ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
লেখক ও গবেষক
Published : Saturday, 1 May, 2021 at 12:00 AM
লেখক ও গবেষকজুলফিকার নিউটন ||
যে লেখকদের লিখেই জীবিকা অর্জন করতে হয় পাঠক এবং প্রকাশকের রুচি অথবা দাবি তারা অগ্রাহ্য করতে পারেন না। আমি পেশাদার লেখক নই, লিখে জীবিকা উপার্জন করি না, জীবনে একবার বছর দুই গবেষণার কাজ ছেড়ে দিয়ে একটি পত্রিকায় নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে কলাম লেখার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। সেই দুবছরেই বুঝতে পারি লেখাকে জীবিকা করা আমার ধাতে পোষাবে না। তারপর নানা রকমের আকর্ষণীয় আমন্ত্রণ সত্ত্বেও লেখাকে জীবিকা অর্জনের প্রধান উপায় হিসেবে গ্রহণ করি নি। লিখি নিজের খুশি মাফিক জীবিকার জন্য গবেষণার পথ বেছে নিয়েছি। পেশাদার নই বটে, কিন্তু লিখেছি তো নিতান্ত কম নয়। সেই ছাত্র বয়স থেকে লিখছি, এবং অসংকলিত বিস্তর লেখার কথা বাদ দিলেও আমার ইংরেজি এবং বাংলায় লেখা বইয়ের সংখ্যা প্রায় শতাধিক হবে। সুতরাং এ প্রশ্ন খুবই সঙ্গত কেন লিখেছি? কী লিখেছি?
আমি নিজেও জীবনে অল্পস্বল্প কবিতা লিখেছি, কয়েকটি কবিতার বইও ছাপা হয়েছে, কিন্তু কেন লিখেছি, বা তাদের পিছনে কোনো উদ্দেশ্য ছিল কিনা, এ প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারব না। তবে বাঙালি পাঠকের কাছে আমার পরিচয় মুখ্যত প্রাবন্ধিক গবেষক এবং অনুবাক হিসেবে এবং প্রবন্ধ আটঘাট বেঁধেই লিখতে হয়। অর্থাৎ সেখানে উদ্দেশ্যের প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক।নিজের প্রবন্ধ নিয়ে কিছুটা নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে গেলে দেখতে পাই সেখানে উদ্দেশ্য মুখ্যত একটাই, কিন্তু তাদের ধারা অন্তত দুটি। আমি যে জগতে জন্মেছি, যে সমাজে বাস করি, যে ভাষা ব্যবহার করি, যে সাহিত্য পাঠ করি, তার মধ্যে বিস্তর নিকৃষ্ট উপাদান এবং গভীর ত্রুটি আমাকে ক্রমাগত পীড়া দেয়। এই সব ত্রুটি, স্খলন, হীনতা, অপসারণ প্রচেষ্টা আমার করণীয় বলে মনে হয় এবং আমার প্রবন্ধে সেই চেষ্টা আকার পায়। আমাদের জীবনযাত্রার, সমাজব্যবহার, ধ্যানধারণার, ভাষা এবং সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন আমার প্রবন্ধ-রচনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এই চেষ্টা দুটি প্রধান ধারায় প্রবহমাণ। সংক্ষেপে তাদের কথা জানাই। আমাদের সমাজব্যবস্থা এবং তার পিছনে যে জীবনদর্শন সক্রিয় তা যে কত মনুষ্যত্ব বিরোধী খুব অল্প বয়সেই নিজের অভিজ্ঞতার সূত্রে সে বিষয়ে সচেতন হই। এই চেতনা প্রথম যৌবনে প্রবলতর হয় রাসেল, মার্কস এবং ফ্রয়েডের রচনাবলী পড়ে। যে জগতে আমার বাস সেখানে প্রায় সর্বত্র দেখতে পাই একদিকে কায়ক্লেশে অর্ধাহারে অনাহারে বহুমানুষের টিকে থাকবার দুর্মর প্রয়াস, অন্যদিকে কিছু বিত্তবান মানুষের অপর্যাপ্ত ভোগবিলাস এবং সম্পদের অপচয়। একদিকে জমিজমা কলকারখানার মালিক, সরকারি আমলা-পুলিশ, নানাসূত্রে প্রতিপত্তিশালী ও সংগঠিত মুষ্টিমেয় মানুষের অত্যাচার, অন্যদিকে অসহায় নিরীহ, দরিদ্র, দুর্বল বহুমানুষের মুখ বুঁজে এই অত্যাচার সহ্য করা। দেখি পুরষশাসিত সমাজে মেয়েদের দূরবস্থা অন্তহীন। দেখি দীর্ঘদিনের নিষ্পেষণে, দারিদ্র, শিক্ষাহীনতায় কী ভাবে অধিকাংশ মানুষ আতœপ্রত্যয়হীন, দৈবনির্ভর, যুক্তিবিমুখ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। আর তারই সঙ্গে লক্ষ করি যারা শিক্ষিত, এই অসম ব্যবস্থায় যারা নানা রকমের সুযোগসুবিধার অধিকারী, যাদের কর্তব্য ছিল এই ব্যবস্থার কুৎসিত স্বরূপ উদ্ঘাটন করে সাধারণ মানুষের মনে সামাজিক রূপান্তরের অভীপ্সাকে জাগিয়ে তোলা, সেই বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর অনেকেই কী ভাবে নানা চতুর উপায়ে এই ব্যবস্থাকেই টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগী। এইসব দেখেশুনে অল্প বয়সেই মনস্থির কবি আমার কলম এই অসাম্য, অন্যায়, অত্যাচার এবং সব কিছু মুখ বুঁজে সয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে লেখায় নিয়োজিত হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের সততায় আমার আস্থা নেই-তাদের একমাত্র সাধনা ক্ষমতা অর্জন, ক্ষমতা লাভের আগে অথবা পরে কোনো সময়েই তারা ন্যায়নীতির নির্দেশ গ্রাহ্য করে না। সুতরাং কোনো দলে যোগ না দিয়ে আমি নিজের র‌্যাডিক্যাল ভাবনাচিন্তার কথা নিজের মতো করেই লিখেছি। শুধু বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থা এবং তাকে ধারণ করে আছে যে দর্শন দৃষ্টিভঙ্গি তাকেই নানাদিক থেকে সমালোচনা করিনি; তার বিকল্প রূপে কোন ধরনের সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভবপর তাও শব্দ দিয়ে আকবার চেষ্টা করেছি। আমার শিল্পের নন্দনতত্ত্ব- (১৯৮৫), মরমী লালন ফকির- (১৯৯০), সাহিত্যের সৌন্দর্য- (১৯৯৪), বঙ্গবন্ধু গান্ধী লেনিন- (১৯৯৫), বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ- (১৯৯৭), নাটকের শিল্পতত্ত্ব- (১৯৯৭), বাংলা গদ্যের গন্তব্য- (১৯৯৮), বঙ্গবন্ধুর শিল্পব্যক্তিত্ব- (১৯৯৮),মুক্তচিন্তা ও মুক্তসমাজ- (২০০১), দেশরতœ শেখ হাসিনা- (২০০৩), বঙ্গবন্ধু; জাতির পিতা ও স্থপতি- (২০০৩), বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ-(২০০৫), উপন্যাসের শিল্পতত্ত্ব- (২০০৫), বিশ^নন্দিত শেখ হাসিনা- (২০০৬), সংগীত সংস্কৃতি- (২০০৬), বাউল লালন রবীন্দ্রনাথ- (২০০৭), মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্ব- (২০০৭), কবিতার শিল্পতত্ত্ব- (২০০৮), রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন- (২০০৯), সুস্থ সমাজের সন্ধানে- (২০১০), সংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব- (২০১১), বাংলার বাউল ফকির-(২০১২), বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বই- (২০১২), নোবেল বিজয়ী সাহিত্য (২০১৩), বিশ্বের বরেন্য সাহিত্য (২০১৩), নজরুল জীবনীর খসড়া- (২০১৪), রবীন্দ্র সংগীত সংস্কৃতি- (২০১৫), মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু- (২০১৬), বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন- (২০১৬), বঙ্গবন্ধু : রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনীতি (২০১৭), স্বাধীনতা ও সুভাষচন্দ্র- (২০১৭), রাজনীতির হাজার বছর- (২০১৮), বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন- (২০১৮), বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিসংগ্রাম- (২০১৯), মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তচিন্তা- (২০১৯ রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু- (২০২০), শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষাচিন্তা- (২০২১) ইত্যাদি বইতে এবং রচনায় আমার চিন্তার এই ধারাটির কিছুটা পরিচয় মিলবে। আমার এই র‌্যাডিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি একসময়ে যেমন আমাকে কার্ল মার্কসের রচনাবলীর প্রতি আকৃষ্ট করেছে, পরবর্তীকালে তেমনি বঙ্গবন্ধুর চিন্তাও আমার ওপরে প্রভাব ফেলে। কিন্তু ক্রমেই আমার চিন্তা নিজস্বতা অর্জনের দিকে চলেছে-আমার সদ্যপ্রকাশিত আপন আলোর আকাশ বইটিতে তার কিছু আভাস আছে। আমি নিজেকে মার্কসপন্থী বা লেনিন অনুগামী মেনে করি না।
কিন্তু আমার মূল উদ্দেশ্য-সংস্কারের, রূপান্তরের, জীবনের সব ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রকর্ষ অর্জন ও প্রতিষ্ঠার-দ্বিতীয় আরেকটি ধারাতেও প্রবাহিত। শিশুকাল থেকেই আমার মন সাহিত্যপাঠের দ্বারা পুষ্ট হয়েছে। আমার ধারণা, মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন তার ভাষা এবং ইতিহাসের সব চাইতে বড় বিপ্লব ঘটে অক্ষর বা বর্ণমালার উদ্ভাবনের ফলে। ভাষা মানুষকে মুক্তি দেয় নির্দিষ্ট বিশেষ থেকে অফুরন্ত নির্বিশেষে। আর এই নির্বিশেষ থেকেই উদ্ভূত হয় বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা। অক্ষরের সূত্রে মানুষ দেশকালকে জয় করে, অমরত্ব অর্জনের চাবিকাঠি খুঁজে পায়। প্রাণীমাত্রেই মৃত্যুর অধীন; তবু প্রাণী অমরত্ব খোঁজে সঙ্গমসূত্রে বীজের বপনে; ব্যক্তিমরে, কিন্তু প্রজাতি অনেক ক্ষেত্রেই টিঁকে থাকে। মানুষও অমরত্বের জন্য নির্ভর করে অন্য প্রাণীর মত জননকোষের ওপরে-কিন্তু অন্য প্রাণীদের তুলনায় তার একান্ত স্বকীয় আর একটি চাবিও আছে। পৃথিবী থেকে মনুষ্য সভ্যতার বিলোপ না ঘটা পর্যন্ত সৎসাহিত্য অমর।

আজও আমার গভীর ভাবে প্রাণিত হই যখন পড়ি সফক্লিস অথবা কালিদাস, দান্তে অথবা লিপো, টলস্ট কিংবা গোয়েটে, গালিব অথবা রবীন্দ্রনাথ। আমরা নিজেরা অমরত্ব অর্জন করতে না পারলেও এইসব ক্লাসিক্স্-এর অন্তরঙ্গ আবেদন আমাদের সচেতন করে তোলে মানুষের ভাষা এবং অনুভূতি, ভাবনা এবং কল্পনা জীবনকে কতখানি সমৃদ্ধ করতে সক্ষম না সম্পর্কে। অমরত্বের স্বাদ যা বহুজনের উপভোগের দ্বারা খর্বিত হয় না, যা ভূগোল এবং সময়ের ব্যবধান অতিক্রম করে ভবিষ্যৎকালেও পৌঁছতে পারে তা মেলে সৎসাহিত্য থেকে।
এখন আমার প্রবন্ধটির একটি ধারা যেমন সমাজের সমালোচনা, বিশ্লেষণ এবং রূপান্তরের উদ্দেশ্যে বহমান, অন্য ধারাটি তেমনি ভাষা এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে উৎকর্ষের সাধনায় নিয়োজিত। পশ্চিমি সাহিত্য নিয়ে যখন আলোচনা করি তখন মুখ্যত আমার বিচার্য হয় কী ভাবে নিজের জীবনে বিষপান করেও মহৎ সাহিত্যিক তাঁর অভিজ্ঞতাকে অমরত্ব দান করেন। অথবা কী কী কারণে কোনো ভাষায় তথা সাহিত্যে আপজাত্য ঘটে। আমার প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থে শিল্পের নন্দনতত্ত্ব (১৯৮৫) এই আপজাত্যের হেতু বিশ্লেষণ ছিল। ‘রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন বইটিতে আমি সাহিত্যে মহত্ত্বের সূত্র নির্ণয় করার চেষ্টা করি; কিন্তু গোয়েটের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তুলনার সূত্রে বাঙালি মহাকবির কিছু গভীর ত্রুটির উল্লেখ করর ফলে অধিকাংশ বাঙালি পাঠক আমার প্রতি বিরূপ হন। বস্তুত দীর্ঘ দিন যাবৎ লিখলেও আমি জনপ্রিয় লেখক নই; আমি কখনো শাস্ত্র অথবা জনমতের অণুসরণ করি না; আমি অধিকাংশ সময়েই নিজের যুক্তি, অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাস অনুযায়ী যা লিখি তা স্রোতের বিরুদ্ধে যায়। তা সত্ত্বেও আমি গত প্রায় বিশ পঁচিশ বছর ধরে অপরিসীম ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ে চেষ্টা করে আসছি যাতে বাংলা ভাষার ত্রুটি এবং দুর্বলতা হ্রাস পায়-বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা গদ্যের ভাষাকে যে উঁচু তারে বেঁধে দিয়ে গিয়েছিলেন বাংলা গদ্যের ভাষা যেন অন্তত সেখান থেকে স্খলিত না হয়, এই ভাষা যেন আরো সবল, সমৃদ্ধ, প্রকাশময় হয়ে ওঠে।
আসলে কথাটার সঙ্গে একটা পুরানো তর্ক জড়িত রয়েছে-মানুষের ব্যক্তিত্ব একান্ত কিনা, তা অন্য-নিরপেক্ষ কি না, তা সমাজ  নিরপেক্ষ কি ন্ াকিন্তু এ পুরানো তর্কের ঘূর্ণাবর্ত ও চোরাবালিতে আজ স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের আটকে যাবার কথা নয়। কারণ, “ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের  (ইনডিভিজুয়েলিজম্) যুগের” ধোঁয়া আজ অনেক কেটে আসছে। আবার সমূহতন্ত্রের (কলেকইটভিজম্) ভূয়া বিভীষিকাও অনেকটা দূর হয়ে যাচ্ছে। তাতেই সহজ চোখেও আজ ব্যক্তির ও সমাজের সম্বন্ধ, তার দেনা-পাওনার রূপ, অনেকটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
মোটামুটি এদিকে আজ যা বোঝা যাচ্ছে সংক্ষেপে তা এইঃ-প্রথমত, ব্যক্তির এই “ব্যক্তিত্ব” গড়ে ওঠে ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিবেশের সংযোগে, সংঘতে। এই ব্যক্তিত্ব গঠনের ইতিহাসে ব্যক্তিও তাই একমাত্র সত্য নয়। দুইই কতকটা সত্য ; আর আসল সত্য যা ‘ব্যক্তি-স্বরূপ’ বা “ব্যক্তিত্ব” বা “ব্যক্তিসত্তা”, যা’ই তাকে বলি,-তা এই দুয়ের মিলনে গঠিত নতুন, স্বতন্ত্র এক তৃতীয় সত্য।
দ্বিতীয়ত, ভেতরের-বাইরের নানা টানা-পোড়েন, বাস্তব ঘটনার ও মানবিক ভাব-কল্পনার নানা ঘাত-প্রতিঘাতে রচিত হয় এই ব্যক্তিত্ব বা ব্যক্তিস্বরূপ। সেই ব্যক্তিস্বরূপ তাই এক বিচিত্র “প্যাটার্ণ”। কিন্তু ভেতরে বাইরে প্রতিনিমিষে ঘটনা ও চেতনা বদলে যাচ্ছে। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নতুন হচ্ছে। তাই ব্যক্তিত্বও একটা মূল ভিত্তির উপরে প্রতিনিমিষে একটা নবায়মান প্যাটার্ণ, একটা বিকাশশীল ‘প্রোসেস্ও’।
তৃতীয়ত, এই ব্যক্তিত্বের বলেই প্রত্যেক মানুষ যেমন ঁহরয়ঁব, অপূর্ব, অদ্বিতীয়, তেমনি সেই ব্যক্তিত্ব সত্ত্বেও প্রত্যেক মানুষই আবার মানুষ, এমন কি বিশেষ বর্গ-সম্মত (পষধংং) মানুষ;-আজকের সমাজে, অনেকাংশে ‘প্রমাণ-সই’ (ংঃধহফবৎ ফরপবফ) মানুষও সে। তাই একই কালে সে ব্যক্তিও (রহফরারফঁধষ) বটে আবার ‘টাইপ’ও বটে; কেউ ওটা বেশি।
চতুর্থত, ব্যক্তি ও পরিবেশের সংঘাতে যে ব্যক্তিত্ব রূপায়িত হয়, মোটেই তা হলে তা একরঙা সরল সত্তা নয়; সেও যথেষ্ট বিচিত্র এবং বর্ধনশীল। সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এই বৈচিত্র্য বিকশিত হয়, ব্যক্তিত্বেরই তাতে বিকাশ ঘটে। যুগে যুগে দিনে দিনে মানুষকে বাড়তে হয় একটা সমন্বয় করে, একটা সমাহিতি (রহঃবমৎধঃরড়হ) সাধন ক’রে। যখন সভ্যতা জটিল হয়ে পড়ে, সংঘাতসঙ্কুল হয় তখন ভেতরের বাইরের দ্বন্দ্ব বেড়ে যায়, ব্যক্তিতে সরলতা অপেক্ষা জটিলতা বেশি দেখা দেয়, অখন্ডতা অপেক্ষা খন্ডতাই নিয়ম হয়ে পড়ে। সাধারণত ব্যক্তিত্ব তখন ভেতরের বাইরের দ্বন্দ্বে, নিরাশায়, ব্যর্থতায় খন্ড খন্ড হয়ে যায়। আজকের যুগে সভ্যতার সংকট যেখানে যত গভীর সেখানেই তাই দেখতে পাব ব্যক্তিত্ব তত খন্ডিত, অসুস্থ্য, অস্বস্্থ, অস্বচ্ছ।
কাজেই, সাহিত্য যদি ব্যক্তিত্বের বাণী হয় তা হলেও সাহিত্য নির্জনতার সৃষ্টি নয়, ‘একান্ত মানুষের’ বাণী নয়। কারণ, ব্যক্তিত্ব এক বিকাশশী বিচিত্র প্যাটার্ণ, ব্যক্তির সঙ্গে পরিবেশের সংযোগে সংঘাতে তা রূপায়িত। তাই এই দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে সাহিত্য পরিবেশেরও বাণী। কোথাও বা  সাহিত্যে এ সত্য প্রত্যক্ষ হয়, কোথাও বা তা পরোক্ষ থাকে। ব্যক্তির সৃষ্টিও আসলে এই অর্থে যৌথসৃষ্টি, একক মানুষের নিছক ধ্যান-কল্পনা তা নয়। অবশ্য সাহিত্য যে শুধু পরিবেশের প্রতিলিপিও নয়, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, সাহিত্য বা শিল্প প্রতিলিপি মাত্র নয়, সৃষ্টি। শিল্পী ও সাহিত্যিক যা আছে তাই শুধু গ্রহণ ও প্রত্যর্পণ করে না; যা গ্রহণ করে নিজের চেতনার দান তার সঙ্গে মিশিয়ে তাকে নতুন করে; পরিবেশকে নতুন কিছু তারা যোগায়।
মুস্কিল হল, যেমন ব্যক্তি এবং সমাজের জীবন তেমনি ভাষা এং সাহিত্যের বিকাশৗ নিয়ম অনুশলীনসাপেক্ষ। কোনো কিছুই ঠিক এক জায়গায় স্থির নেই, ভাঙন এবং মৃত্যু   অস্তিত্বে অনিবার্য। কিন্তু আমরা বাঁচতে চাই, সুস্থ ভাবে, মাথা উঁচু করে, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার সূত্রে, স্বাধীন আত্মপ্রকাশের অধিকার ব্যক্তিজীবনের ভোগ করে। কিন্তু তার জন্য চাই নিরন্তর প্রয়াস, সমস্যার সমাধানে বুদ্ধির প্রয়োগ, জ্ঞানের চর্চা, পারস্পরিক সহযোগ এবং সৌহার্দ্য। আমি কেন লিখি? লিখি একদিকে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির গলদ উদ্ঘাটন করে তার বিরুদ্ধে অত্যাচারিত স্ত্রীপুরুষদের মনে ব্যাপক বিপ্লবের ইচ্ছাকে জাগ্রত এবং প্রবলতর করতে; অন্যদিকে যে ভাষা এবং সাহিত্যের সূত্রে মানুষের মন অমৃতের স্বাদ পায় তাকে বলিষ্ঠ, গতিশীল, সমৃদ্ধতর করতে। এই চেষ্টার পথে আমার নিজের ভাষায় বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু সে আর এক কাহিনী।
আমি জানিয়ে যেতে যাই যে বায়ান্ন বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও আমি এখনো পুরোপুরি মানবতন্ত্রী, যুক্তিবাদী, ত্রুটিশীল এই মনুষ্যজাতির অপরিসীম সম্ভাবনায় বিশ্বাসী। আমি জীবনে কখনো শক্তিমান বা বিত্তবানের কাছে মাথা নত করি নি, যাতে মানুষকে স্তোক দেওয়া যায় এমন কোনো কথা লিখি নি বা বলি নি, জনপ্রিয়তা, সামাজিক সম্মান বা পুরস্কার ইত্যাদির চাইতে নিজের বক্তব্যে এবং জীবনে সততাকে অনেক বেশি মূল্য দিয়েছি। শুনেছি অনেকেই আমাকে অহংকারী বলে। আমি অহংকারী, কিন্তু স্বার্থসিদ্ধির জন্য কলম ধরিনি। আমার অস্মিতাকে আমি বহু বাধা বিপত্তি সংকট সত্ত্বেও কখনো খর্ব হতে দিই নি। আমার আশা মৃত্যু পর্যন্ত যেন লেখক, গবেষক অনুবাদক এবং মানুষ হিসেবে এই অহংকার বজায় রাখতে পারি।