়া ভদ্রলোক কোটবাড়ী পলিটেকনিকেলের ছাত্র। জেলা
ছাত্র ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক। পরবর্তীতে ১৯৬৯-৭০ এ তিনি ছাত্র ইউনিয়নের
সভাপতি হন। আমাদের ০৩ বছরের বড়। রাজনীতি করতে যেয়ে প্রথমেই কোটবাড়ী পড়ার
পাঠ চুকিয়ে ফেলেন। সাথে সাথে চলে যায় তার কেতার দুরস্ত পোশাক। এক হাফ শার্ট
পেন্ট পড়ে কাটিয়ে দেন বছর। খদ্দরের প্রচলনের পর পায়জামা ও পাঞ্জাবি ছিলো
তার নিত্য দিনের সঙ্গি। আলাপ হতে হতে আত্মীয় পরিচয় প্রকাশ পেল। তার মামা
আমার চাচাতো বোনের স্বামী। তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমরা উভয় উভয়কে মামা
বলে ডাকতাম। যে দু’বছর ছাত্রজীবনে তাকে পেয়েছি সে সময় তাকে দেখেছি একজন
সৎ, কর্মঠ, অমায়িক নেতা হিসাবে। ১৯৬৮-৬৯ ভিক্টোরিয়া কলেজ সংসদ ছিলো ছাত্র
ইউনিয়নের দখলে। যদিও তিনি কলেজের ছাত্র না হওয়ার সুবাদে সংসদে ছিলেন না,
কিন্তু কলেজ নির্বাচনে তার ভূমিকা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মতো
নেতাদের কারণে তখন ছাত্র রাজনীতি কলুষ মুক্ত থাকতে পেরেছিলো। ১৯৭০-এ আমি
কুমিল্লার বাইরে চলে যাই। ফিরি ১ যুগ পড়ে ১৯৮২তে। এসে মামাকে পাই ন্যাপ
সম্পাদক হিসেবে। মাঝে ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে দু’জনই একই সাথে ট্রেনিং নিয়ে
যুদ্ধ করি। তিনি ছিলেন ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনীর
জেলা ডেপুটি কমান্ডার। ১৯৮২ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাকে দেখেছি দৈন্যতাকে
হার মানিয়ে নিজ রাজনৈতিক আদর্শকে ধরে রাখতে। সাচ্ছন্দ্য কি তা কখনও বুঝতেই
পারেননি। কিন্তু বিপথে যাননি কখনও। একজন সৎ আদর্শবান সদা হাস্যময় জাকির
হোসেন বেচে থাকবেন চিরদিন আমাদের মাঝে। মহান আল্লাহ তায়লা তাকে উচ্চ
মর্যাদা দিবেন এই দোয়া করি।
ডাঃ আবু আয়ুব হামিদ
কুমিল্লা
স্মৃতিতে সততআহসানুল কবীর ||
২০
ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার কিছু পর বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এমন সময় হেলাল ভাই
এর ফোন জাকির ভাই আর নেই। কন্ঠ জুড়ে হাহাকার। সেই হাহাকার থেকে বিষণœতা
ছুঁয়ে গেল আমাকেও। একে একে নিভছে দেউটি। কাছের মানুষগুলো চলে যাচ্ছে এক এক
করে। মৃত্যুর মিছিলটি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
জাকির হোসেন আপাদমস্তক
একজন নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন। ছাত্র জীবনে সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে যুক্ত
হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে। ছাত্র রাজনীতির থেকেই গ্রহণ করেছেন ত্যাগের
ব্রত। দেশ মাতৃকার ডাকে জীবনের মায়া তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন
মহানমুক্তিযুদ্ধে। ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি -ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা
বাহিনীকে সংগঠিত করেছেন অসীম সাহসিকতায়। স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে
আত্মনিয়োগ করেছেন। নিজের জীবনের পুনর্গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেননি। অথচ
গল্পটি এমন হবার কথা ছিল না। বাবা এবং মা দুই সূত্রেই জাকির হোসেন একটি
সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। জাকির হোসেনের পূর্বপুরুষদের নিবাস
শহরের কোলঘেষে মায়াময় গ্রাম অরণ্যপুর এবং পৈতৃক নিবাস লাকসাম রোডের
প্রসিদ্ধ মাস্টার বাড়ি হলেও পিতা সরকারি কর্মকর্তা আলী হোসেনের বদলি জনিত
সরকারি চাকুরি সূত্রে তিনি মাগুরাতে জন্মগ্রহণ করেন। আলী হোসেন সার্কেল
অফিসার হিসাবে অবসরে যান। মায়ের পূর্বপুরুষ রহিমুদ্দিন মাস্টারের নামে
মাস্টার বাড়ি। পিতার কর্মসূত্রে কর্মস্থল মাগুরাতে জন্মগ্রহণ সেখানেই বেড়ে
উঠা, সেখানেই লেখাপড়া। ১৯৬৫ সালে এসএসসি পাশ করার পর চলে আসেন কুমিল্লাতে।
কুমিল্লা
আসার পর থেকেই মূলত রাজনীতির সাথে জাকির হোসেনের জড়িয়ে পড়া। এসময় তিনি
বামপন্থী ছাত্রনেতা আমিরুল ইসলামের (পরে বিচারপতি) সান্ন্যিধ্যে আসেন এবং
ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে যুক্তও হন। ততোদিনে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব
দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জাকির হোসেন মতিয়া চৌধুরী, সাইফউদ্দিন আহমেদ
চৌধুরী মানিকদের সাথেই তার রাজনীতির হাতেখড়ি নেন। জাকির হোসেনের মামা মো:
নুরুল্লাহ কুমিল্লার অন্যতম ভাষা সৈনিক এবং তমুদ্দন মজলিস ও জাতীয় লীগের
সাথে যুক্ত ছিলেন। আরেক মামা আবদুল্লা লেবু কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের
প্রতিষ্ঠাকালীন দফতর সম্পাদক। পরিবারের নিকটাত্মীয় মোসাদ্দেক খান আওয়ামী
লীগের দুর্দিনের সাথী। স্বাভাবিক ভাবেই একটি রাজনৈতিক পরিম-লের মাঝেই তার
বেড়ে উঠা। তার একাগ্রতা নিষ্ঠা আর সাংগঠনিক দক্ষতা অচিরেই তাকে সামনের
কাতারে নিয়ে আসে। স্বাধীনতার পূর্বেই নির্বাচিত হন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা
ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। তার সাথে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহমাদ বাকের। আজকের
প্রজন্ম চিন্তা করতে পারবেনা ছাত্র ইউনিয়ন সে সময় কত সুসংগঠিত এবং সুশৃংখল
সংগঠন ছিলো। মেধাবী ছাত্রদের সংগঠন ছিলো ছাত্র ইউনিয়ন।
আইয়ূব-ইয়াহিয়া
বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান প্রতিটি আন্দোলনে
জাকির হোসেনের ছিলো অনবদ্য ভূমিকা। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জীবনের মায়া
ত্যাগ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ
গেরিলা বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন অসীম সাহসিকতায়। দেশ স্বাধীন
হবার পর জাতি পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য
মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের চাকাকে
উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়া হলো। জাতির জীবনে নেমে আসলো ঘোর অমানিশা। আবারও
আন্ডারগ্রাউন্ড লাইফ।
কখনও জিয়ার গুন্ডা বাহিনী কখনও এরশাদের সামরিক
জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে।
দায়িত্ব পালন করেছেন ন্যাপের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির। ন্যাপের
প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্যু। অধ্যাপক মোজাফ্ফর
আহমদের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ ছিল অপরিসীম। ১৪ দলের যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব
পালন করেছেন অবিচল নিষ্ঠায়।
শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মকা-ের মাঝেই নিজের
জীবনকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। কুমিল্লা টাউন হল, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি শিল্পকলা
একাডেমী, এফপিএবি, ওল্ড ভিক্টোরিয়ান্স, খেলাঘর আসরসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের
সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষতার সাথে। আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ জাকির
হোসেন জীবন সাথী হিসাবেও বেছে নেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৈত্রীর
সাবেক ডাকসাইটের নেত্রী শরমীন কাদেরকে।
শরমীন কাদের সম্পর্কে নতুন করে
বলার কিছু নাই। তার নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ‘দৃষ্টি’র মাধ্যমে মানুষের
জন্য কাজ করেছেন নি:স্বার্থভাবে। তার অমায়িক ব্যবহার এবং বিপদের সময়ে পাশে
দাঁড়ানোর প্রবণতায় কুমিল্লার মানুষের মন জয় করেছেন খুব অল্প সময়ে। অর্থ
কিংবা পদ পদবীর লোভ তাকে টানেনি। সেগুলোর পেছনে ছুটেননি কোনদিন। মানুষের
কল্যাণকেই বেছে নিয়েছেন জীবনের ব্রত হিসাবে। টাউন হলে আমরা একসাথে কাজ
করেছি প্রায় পনের বছর। অসম্ভব আড্ডা প্রিয় মানুষ ছিলেন। হাসতে এবং হাসাতে
ভালোবাসতেন। পান এবং সিগারেট ছিলো তার নিত্যসঙ্গী। শেষের দিকে ডা. এর
নির্দেশনায় সেগুলোও ছাড়তে হয়েছিলো। সিনিয়রদের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ ছিল
প্রচ-। একটি ঘটনা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছিনা। এডভোকেট লতিফ সাহেব মারা
গেছেন। টাউন হলের নতুন সহ সভাপতি নির্বাচন হবে। হাবিব উল্যা চৌধুরী এবং
জাকির হোসেন দুজনেই মনে মনে প্রার্থী হতে চান। আমি দুজনেরই ঘনিষ্ঠ। দুজনের
সাথে মজা করি। সময় ঘনিয়ে আসে। টান টান উত্তেজনা। এরই মাঝে হাবিব উল্যা
চৌধুরী তার প্রার্থীতা ঘোষণা করলেন। সকলে ভাবলেন নির্বাচন অনিবার্য। সকলকে
অবাক করে দিয়ে তিনি আমাকে ডেকে বললেন হাবিব ভাই প্রার্থী হবার পর আমিতো
প্রার্থী হয়ে বেয়াদবি করতে পারিনা। তিনি আমার সিনিয়র। আমি প্রার্থী হব না। এ
ঘটনাটি আজকের দিনের রাজনীতিবিদদের জন্য একটি শিক্ষনীয় বিষয়। তিনি শিখিয়ে
গেছেন ভোগে সুখ নয় ত্যাগেই সুখ। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্যয়, রাজনৈতিক
ব্যবস্থার অবক্ষয় তাকে ব্যথিত করত প্রতিটা মুহূর্ত। তবে তিনি এও বিশ্বাস
করতেন একদিন পরিবর্তন আসবেই। রাজনীতি তার স্বাভাবিক গতিপথে থাকলে জাকির
হোসেনের মত মানুষেরাই এই জনপদকে নেতৃত্ব দিতেন। তবে এও সত্য যে নিকষ কালো
আঁধার ভেদ করেই একদিন রবির কিরণ উদিত হবে। জাকির হোসেন তখন থাকবেন না।
জীবনকে তিনি ভালোবেসেছেন। মানুষের প্রতি ছিল তার অপরিসীম মমত্ববোধ। রবি
ঠাকুরের ভাষায়-
‘এ বিশ্বরে ভালবাসিয়াছি।
এ ভালবাসাই সত্য, এ জন্মের দান।
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার”
জাকির ভাই: হাসির অন্তরালে অভিমান
ইকবাল আনেয়ার ||
'সুইট
হোম' ছিলো কুমিল্লার কফি হাউজ, শহর ও আশে পাশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতাক
নেতা কর্মীদের সেকেন্ড হোম। ছিলো সেটা কুমিল্লা টাউন হলের উল্টা দিকে।
সেখানে সকাল সন্ধ্যা আড্ডা না পিটলে ভাত হজম হতোনা।
সিলেট থেকে কুমিল্লা এসেই কোন মতে ব্যাগটা বাসায় রেখে সেখানে চলে যেতাম। আম্মা বলতেন- 'কী রে, হাত মুখ ধোয়ে খেয়ে যা।'
বলতাম- ' আম্মা, এসে খাবো।'
একদিন
সে আড্ডায় একজন মোটা মতো ভদ্রলোক আমায় জড়িয়ে ধরলেন। তাকে আমি চিনি। দুর
থেকে দেখেছি তাকে নানান মিছিলে, মিটিং এ, দেশ ও কৃষ্টি আন্দোলনের মশাল
মিছিলে। বাজখাই তার গলা, তাকে সমিহ করতাম, ভয়ও পেতাম কিছুটা।
তিনি আমাকে
'ডাক্তার সাব' বলেই তুমি সম্বোধনে আমার গুনপনা শুরু করলেন। দেখি যে আমার
সমন্ধে তার সবি জানা। আমার রাজনৈতিক সংযোগ ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সবই
জানেন তিনি। প্রথম আলাপেই ভয় কেটে গেলো। মনে হলো আমরা বোধ হয় জন্ম
জন্মান্তরের চেনা। সেই থেকে জাকির ভাই আমার বড় ভাই।
পুলিশ লাইন্সের
কাছে নিজের বাসায় উঠার আগে লাকশাম রোডে তার পৈত্রিক নিবাস, যেখানে তিনি
শেষ নিশ্বাস ফেলেছেন, তার বিপরীতে ভাড়া থাকতাম বহু বছর। তখন প্রতিদিন দুই
তিনবার করে তার বাসায়, তার ঘরে যেতে হতো। এটা এক পারিবারিক সম্পর্কে এসে
ঠেকলো। আর তিনি তার জীবনের যতো দুঃখ -দুর্দশা- আনন্দ- দর্শন - ঝড়- ঝান্ডা-
অভাবের কথা- সব বলতেন অবলিলায়, আমিও আমার যতো পীড়ন - দহন- সুখ- চিন্তা-
সংস্কৃতি ধারনা ; সবই বলতাম। একান্ত মনের কথা বলতাম। তিনি তা আমানত হিসাবে
রক্ষা করতেন। উপদেশ দিতেন।
তারপর তিনি বিয়ে করলেন। কিছুটা পরিনত বয়সে।
তার স্ত্রী শরমিন কাদের এক মহীয়সী নারী। প্রথম দিনই আমাকে আপান করে নেন।
দেখলাম, জাকির ভাই যোগ্য সাথী পেয়েছেন। তার জীবনে তখন একটা পরিপাটি ধরন
এলো। জাকির ভাইরা একান্নবর্তি পরিবারে বাস করেন। তার কামরাটা ভাবী এমন ভাবে
সাজালেন, যেনো সামান্যতে তার অসামান্য রূপ প্রকাশ পেলো। বাসায় গেলে ভাবী
একটা কিছু খেতে দিবেনই। আর ভাল কিছু রাঁধলে জাকির ভাইএর সাথে খেতে হবেই
আমাকে অনিবার্য্য ভাবে। নয়তো ভাবী রাগ করবেন। তার কোঠার লাগোয়া একটা টিনের
ছোট ঘর। তরজার বেড়া। সেখানটায় চৌকি পাতা। তার রাজনৈতিক সহকর্মি, সহযোদ্ধা,
যারা জীবন যৌবন সবি দান করেছেন, মানুষের কল্যানে, তারা এসে থাকেন -খান সেই
ঘরে। প্রায় নিয়মিত ভাবে থাকেন, প্রয়াত ন্যাপ নেতা অকৃতদার ফরিদ ভাই। ফরিদ
ভাইয়ের পুরো সংসারটা কালো চেইনঅলা একটা ব্যাগের মধ্যেই এটে যায়।
চলে সে
ঘরে আড্ডা। অনেকে আসেন, সন্ধ্যায়। আড্ডার বিষয় রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন-
মার্ক্সবাদ- দান্দিক দর্শন- মুক্তিযুদ্ধ ; সবই। আমিই কনিষ্ঠ। জানছি অনেক
কিছু। বলি, সামান্য যা জানি।
তারপর একদিন শরমিন কাদের চলে গেলেন পরপারে। জাকির ভাই আবার একা, উদ্ভ্রান্ত।
মো.
জাকির হোসেন। এক লাড়াকু সৈনিক। জীবন যুদ্ধে লাড়াকু সৈনিক। রাজনীতির মাঠে
লাড়াকু সৈনিক। দেশ ও দশের সেবায় লাড়াকু সৈনিক। অন্যায়ের সাথে আপোষ তিনি
করতে জানেন না। দাপট খাটিয়ে টেন্ডার দিয়ে কাজ পেতে তিনি তার ক্ষমতা প্রয়োগ
করতে লজ্জা পান, তার ইগোতে লাগে। অপকন্টেকটার তার কাজ নিয়ে যায়, তদবীর করে।
তিনি তদবীর করবেন কী ভাবে! তার অনুগামি, তার সাথী, বন্ধুর কাছে কী করে
তিনি বলবেন এসব?
মো. জাকির হোসেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ কালীন
ন্যাপ-কমিুনিষ্ট পার্ট- ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার। ছয়
দফা, উনসত্তরের গন আন্দোলন, এগারো দফা, সত্তোরের দেশ ও কৃষ্টি আন্দোলন,
তারপর আমাদের জাতির মহান ও প্রধান আন্দোলন; মুক্তিযুদ্ধ, সব কিছুতেই রয়েছে
তার সরব অংশগ্রহন। ছিলেন ন্যাপ কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর
বাংলাদেশের রাজনীতির উথাল পাতালের সময় যখন কিছু সুবিধাবাদীর জন্ম হয়, যখন
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে দেখিয়ে রেখে আস্তিনের তলায় সুবিধাবাদ,
ধান্দাবাজী, সম্পদ- টেন্ডারবাজী-দাপট- পরমিট - লাইসেন্স এসবেরের চাষ শুরু
হয়, তখন তিনি গড্ডালাকায় গা ভাসিয়ে দেননি। আদর্শকে বেচে দেননি। কমরেড
মোজাফফর আহমদের সাথে, ন্যাপের সাথে থেকেছেন আজীবন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে
ভালবেসেছেন, অন্তর থেকে।
সততা, সাহসিকতা, সহিষ্মুতা, সহমর্মিতা ছিলো তার জীবনের ভূষণ।
জীবন তার একটি কামড়ায়, তা তিনি ঘামে -রক্তে অর্থ কষ্টে অতিক্রম করেছেন আনন্দে।
যতদিন রথ ছিলো তার, ততদিন দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে রাজপথে থেকেছেন। সত্য বলেছেন। নানা সামাজিক কর্মকান্ডেও তাকে দেখেছি সরব থাকতে।
আমি
এবাদতে একটু অলস। দেখি কী, আজান দিতে দেরী নাই, জাকির ভাই রেডি। মসজিদ তার
ঘরের পেছনেই, একটি গলি পথ দিয়ে যেতে হয়। আমিও তার সাথে যাওয়া শুরু করি।
সেই ছোট অথচ গভীর আধ্যাতিক প্রেরনার স্মারক মসজিদটি আমায় ভিষণ টানে। সেখানে
নামাজ পড়তে আনন্দ। ইমাম সাহেব অতি সরল। মারপ্যাচের বক্তৃতায় তিনি নেই।
দেখি হালিম চাচা, জাকির ভাইএর সেজদার সৌন্দর্য; এভাবেই বুঝি ধীরে ও
একাগ্রতায় সালাত আদায় করতে হয়!
সমাজতন্ত্রে আর ধর্মে কোন বিরোধ নেই।
ধর্মের উদ্দেশ্য ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। এ সত্য জাকির ভাই দেখিয়ে
দিয়েছেন আমায়।তাকে অনুসরনের চেষ্টা করবো।
তিনি আমার কোন খোঁজ নেবেন না আর। আমি তার খোঁজ নেবো কী, আমারই খোঁজ নিতেন তিনি বরাবর।
জীবনের
শেষ ক'টা বছর রোগের সাথে লড়াই করে কেটেছে তার। বার বার হাসপাতালে গেছেন।
সারা দেশে তার ভক্ত ডাক্তাররা রয়েছেন। ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন এক পর্যায়ে এসে।
তখন হাটতে কষ্ট হয় তার। দাড়ি রেখেছেন, খাঁটি মুসল্লীর। ফ্যাকাশে দেহটাকে
টেনে নিয়ে যান তিনি, জেনারেল হাসপাতাল রোগী কল্যাণ সমিতির সভায়, নাটাবের
সভায়। দেখা হয় তার সাথে, অভিমান করে হেসে বলেন- 'খোঁজ তো রাখো না
ডাক্তার'।
টুটুল, তার ছোট ভাই, পরিবারের সবার বড় ভাই, ভাইজান তিনি।
টুটুল নলা করে খাওয়ায়। মুখে দিলে খেয়ে নেন, তবে কী খাচ্ছেন বুঝেন না। তখন
স্মৃতিভ্রমে চলে গেছেন তিনি , কখনো ফিরো আসেন মর্তে, সারাক্ষণ থাকেন,
প্রভুর সান্নিধ্যে।
ন্যাপের কুমিল্লার নেতারা, নানা মতে ভাগ হলেও তার
সাথে সে ভাগের সম্পর্ক নেই। তারা তাকে বসিয়ে সপ্তাহে অন্তত একবার মিলিত হন,
সম্মান দেখাতে তাদের এ আয়োজন। জাকির ভাই বসে থাকেন, নিরব দরবেশের মতো।
জাকির
ভাইয়ের অভিমানের কথা আমারই একান্ত উচ্চারণ। কেনোনা, তিনি তো কখনো বলেন
নি- 'এটা পাইনি, ওটা দিলোনা আমায়'। তার কাছে ছিলাম বলে, এ আমার বোধ থেকে
বলা।
জাকির ভাইদের মতো আদর্শের সৈনিকদের জাতি যদি আনুষ্ঠানিক সম্মান না
দেয়, তবে আর বর্তমানের কতক যুব সমাজের অপরাজনীতির ভ্রষ্টতায় বিলিন হওয়াকে
দোষ দেবো কি ভাবে! তারা কেমন করে বুঝবে, কারা আদর্শ, কারা নয়?
কুমিল্লার
একটি সংগঠন 'যৌথ খামার' ব্যানারে তার জীবনদশায়, তাকে সম্মান দেখিয়েছেন,
তার গায়ে পরিয়েছেন জাতীয় পতাকা, এটা অনেক বড়ো; ঘরের ছেলেকে ঘরের মানুষের
দেয়া সম্মান, কোনো পোশাকী মোড়কে নয়। এটা তিনি অনুভব করেছেন বলে মনে হয়েছে,
যদিও তখন তার বোধ অন্য জগতের পানে ধাবমান।
জাকির ভাই আমি ও আমরা অপরাধী,
আপনাকে মুল্যায়ন করতে পারিনাই। বরং আপনিই মূল্যায়ন করেছেন- সবার। যখন
যেখানেই পেয়েছেন, নিজেকে ছোট করে আমাদের প্রশংসা করেছেন। সভার পেছনে বসে
থেকেছেন। চেয়ারের লোভ করেন নি।
আপনার শেখানো পথে আমরা চলবো, যতদিন আপনার অফসোস দুর না হবে, প্রেরণা ধারার মতো আমাদের পাশে থাকবে আপনার নিঃশ্বাস!
আল্লাহপাক আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন তিনি।
একজন প্রকৃত দেশ প্রেমিক সব সময় আল্লাহর কাছে প্রিয় হয়ে থাকেন।