ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
শতবর্ষ আগে কুমিল্লায় নজরুল ইসলামের আগমন উপলক্ষে কিছুকথা
Published : Tuesday, 11 May, 2021 at 12:00 AM
শতবর্ষ আগে কুমিল্লায় নজরুল ইসলামের আগমন উপলক্ষে কিছুকথাশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
পঞ্চম পর্ব
কুমিল্লায় নজরুল ইসলামকে নিয়ে যত লেখালেখি ও গবেষণা হয়েছে তা অনেকটাই ব্যক্তি উদ্যোগে ও স্বনিষ্ঠ প্রচেষ্টায়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো সহযোগিতার হাত কেউ বাড়িয়ে দেননি। তবে জেলাপ্রশাসন পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আমার নজরুল-বিষয়ক তিনটি গবেষণা বই- ১.চিঠিপত্রে নজরুল, ২. অঞ্জলি লহ মোর ও ৩. নজরুল ও কুমিল্লা প্রকাশ করে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন, আমি নিজেকে এজন্য ভাগ্যবান মনে করছি। এ ধারায় নজরুল পরিষদ কয়েকটি বই প্রকাশ করেছে, এ নিয়ে বেশি আলোচনা করব না। তবে মনে ক্ষোভ জমা আছে। কারণ, নজরুল পরিষদের সম্পাদক যখন জেলা প্রশাসকের আহূত সভায় সদম্ভে বলেন- নজরুল পরিষদ কুমিল্লার লেখকদের বই প্রকাশ করে তাঁদেরকে ‘গবেষক’ বানিয়েছেন। অর্থাৎ নজরুল পরিষদ হলো গবেষক তৈরির কারখানা। গবেষক বাজার থেকে ক্রয় করা যায় না বা বাজার থেকে তুলে এনে হালাল তকমা দেয়া যায় না-এ বোধ-বিশ্বাস যাপন করতে হলেও যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে। আমি ঐ সভায় উপস্থিত ছিলাম না। নজরুল পরিষদের সম্পাদক যদি একথা বলে থাকেন, তা অত্যন্ত অপমানজনক, অনভিপ্রেত এবং ধৃষ্টতা। নিজেরা বনসাঁই সেজেছেন, অন্যকে অপমান করার জোর পায় কোথায় থেকে? এমনিতে ১৯৭০ সালে নজরুল পরিষদ গঠিত হওয়ার পর আইনজীবীরা দীর্ঘদিন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন, বিষয়টি অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। তারপর আইনজীবীর হাত থেকে পদটি উদ্ধার করে সাংবাদিককে দেয়া হয়, তিনি এখন গবেষণাগার স্থাপন করে কুমিল্লায় ‘নজরুল-গবেষক’ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন এবং তার দাবি অনুযায়ী গবেষকও বানিয়েছেন। এসব বিষয়গুলো নিয়ে এখন যে ভাবতে হয়। কুমিল্লায় নজরুলকে নিয়ে কারা লেখালেখি করেছেন, করছেন তা সকলেরই জানা। নজরুল ও কুমিল্লা নিয়ে মরহুম সুলতান মাহমুদ মজুমদার, মরহুম মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস, অধ্যাপক মোবাশ্বের আলী, ড. রফিকুল ইসলাম, ড. রাজিয়া সুলতানা, সুধীন দাশ প্রচুর কাজ করেছেন। তন্মেধ্যে অধ্যাপক মোবাশ্বের আলী ও ড. রাজিয়া সুলতানার কাজগুলো হলো একাডেমিক। অন্যদের কাজগুলো ছিল কুমিল্লা কেন্দ্রিক। এধারায় তিতাশ চৌধুরী, আনোয়ারুল হক, ড. আলী হোসেন চৌধুরী, শাহজাহান চৌধুরী, প্রাবন্ধিকসহ বুলবুল ইসলাম ও অন্যান্য স্বনিষ্ঠ স্বউদ্যোগে অনেক কাজ করেছেন। তাঁদের কোনো স্বীকৃতি আজ পর্যন্ত কেউ দেয়নি। যাঁরা এ ধারায় কাজ করেছেন, তাঁদের প্রত্যাশায় এরূপ কাতরতা ছিল না, এখনও নেই। আজ নজরুলের কুমিল্লা আগমনের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে তাঁদেরকে মূল্যায়ন করা হয়ত একটি নৈতিক দায়িত্ব বর্তায় আয়োজনকারীদের।
    আমি মনে করি নজরুলের কুমিল্লায় আগমনের শতবর্ষ পরও কুমিল্লাবাসী পরম মমতায় ও আবেগে আজও নজরুলকে স্মরণ করে চলেছে, নিজেদের মতো করে আবিষ্কার করার প্রয়াস পাচ্ছে, কান্তিহীন জীবনচর্চায় নজরুলকে নানাভাবে ধারণ করে চলেছে। বিষয়টি যেমন অহংকার ও গৌরবের, অন্যদিকে সমন্বয়ের অভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো রূপলাভ করতে পারছে না। বিষয়টি আমার কাছে খুবই উপভোগ্য। যারা জীবিকার প্রয়োজনে রাজধানীবাসী, একসময় কুমিল্লায় তারা ছিলেন সরব, বৃহত্তর পরিবেশে বিচরণ করতে গিয়ে এখন তারা কুমিল্লা-পরবাসী। তারা আমন্ত্রণ না পেলে কোনো অনুষ্ঠানে আসতে চান না, আমরাও তাদেরকে ডেকে এনে গলায় একটি একশত টাকার মেডেল অথবা দেড়শত টাকার ক্র্যাস্ট ধরিয়ে ছবি তুলে পত্রিকায় তাদেরকে রাজধানী থেকে আগত অতিথি বলে ফলাও করে ছেপে তৃপ্তির ঠেকুর তুলি। অথচ প্রদীপের নীচটা তো অন্ধকার, তাই স্থানীয় কাউকে মূল্যায়ন করার চিন্তাও মাথায় বা বিবেচনায় আসে না। এছাড়া মামু-ভাগিনার বিষয়টি তো আছে। এবার যখন জেলাপ্রশাসন থেকে নজরুল ইসলামের উপর বই লিখতে আমাকে বলা হলো। আমি পা-ুলিপি তৈরি করে কম্পোজ করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসন (সার্বিক) জনাব মোঃ নুরুজ্জামান-এর কাছে জমা দিয়ে বলেছিলাম, প্রকাশের আগে স্থানীয় বা ঢাকার কোনো নজরুল বিশেষজ্ঞ দিয়ে রিভিউ করে নিতে। একদিন পর জনাব মোঃ নুরুজ্জামান আমাকে টেলিফোনে জানালেন যে, আমি যেন সেদিনই কষ্টকরে দেখা করি। আমি গেলাম। তিনি বললেন-ডিসিস্যারের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা হয়েছে এবং জেলাপ্রশাসন বইটি ছাপবে। এ মর্মে প্রেসের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি যেন সার্বিক দায়িত্ব নিয়ে বইটির কাজ শেষ করি। ইত্যাদি। আমি জানতে চাইলাম-রিভিউ-এর বিষয়টি কী হলো। তিনি তিনটি কথা বললেন-
১.    স্থানীয়ভাবে কাউকে পা-ুলিপি পড়তে দিলে ছোটজায়গায় যেখানে সকলেই নিজের প্রতি অসম্ভব আস্থাশীল, সেখানে অন্যের কাজ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে চান না, এটা অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
২.    তিনি জানালেন যে, ডিসিস্যার ও তিনি যেকোনো দিন বদলি হতে পারেন, সুতরাং তাঁদের থাকাকালীন বইটি প্রকাশ করতে চান।
৩.    আমাকে সান্ত¦না দেয়ার জন্য বললেন, আপনাকে তো প্রশাসন থেকে বই লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া আমাদের নথিতে আপনি ‘বিশিষ্ট নজরুল গবেষক’। সুতরাং আপনার পা-ুলিপি রিভিউ করার প্রয়োজন জেলাপ্রশাসন মনে করেনি। এছাড়া ঢাকায় কারো দ্বারা রিভিউ করাতে গেলে অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে যাবে।
এ অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। বাংলা একাডেমি থেকে যাঁদের বই বের হয়েছে, তাঁদের কমপক্ষে ২/৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়। আমার বই ‘বাংলা সাহিত্যে বিহারীলাল’ বের করতে গিয়ে এ অভিজ্ঞতা হয়েছে। পরে দু’টি পা-ুলিপি জমা দিয়েও ফেরৎ নিয়ে এসেছি। এমনকি কুমিল্লা পুলিশ প্রশাসন আমার ‘বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ’ বইটি নানা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে প্রায় একবছর অতিক্রম হয়েছে। মফস্বলের বিষয়টি একটু অন্যরকম। এখানে আমরা সকলেই নিজ সিংহাসনে রাজা হয়ে বসে আছি। নিজেরা নিজেদের নামের আগে বিশেষণ বসিয়ে কোকিল সাজার বিষয়টি তো খুবই স্পষ্ট। সব ব্যাপারেই দেখেছি, কেউ কাউকে সামান্যতম পথ ছাড়তে রাজি নয়। অবস্থাটা হলো-‘বিচার মানি, তবে তালগাছটা আমার।’ এ পরিস্থিতিতে কুমিল্লায় নজরুল ইসলামকে নিয়ে একটা কিছু করতে হলে আরো উদার হতে হবে। আমার এরূপ কথায় ক্ষোভ আছে, যুক্তিও আছে। আবার অনেকের বিরাগভাজন হওয়ারও কারণ হতে হবে হয়ত। মনের ক্ষোভ নিয়ে, না বলা কথার জন্য যন্ত্রণা নিয়ে মরতে চাই না। জীবিতাবস্থায় ‘শালারপুত’ গালি দিলেও জেনে গেলাম, অন্তত সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। মৃত্যুর পর ‘মহামানব’ বলে চিৎকার করলে অন্তত আমার বিবেচনায় অর্থহীন। কাজেই নজরুলের উপর যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের যেন এসময় মূল্যায়ন করা হয়। কারণ, নজরুলকে তো মৃত ও জীবিতরা একশত বছর ধরে স্মরণ করে চলেছেন এবং ভবিষ্যতে আরও গবেষণা হবে। কারণ, কুমিল্লাবাসীর হৃদয়ে ও মননে বিশেষত সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় নজরুল চিরকালীন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন। তাতে কুমিল্লারই গৌরব বৃদ্ধি হবে।
[ষষ্ঠ পর্ব পরবর্তী মঙ্গলবারে ছাপানো হবে।]