দেবব্রত সেন ||
শীতটা একটু বেশীই পড়ছে এবার।
টীলটী শালটাকে আরো ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে সামনের সবজির ধামাটার দিকে
অগ্রসর হলো। টাটকা পুই শাক, চিংড়ি শুটকী দিয়ে রান্না করলে বেশ হবে খেতে।
কপি, আলু আর আধা কেজি বেগুন এরমধ্যেই কিনে নিয়েছে সে। যাবার সময় শুটকীটা কিনে নিলেই হবে।
কাপড়টা একহাতে একটু উঁচু করে মাঝ বয়সী দাঁড়িওয়ালা লোকটার সামনে দাঁড়াল টীলটী-
- ভাই আপনার পুঁইশাক কত?
- দশ’টাকা আঁটি, দিদি মনি।
টীলটী খানিকটা আনমনা হয়ে গেল।
-
ক’ আঁটি দেব, দিদি মনি? টীলটীর ভাবগতিক দেখে লোকটা বোধ হয় দ্বডেদ্ব পড়ে
গেল। দিদি মনি আবার এত কি ভাবে সামান্য শাক কিনতে। লোকটার পূন: প্রশ্নে
টীলটী বাস্তবে ফিরে আসে। সামান্য একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাব্যস্ত করে
‘না’ রেখে দাও। লাগবে না আজ। বলেই টীলটী উল্টা দিকে হাঁটা শুরু করলো।
বিয়ের
মাস তিনেক পর বাপের বাড়ী এসে সেবার টীলটী জয়ন্তকে দিয়ে চিংড়ী শুটকী আর
পুঁই শাক আনিয়েছিল। নিজহাতেই শুটকী দিয়ে পুঁই শাকের চচ্চড়ী আর শুটকী ভেজে
ভর্তা বানিয়েছিল।
- পরিবেশন করার সময় বাবা বেশ অবাকই হয়েছিলেন। বললেন-
- এটা আবার কি?
-শুটকী
ভর্তা বাবা। চট্টগ্রামী ডেলিকেসি। হাসতে হাসতে জয়ন্ত বলেছিল। তারপর আবার
ফোড়ন কেটে বলেছিল- ‘শিখেনে, শিখেনে তিতলি, যত পারিশ ওদের রান্না শিখে নে,
তারপর আমাদের খাইয়ে যাবি। রান্নাটা ওরা ভালই জানে।
মার বুঝি একটু গায়ে
লেগেছিল কথাটা। তিনি কৃত্তিম রাগের সাথে বলেছিলেন- থামতো। আমরা বুঝি রাঁধতে
জানি না। এত বড় হলি কাদের রান্না খেয়ে, শুনি?
মজা পেয়ে খুব করে হেসেছিল
দু’ ভাই বোন। শ্বশুর বাড়ীতে এ ধরনের রাসিকতা করার প্রশ্নই ওঠে না। সেখানে
একবারে অন্যরকম পরিমন্ডল যেন স্বামী, শ্বাশুড়ি, দেবর, ননদ সবাই যেন অন্য
ধারার মানুষ।
কালরাত্রির পরদিন সকালে টীলটীর এক পিসতুতো ননদ এসেছিল। এসেই ভাই বোনে খুনসুটি শুরু করে দিল টীলটীকে স্বাক্ষী মেনে।
- দ্যাখো, ইবারে কয় ননদী। বিয়া বাড়িত আইস্থ যে নিয়নতরন খাইতে। কাজকাম গইরতে নয়। কেয়ারে তুই আগে আইত ন পারলি?
-
রাখ, রাখ, তুঁই আর কথা ন কইও, আঁর বিয়ার পরতথুন ক’বার গেইয়? বইন কেন আছে
কোন দিন পৌঁছার গইরগ না? এই তাতারি উজি আইসসি দেখিয়ারে তোঁয়ার পিরিত উথলি
উইটটে যেন্।
- তোরে আঁই ঝাঁডাদি মইরজুম, বুইজঝসনা? স্বামীর মুখে অনবরত
চট্টগ্রামের ভাষা শুনতে শুনতে টীলটীর হঠাৎ কেমন জানি ভয় ভয় করছিল। কে বলবে
এই মানুষটাই পি.ডব্লিও.ডি.’র কনষ্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার।
‘র কনষ্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার।
ওদের
আচার অনুষ্ঠান, নিয়ম-প্রথা, এমনকি ভাবনার ধরণও আলাদা, আলাদা সহব্যৎ। আলাদা
চাল-চলন। শত্রুতা? সেও এক রকম আলাদা। ওদের আঘাত, ওদের অপমান, ওদের সততা
কোনটাই যেন বুকে বিধে গিয়ে শেষ হয়ে যায় না। তিল তিল করে দগ্ধাতে থাকে
ভেতরের অন্তরাত্মাকে।
ওবাড়ি থেকে চলে আসার পর তখন মাস আটেক পার। তখনও
আগুনটা সমানে ছড়াচ্ছে, চলছে নিঃশব্দ দহন। জয়ন্ত তখন ব্যঙ্গালোরে কম্পিউটার
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেছে। এই ঘটনায় বাবার বয়স যেন আরো বেড়ে গেল।
প্রতিদিনের বাজার করার ভারটা তাই টীলটীই নিয়েছিল। চিন্তায় শোকে তাপে কাহিল
মানুষটাকে কোন কাজ করতে দিতে মন চাইতো না টীলটীর।
সেদিনও বড়বড় চিংড়ি শুটকী আর টাটকা পুঁইশাক নিয়ে এসছিল টীলটী। বাড়ি ফিরতেই বাবার নজর গেল।
- ওটা কী আনলিরে? কী শাক?
-পুঁইশাক বাবা। চিংড়ি শুটকী দিয়ে----- কথা শেষ করতে পারেনি টীলটী।
-
ফেলে দে, ফেলে দে বলছি ওটাকে। উত্তেজনায় বাবার ফর্সা মুখখানি লাল হয়ে
গিয়েছিল। গলার স্বর কেঁপে কেঁপে উঠছিল ওদের বাড়ীর কোন কিছু এখানে আনবিনা।
এমনকি কোন স্মৃতিও না। মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দে। ইতর শয়তানদের চিহœ এখানে-
কথা শেষ না করেই বাবা হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়েছিলেন সোফায়। মার চোখও ভিজে
উঠেছিল। টীলটী শান্তভাবে এক গ্লাস জল এনে বাবার পাশে দাঁড়ালো।
চিন্তা
করিসনে মা, ওটা তোর কোন বিয়েই নয়। ভুলে যা তুই ওই প্রহসন। বাবার কথা শেষ না
হতেই মা জোরে ফুঁপিয়ে উঠেছিলেন- বলেছিলাম তখন, শুধু ভাল চাকরী দেখে মেয়ের
বিয়ে দিও না। ভাল করে খোঁজ নাও। একে ছোট জাত, তার উপর চট্টগ্রামী ওদের
সাথে আমাদের বনে কখনও? আমার একটা মাত্র মেয়ে।
- আঁর উগ্গা পোয়া, আঁই
পোয়ার আর উগ্গা বিয়া দিউম। অসুখ লুকইয়েনারে বিয়া দিইয়ে- চোরাইয়ার ঘরর
মাইপোয়া--- টীলটীর শাশুড়ী বলেছিল শেষদিন। মন থেকে কতগুলো ছবি আর শব্দ ছিড়ে
ফেলবে টীলটী? মনের গহীন কোনে আরো কত স্মৃতি, কত শব্দ, কত গন্ধ, কত স্বাদ
অন্তরীণ আছে তা টীলটী নিজেও জানে না। সময় ও সুযোগ বুঝে মনের অলিগলি, আঁকা
বাঁকা পথ পেরিয়ে কখন যে কোনটা বেরিয়ে আসে!
চাকুরীটা পেয়ে টীলটীর ভালই
হলো। কেউ অবশ্য কোনদিন চাকুরী নেবার জন্য তাড়া দেয়নি আবার বাঁধাও দেয়নি।
নিজেকে কাজের মধ্যে রেখে টীলটী অন্য সবকিছু ভুলে যেতে চায়। সেদিন পত্রিকার
বিজ্ঞাপনটা দেখে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল, টেবিলের অপর পাশে বসা মহিলাটি তার
বায়োডাটা দেখে ভ্রুকুঁচকে জিজ্ঞাসা করেছিল-
- এম.এ ইন সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার? দেন হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? টিচিং প্রফেশনে গেলেন না কেন?
কোন
প্রফেশনে যাবার কথাই টীলটী কোন দিন ভাবেনি? ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা যখন
বিসিএস দেবার কথা বলছিল তখন টীলটী হেসে বলেছিল- তোরা পরীক্ষা টরীক্ষা দিয়ে
মরগে। আমার বাবা আর ধৈয্য নেই। আমি বিয়ে করে এবার চুটিয়ে সংসার করবো।
- ডজন খানেক বাচ্চা কাচ্চার মা হবি-সারাক্ষণ পাশে পাশে সব ঘুরঘুর করবে, তনুশ্রী চোখ বড় বড় করে বলেছিল। বন্ধুরা সব হেঁসে কুটি কুটি।
-
অ্যাকচুয়্যলি আই হেভ নেভার থট অফ টেকিং টিচিং অ্যাজ আ প্রফেশন। সামান্য
আনমনা টীলটীর এ উত্তরে স্মার্টনেসের চেয়ে সত্যের ভাগ বেশী বলেই বোধ হয়
ব্যবসায়িক মনোভাবাপন্ন বোর্ডারদের তেমন একটা খুশী করতে পারেনি। তারপরও
চাকুরীটা টীলটী পেয়েছিল।
অফিস ফেরত টীলটী নিজের চিন্তায় বুঁদ হেয়েছিল
বাসটা ঝাঁকুনী দিয়ে হঠাৎ মাঝপতে থেমে গিয়েছিল টীলটী খোলই করেনি। চাকাটা
গেছে বোধ হয়। তাড়াতাড়ি নেমে পড়লো টীলটী।
আনমনেই হাঁটতে শুরু করেছিল
টীলটী। হঠাৎ ঝোলানো সোয়েটার এর দোকানটার দিকে নজর গেল টীলটীর ছোট্ট খুপরিমত
একটা দোকান, কিন্তু সুন্দর সুন্দর সোয়েটার ঝুলছে। ঢুকবোনা ঢুকবোনা করেও
টীলটী গুটি পায়ে ঢুকে পড়লো।
দোকানিটা বুড়ো মতো, মাথায় কাঁচাপাকা চুল পান খাওয়া মুখে অমায়িক একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
- কী লাগিব, মা-মনি?
- উলেন ব্লাউল আছে নাকি?
- ন থাকিব ক্যা? বইয়ন দেখাই।
ভাষার
টানটা টীলটীর চেনা চেনা লাগছে। শেষ কয়মাসে মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছিল
ভাষাটা। শ্বশুর মশাই কথায় কথায় এক দিন বলেই ফেলেছিলেন- আঁরার ভাষাখান বউ
তুঁই শিখি ফেলাইয় দেইর। কথা কইলে কেঅ ধরিত ন পারিব তুঁই নোয়াখাইল্যা
মাইপোয়া।
মানুষটা বড় সাদাসিধে ছিলেন, ঐ বাড়ীতে মোটামোটি শ্বশুর মশাই-ই
ছেলে বউকে ভাল বেসে ফেলেছিলেন। দাপট ছিল শাশুড়ির যেন দামড়া গরু। মৃদুভাষী
শ্বশুরমশাই রীতিমত স্ত্রীকে সমঝে চলতেন। মুখ ফুটে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা
তাঁর ধাতে ছিল না। বাড়ীতে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার অনেক কিছুই অজনা থাকতো
লোকটার। কিন্তু শাশুড়ী ঠিকই জেনেছিলেন তার ছেলের অন্য একটা মেয়ের সাথে
সম্পর্ক আছে। আর তাই তড়িঘড়ি করেই ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে আত্মীয়
স্বজনের কাছে সব শুনেছিল টীলটী। শুভার্থী আত্মীয় স্বজন তখন নিজ গরজেই ফাঁস
করেছিল সব তথ্য। টীলটীর প্রতিটা দিন রাত্র তখন নরক যন্ত্রনায় অস্থির।
স্বামীর মন যে অন্য নারীতে আসক্ত তা আর কারো কাছে না হোক স্ত্রীর কাছে গোপন
থাকে না। সহ্যের শেষ সীমা উত্তীর্ণ করে একদিন রাতে টীলটী ফেটে পড়েছিল-
‘আমাকে বিয়ে করে ঠকালে কেন? যাকে তোমার এত পছন্দ তাকে ঘরে আননি কেন------
কথা শেষ হবার আগেই মুখটা চেপে ধরে ছিল শুভময়।
-
শরম নগরে তোর অই কথা কইতে? আঁই ঠগাই না তোর বাপ ঠগাইয়ে? বিয়ার সমত দিব দিব
গরিয়েনারে কিছু ন দেয়। মোটর সাইকেল দিবার কথা আছিল পরে দিব কইয়েনারে সটকি
পইড়ঝে, একখান দিনরলাই সুখ দিত পাইরজঝ না?
- লাথি মারিয়েনা বাইর গরি ন
দিই যে, হিয়ানওবোত। যা গরঝি ভালা গরঝি, আরও গইরঝুম। শরম থাকে ত বাপর বাড়ী
দিয়া উঠ। লাথি মারি এইল্যা বিয়ার মুখত।
খুব সূক্ষ্মভাবে চালটা দিয়েছিল
শুভময়- স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল টীলটী। আবাধ্য চোখের জল নিয়েই মরমে মরে যেতে
যেতে নিদ্রাহীন রাতটি কেটেছিল টীলটীর। পরদিন এক কাপড়েই চলে এসেছিল টীলটী
চির জনমের জন্য।
দোকনানী, উলেন ব্লাউজের বন্ডিলটা খুলতে খুলতে বলল- মা-মনি চাই লন। কউননা দিইউম?
- চাচা, অনের বাড়ী কি চাটগাঁত নাকি?
ক্রেতার মুখে এমন ভাষা শুনতে অনভ্যস্ত লোকটা থতমত খায়। সহসা উত্তর দিতে পারেনা।
- ঠিকই ধইরঝেন মা। কেনে ধরিলেন কনতো?
-
আঁরার দেশঅত হেডে। দুষ্টুমি করে হাঁসতে থাকে টীলটী। একটু পরে আবার বলে
কিন্তু আঁই ন যাই কোন দিন। একটু পর আবার বলে ‘উফ্-কত দিন পর দেশের কথা
শুনিলাম-
- কনে কইবো? বাপ মা নাই, এক ভাই, সেও থাকে বিদেশত।
দুষ্টুমি করতে করতে টীলটী মার জন্য একটা উলেন ব্লাউজ, বাবার জন্য একটা সোয়েটার আর একটা মাফলার নিয়ে টীলটী দাম করতে লাগলো।
- কী দরদাম গরেন মা-মনি? আঁর দেশর মানুষ, অনারে ঠকাইয়ুম না? ফ্রেশ জিনিস দিই, দামঅ বেকের খুন রাখি তারঅ কম রাইখকুম।
টীলটী দাম মিটিয়ে উঠে পড়তে দোকানী বলল,
- আবার আইসসেন, দেশর মানুষ পাইলে মনত জোর পাই।
কুয়াশা
পড়তে শুরু করেছে, সন্ধ্যে এখনও হয়নি। টীলটী একটা রিক্সা নেয়। মজার এ
খেলাটার কথা ভাবতে ভাবতে টীলটী রাস্তার লোগুলো দেখতে থাকে। মনে মনে স্থির
করে এ খেলাটার কথা বাড়িতে কাউকে বলা যাবেনা। নাইবা গেল, থাকনা খেলাটা তার
একান্ত নিজস্ব হয়ে।
-এগুলো আবার কিনে আনতে গেলি কেন? বাবা মা দু’জনেই
একসাথে অনুযোগ করেন। টীলটী বুঝতে পারে অনুযোগের অপর পিঠে রয়েছে আনন্দ। সেটা
বুঝতে পেরে টীলটীর বাবা মা দুজনের গলাটা জাড়িয়ে ধরে। যাও, এখন পরে দেখতো
গায়ে হয় কিনা?
সন্ধ্যা প্রদীপ দিয়ে আহিœ সেরে মা যখন চা করে নিয়ে এল টীলটী তখনও বারান্দায় বসে ছিল চাদরটা গায়ে জড়িয়ে।
অন্ধকারে বসে থাকা মেয়েটার দুঃখী মুখখানা দেখে মায়ের মন ভারক্রান্ত হয়ে উঠে। কাছে এসে টীলটীর মাথায় হাত রাখেন।
-
তুই একেবারে একটা পাগলি, জামাটা ভাল পড়েনিতো কী হয়েছে? এক একটা দোকানদার
এরকম ক্রেতা পেলে ঠকিয়ে দেয়। মন খারাপ করিস না। চা খাবি আয়, তোর বাবা বসে
আছেন।
টীলটী লোকটার কথাই ভাবছিল। আশ্চার্য! এমন করে ঠকালো লোকটা দেশের
লোক বুঝেও? নাকি এরা ঠকাতে এত অভ্যস্ত যে কোন সেন্টিমেন্টেই এর গলে না।
মায়ের কথায় মুহুর্তে সচকিত হয় সে। মার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে ‘আমি ওই
নিয়ে মোটেই ভাবছিনা মা। তুমি যাও মা, আমি যাচ্ছি এক্ষুনি। উফ্ মা.... তুমি
না.....