বিশেষ
প্রতিনিধি ॥ শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য বাঙালী সংগ্রামে
গর্জে ওঠে। যতই দিন গড়াচ্ছিল, রাজনৈতিক সঙ্কট ততই গভীরতর হচ্ছিল। ইতিহাসের
দিকে ফিরে তাকালে একাত্তরের মার্চের ঘটনাবলী সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া
যায়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সকালে ২৫ মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয়
পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে বলেন, পাকিস্তানের উভয় অংশের নেতৃবৃন্দের
মধ্যে আলোচনাক্রমে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের পরিবেশ
সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ২৫ মার্চের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয়েছে।
সকালে
রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। এটি ছিল
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর টানা ষষ্ঠ দফা বৈঠক। প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে
নিজ বাসভবনে ফিরে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আন্দোলনে আছি এবং ল্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত
আন্দোলন চলবে।
দুপুরে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে কড়া সামরিক প্রহরায় হোটেলে
ফিরেই ভুট্টো তার উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। এই বৈঠক শেষে ভুট্টোর
নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি নেতৃবৃন্দ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে যান।
রাতে সেখান থেকে ফিরে ভুট্টো হোটেল লাউঞ্জে অনির্ধারিত এক সাংবাদিক
সম্মেলন করে বলেন, প্রেসিডেন্ট এবং আওয়ামী লীগ প্রধান বর্তমান রাজনৈতিক
সঙ্কট নিরসনের ল্েয একটি সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। তবে এ ঐকমত্য অবশ্যই
পিপলস পার্টির কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। পিপলস পার্টির অনুমোদন ছাড়া কোন
সিদ্ধান্ত পশ্চিম পাকিস্তানীরা মেনে নিতে পারে না।
অসহযোগ আন্দোলনের
২১তম দিবস ছিল ২২ মার্চ। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হাজার হাজার মানুষ
বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে ছুটে যায়। সমবেত জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বেশ
কয়েকবার বক্তৃতা করেন। সংগ্রামী জনতার ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানের
মধ্যে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন- বন্দুক, কামান, মেশিনগান
কোন কিছুই জনগণের স্বাধীনতা রোধ করতে পারবে না।
এদিন বায়তুল মোকাররম
প্রাঙ্গণে শিশু-কিশোরদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে শিশু-কিশোররা
বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। এদিকে পল্টন ময়দানে সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন
বাঙালী সৈনিকরা এক সমাবেশ এবং কুচকাওজের আয়োজন করেন। সমাবেশে বক্তারা
বলেন, বাংলার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের
স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠেছে তাতে প্রাক্তন সৈনিকরা
আর প্রাক্তন হিসাবে বসে থাকতে পারে না। আমাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের
মূল্যবান সম্পদ। আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালনে প্রস্তুত।
প্রেসিডেন্ট
ইয়াহিয়া খান রাতে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উপলে প্রদত্ত এক বাণীতে বলেন,
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মিলেমিশে এক সঙ্গে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
পাকিস্তান এখন এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত। গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পথে অনেক
অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। তবে আমরা যদি আমাদের ল্েয অবিচল থাকি, তাহলে
কোনকিছুই আমরা হারাব না।
বাঙালী বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া
খানের আলোচনায় বসাটা ছিল সম্পূর্ণ লোক দেখানো প্রহসন মাত্র। আলোচনার আড়ালে
পাকিস্তানে স্বৈরশাসকরা বাঙালীদের স্বাধীনতার সমস্ত আন্দোলনকে স্তব্ধ করে
দেয়ার কৌশলে ব্যস্ত ছিল। এরই মধ্যে পাকস্তানী সামরিক জান্তারা নির্বাচনে
বাঙালী নিধনে অপারেশন সার্চ লাইটের সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলে। বাঙালী জাতিও
যে কোন মূল্যে মহার্ঘ্য স্বাধীনতা অর্জনে দৃঢ় শপথে বলিয়ান হয়ে সর্বাত্মক
প্রস্তুতি নিতে থাকে।