মোস্তফা হোসেইন ।।
‘সুইডেনকে
না দেখে বাংলাদেশের দিকে তাকান। পাকিস্তানকে বাংলাদেশের মতো বানান।’ কয়েক
বছর আগে পাকিস্তানের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে টকশো-তে জাইঘাম খানের এই
মন্তব্য বেশ আলোড়ন তৈরি করেছিলো। ওই সময়ই আমার খুব মনে পড়েছিলো পূর্ব
পাকিস্তানের কথা। আমার নিজের দেখা স্মৃতিগুলো নাড়া দিয়েছিলো খুব। নিজে
নিজেই বলেছিলাম- হায়রে পাকিস্তান, তোমারই একটি অংশের বাসিন্দা ছিলাম আমরা।
স্মৃতি টেনে নিয়ে গিয়েছিলো আমাকে, আমার গ্রামে।
১৯৬৮-৬৯ সালের কথা। ওই
সময় আমার গ্রামের এক লোকের মৃত্যুশয্যায় তার পরিবারের লোকজন বললো, মরার আগে
যদি ফল খাওয়ানো যেতো। তাঁর এক ছেলে কায়কেশে কিছু টাকা নিয়ে রওনা হলো
কুমিল্লা শহরে। ১০কিলোমিটার হেঁটে তারপর ট্রেনে চড়ে গেলো কুমিল্লা। ফিরলো
১ছটাক আঙ্গুর আর একটি বেদানা নিয়ে। মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে সেই ফল খাওয়ালো।
চিকিৎসার কথাও বাদ যায় কী করে। বাবাকে চিকিৎসা করলেন গ্রামের হোমিও চিকিৎসক
ঊমেশ ঠাকুর। ঊমেশ ঠাকুরের প্রাণান্ত চেষ্টাতেও বাবাকে ধরে রাখতে পারেনি
সেই ছেলে। তারপরও একটা সান্ত¡না ছিলো-বাবার মরণকালে ফল খাইয়ে দিতে পেরেছে
ছেলে।
আর আজকে? বিশ্বমহামারি করোনার কবলে পড়ে পৃথিবী যেখানে থমকে গেছে।
বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলো যেখানে চোখে শর্ষে ফুল দেখছে, ওই অবস্থায় আমার
চোখ পড়ে, করোনা চিকিৎসায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের পরিসংখ্যানে। যে
দেশে একজন সাধারণ মানুষ মৃত্যুর আগে এক ছটাক আঙ্গুর আনার জন্য প্রাণান্ত
চেষ্টা করেও কেউ হয়তো পেরেছে কেউ হয়তো পারেনি, সেই দেশে ২০২১ সালে এসে ৭
লাখ ৬৩হাজার ৬৮২ জন করোনা আক্রান্ত রোগির চিকিৎসা করেছে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয়
খরচে (৩ মে, ’৭১) । ৬ লাখ ৯১ হাজার ১৬২জন মানুষ সুস্থ হয়েছেন এবং
চিকিৎসাধীন আছেন ৬০ হাজার ৮৭৬জন।
যে দেশের মানুষ মৃত্যুকালেও নির্ভর
করতো গ্রামীণ একজন হাতুরে ডাক্তারের ওপর, সেই দেশের প্রতিটি করোনা রোগীর
চিকিৎসা ব্যয় রাষ্ট্র বহন করছে। ব্যয়ের পরিমাণের দিকে তাকালে অবাক হয়ে যেতে
হয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাগ্রহণকারী প্রতিজনের পেছনে সাধারণ শয্যায়
ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ২৮ হাজার ১০৯ টাকা। আইসিওতে খরচ হচ্ছে ৪ লাখ ৮ হাজার
৪৫টাকা। বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয় তার চেয়ে অনেক বেশি। এই পরিসংখ্যান
অনুযায়ী বাংলাদেশের কত হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে শুধু করোনা রোগীর
চিকিৎসার জন্য,ভেবে পুলকিত না হয়ে পারা যায় কি? আবার টিকার প্রসঙ্গ যদি
আনি। বিশ্বের বহু দেশ যখন টিকা নেয়া শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশে ১ কোটি
মানুষের টিকাদান নিশ্চিত হয়ে গেছে। মে মাসের মধ্যে আরও ৫০ লাখ টিকা আসার
কথা।
এটা বাংলাদেশে আর তখন ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানে। ওই পূর্ব পাকিস্তানে
যে শুকনো বেদানাটা আনা হয়েছিলো তা এসেছিলো তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে।
পাকিস্তানিরা আমাদের এই অঞ্চলকে তাদের বাজার বানিয়েছিলো। অর্থনৈতিক উন্নয়ন
যা হওয়ার তার পুরোটাই করেছিলো তাদের দেশে। তাও অনুৎপাদনশীল খাতেই বেশি।
তাতেও তৃপ্তির ঢেকুর তুলতো পূর্ব পাকিস্তানের মতো একটি বাজার পেয়ে। সেই
পাকিস্তান আজকে বাংলাদেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
পাকিস্তানের একটি টিভি
টকশোতে বছর দুই আগে দেখেছিলাম- আলোচক বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার
রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলার। আর পাকিস্তানের ২০ বিলিয়ন। বিভিন্ন খাতের উল্লেখ
করেছিলেন সেই বক্তা। প্রতিটিতেই বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তান থেকে দ্বিগুণ
তিনগুণ ঊর্ধে।
বাংলাদেশে করোনাও জুৎ করতে পারেনি এমনটা বলতে না পারলেও
এটা বলতে দ্বিধা নেই করোনায় যতটা অর্থনৈতিক তি করার আশঙ্কা ছিলো তা করতে
পারেনি বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথটা সঙ্কুচিত হয়নি আল্লাহর
অশেষ রহমতে। পাকিস্তানিরা যে বাংলাদেশ হতে চায়- এর প্রমাণ পাওয়া গেলো ৩ মে
প্রকাশিত সংবাদে। বিশ্বব্যাপি এত অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫.১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর মাধ্যমে রেকর্ড
সৃষ্টি করতে সম হয়েছে।আর পাকিস্তানের অবস্থা? বাংলাদেশের অর্ধেকেও পৌঁছাতে
পারেনি তারা। তার জন্যও চীন থেকে ঋণ করতে হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ
জরুরী পর্যায়ে নিয়ে যেতে। পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করেই বলতে হয়, বৈদেশিক
মুদ্রার রিজার্ভ এর েেত্র বাংলাদেশ তাদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে। বিশ্বের
রিজার্ভের েেত্র বাংলাদেশের অবস্থান ৪৫তম আর পাকিস্তানের অবস্থান ৭১তম।
বাংলাদেশের
এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় শক্তি হচ্ছে বিদেশে আমাদের শ্রমবাজার। আমাদের
প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পাশাপাশি রফতানি আয়কেও উপো
করার উপায় নেই। বিদেশে শ্রমবাজারের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা নিয়ে একসময়
সমালোচিত হতো। বলা হতো, বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে যে কোনো সময় নেতিবাচক
প্রভাব ফেলবে অর্থনীতিতে। আজকে আমাদের রফতানি বাণিজ্য সেই আশঙ্কাকেও দূরে
ঠেলে দিতে সম হয়েছে।
পুলকিত হওয়ার মতোই মনে হতে পারে রফতানির পরিসংখ্যান
দেখলে। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে রফতানির তুলনায় ২০২১-এ বেড়েছে ৫০৩ শতাংশের
বেশি। গতবছর রফতানি হয়েছিলো ৫২ কোটি ডলার। এবছর সেটা বেড়ে গিয়ে ৩১৩ কোটি
ডলারে উপনীত হয়। যদি করোনাকালীন প্রথম পরিবেশের কথা বলা হয় তাহলে ২০১৯
সালের এপ্রিল মাসের তুলনা করা যেতে পারে। দেখা যাবে সেই সময়ের চেয়েও ১
দশমিক ৬২ দশমাংশ বেড়েছে।
একমুখী অর্থ আগমনের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস তথা
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বহুমুখী পথ তৈরি ও প্রসস্তকরণে সাফল্যর কারণে
বাংলাদেশের অগ্রাযাত্রা আরও নিশ্চিত হচ্ছে, এমনটা আশা করতেই পারি। সেই
আশাবাদের পেছনের শক্তি দেখে আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, এই তো আমার দেশ, এই
তো আমার বাংলাদেশ।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।