মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন ।।
মূল আলোচনা যাওয়ার আগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সহায়তার জন্য আইনে কী সুবিধা আছে তা বলা যৌক্তিক মনে করছি। প্রতিবন্ধী বিষয়ক জাতীয় নীতিমালা-১৯৯৫ এর পটভূমিকায় বলা হয়েছে এ নীতিমালা মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সামাজিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধাসমূহ: শারীরিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশ, আবাসন এবং যানবাহন, সমাজ ও স্বাস্থ্য সেবা, শিা কর্মসংস্থান, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবন, খেলাধুলা এবং বিনোদনমূলক সকলের জন্য সহজলভ্য করা।
এছাড়া এ নীতিমালায় প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞা, প্রতিবন্ধিতার কারণ, মাত্রা এবং প্রতিবন্ধী বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের যে স্বীকৃতি/অনুসমর্থন দিয়েছে– বিশেষ করে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রতিবন্ধী সনদ (টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঃযব জরমযঃং ড়ভ ঃযব চবৎংড়হং রিঃয উরংধনরষরঃরবং) এবং বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ঘ) নং অনুচ্ছেদ এ বলা হয়েছে– ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতা-পিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে, অভাবগ্রস্ততার কারণে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার ভোগ করবে।’
এছাড়া প্রতিবন্ধীদের সুরা দেওয়ার জন্য সরকার প্রতিবন্ধী সুরা আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে। উক্ত আইনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার অনুচ্ছেদ এর (ঢ)তে শারীরিক, মানসিক ও কারিগরি সমতা অর্জন করে সমাজ জীবনের সকল েেত্র সম্পূর্ণভাবে একীভূত হওয়ার ল্েয সহায়ক সেবা ও পুনর্বাসন সুবিধা প্রাপ্তির অধিকার অর্জন করার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া প্রতিবন্ধী সুরা আইন-২০১৩ এর তফসিল-ধারা ২(৭) দ্রষ্টব্য এর কলাম-৭ এ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য চলন (গড়নরষরঃু): যে সুরা রাখা হয়েছে,
(ক) সময় সমত ও সুলভ মূল্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সর্বোত্তম স্বার্থের পরিপন্থী না হইলে, তাহার ইচ্ছা অনুযায়ী,ব্যক্তিগত চলাচলে সহায়তার নিমিত্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং তদল্েয মানসম্মত চলন সহায়ক যন্ত্র, উপকরণ, সহায়ক প্রযুক্তি এবং চলন ও যোগাযোগের েেত্র মানব সহযোগিতার লভ্যতা নিশ্চিতকল্পে পদপে গ্রহণ করা;
(খ) চলন সহায়ক যন্ত্র, উপকরণ, সহায়ক প্রযুক্তি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চলনের সম্ভাব্য সকল দিক বিবেচনা করিতে উৎসাহিত করা এবং তদল্েয গবেষণাকর্ম, পরিচালনাসহ সহায়ক উপকরণাদি আমদানির ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর রেয়াতের ব্যবস্থা করা;
আমাদের পবিত্র ইসলাম ধর্মেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে এবং যে যেমন সম তেমনই ইবাদত করার নির্দেশনা রয়েছে।
ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ বিধানে প্রতিবন্ধীদের জন্য ইবাদতের েেত্র অধিকতর সহজ এবং সহনশীলতা প্রদর্শন করছে। যে সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ একেবারেই ইসলামের বিধান মানতে অপারগ যেমন পাগল ও বৃদ্ধিপ্রতিবন্ধী/জ্ঞানহীন তাদের জন্য ইসলামের বিধান পালন করা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে সুরা বাকারায় আয়াত নং ২৮৬ তে আল্লাহপাক বলেছেন-‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনও কাজের ভার দেন না’। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন আমি তোমাদের কোনও আদেশ করি, তখন তা বাস্তবায়ন করো, যতখানি সাধ্য রাখো’। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)।
বর্তমানে সরকারি নানাবিধ উদ্যোগ, আইনি সুরা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভিন্ন পদপে বাংলাদেশে অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় অধিকতর প্রশংসনীয়। সকল প্রতিবন্ধীদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সরকারের নানাবিধ উদ্যোগগুলো কার্যকরভাবে প্রতিপালনের জন্য প্রতিটি সেক্টরকে মনোযোগ দেওয়া অতীব জরুরি। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায় আইনের বিভিন্ন অজুহাতে মহৎ এ উদ্যোগগুলো কতিপয় ছোট ছোট ত্রুটির কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। প্রতিবন্ধী মানুষকে প্রকৃত সেবা দূরের কথা রীতিমত হয়রানির স্বীকার হতে হয়।
সম্প্রতি বগুড়া জেলার একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভ্যাট, অগ্রিম কর ও অগ্রিম আয়কর মওকুফের আবেদন এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জবাব পর্যালোচনা করলে এ হয়রানি কতখানি তা অনুমান করা কিছুটা সম্ভব হবে। বগুড়া জেলার স্বাভাবিক চলাচলে অম একজন প্রতিবন্ধীর জন্য তার পরিচিত একজন বিদেশ থেকে একটি ‘ইলেকট্রনিক্স মটরাইজড হুইল চেয়ার’ ডিএইচএল কুরিয়ারে পাঠাতে চাচ্ছেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্য সংযোজন ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ এর আদলে তৈরিকৃত ট্যারিফ শিডিউল (২০২০-২০২১)। যাতে উল্লেখ আছে ঐ.ঝ পড়ফব-৮৭১৩.৯০০০-ওহাধষরফ ঈধৎৎরধমবং, গড়ঃড়ৎরুবফ ঙৎ ঙঃযবৎরিংব গবপযধহরপধষষু চৎড়ঢ়বষষবফ এখানে ঈউ=ঈঁংঃড়সং উঁঃু ০%, জউ=জবমঁষধৎরঃু উঁঃু ০%, ঝউ=ঝঁঢ়ঢ়ষবসবহঃধৎু উঁঃু ০%, ঠঅঞ=ঠধষঁব অফফবফ ঞধী ১৫%, অঞ=অফাধহপব ঞধী ৫% অওঞ=অফাধহপব ওহপড়সব ঞধী ৫%।
মূল্য সংযোজন ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ এর ৩১ ধারায় বলা হয়েছে আমদানিকারক কর্তৃক প্রদত্ত অগ্রিম কর ৫% এবং অগ্রিম আয়কর ৫% (আমদানিকারক যদি অনিবন্ধনকারী ব্যক্তি হয়ে থাকেন এবং আমদানিকৃত দ্রব্যের শেষ ভোক্তা হয়ে থাকেন) নিকটতম কমিশনার কার্যালয়ে আবেদন করে আগাম করসমূহ ফেরত পাবেন।
কিন্তু ১৫% ভ্যাট পরিশোধ করতেই হবে। এতে কোনও ছাড় পাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ব্যবহারের জন্য তৃতীয় পরে একজন লোক কোনোরূপ বিনিময় ছাড়া একটা অনুদান দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়াল, সেখানে ১৫%+৫%+৫%=২৫% ভ্যাট ও আয়কর সে কোথায় থেকে দেবে? অগ্রিম কর জমা দিয়ে আবার ফেরত নেওয়ার প্রয়োজনও বা কি? আইনে আছে, তাই ছাড় দেওয়া যাবে না। কিন্তু আইনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বিশেষ প্রয়োজন েেত্রভেদে বা প্রয়োজন মনে করলে ছাড় দেওয়ার মতা অর্পন করেছে [মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ ধারা-১২৬-উপধারা-১]।
আইনের ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় যে, ভ্যাট প্রযোজ্য হবে যখন ভোক্তা নিজে আমদানি করবেন, তখন। একজন অনুদান দিলে, যাকে অনুদান দিলেন তিনি আমদানিকারকের সংজ্ঞায় পড়েন কিনা, সেটা বিবেচনার বিষয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক জারিকৃত অতিরিক্ত গেজেট ২৮ জুন ২০১২ এর আমদানিকারকের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য প্রেরিত অনুদান গ্রহণকারী হিসেবে তিনি আমদানিকারকই নয়। যদি আমদানিকারকই না হয়ে থাকেন তাহলে তিনি ভ্যাট পরিশোধ করবেন কীভাবে?
উল্লেখিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভ্যাট ও অগ্রিম করসমূহ অব্যাহিত চেয়ে সংশ্লিষ্ট সকল দফতরে ধর্ণা দিয়ে কোনও উল্লেখযোগ্য সাড়া না পেয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে প্রতিকারের জন্য আবেদন করেন। মানবাধিকার কমিশন থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। সূত্র মতে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকেও উল্লেখিত মূসক এবং অগ্রিম করসমূহ মওকুফের সুপারিশ করা হয়। মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ করার পরও বিগত ২৫ এপ্রিল ২০২১ তারিখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর স্মারক নং ০৮.০১.০০০০.৫৪.০২.০৫১.১৭(অংশ-৩) ১৫৬ এর মাধ্যমে উক্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে উপরে উল্লেখিত ট্যারিফ শিডিউল সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া হয় এবং পত্রের ২ নং কলামে বলা হয় ‘এমতাবস্থায়, উপরোল্লিখিত বিষয়সমূহ বিবেচনায় আলোচ্য েেত্র অব্যাহিতর কোনো প্রয়োজন নেই মর্মে বর্ণিত বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক অপারগতা জ্ঞাপন করা হলো।’
এখানে আইনে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুরা দেওয়ার সুযোগ থাকলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তা এড়িয়ে গিয়ে রাজস্ব আহরণের অজুহাত দিয়ে এজন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বিগত ৬ মাস হয়রানি করানো কোনও অবস্থায় কাম্য হতে পারে না।
জাতীয় রাজস্ব আদায়ের বহু গুরুত্বপূর্ণ খাত রয়েছে, যে খাতগুলো থেকে অনায়াসে রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব। বাস্তবে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে সরকারি কর্মকর্তাগণ/ভিআইপি/রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ বিদেশ ভ্রমণে গেলে নানাবিধ ব্যবহার উপযোগী দ্রব্যাদি নিয়ে আসেন, সেখানে পারত পে কোনও শুল্ক আদায়ের কোনও তৎপরতা দেখা যায় না। অথচ একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য একটা হুইল চেয়ার পাওয়ার েেত্র জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অপরাগত দেখানো আমাদের জন্য কতটুকু স্বস্তিকর তা বিবেচনার বিষয়!
এটা একটা উদাহরণ। জানা-অজানা বহু ঘটনা আমাদের সমাজে বিরাজমান। প্রতিটি প্রতিবন্ধীর ব্যক্তির জন্য আমদানিকৃত সকল প্রকার ব্যবহৃত পণ্যের ওপর সকল ধরনের শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করা যৌক্তিক। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি মানবিক হয়ে এ কাজে সকলে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসা উচিত এবং সরকারের গৃহিত কার্যক্রমকে সম্মান জানানো উচিত। এতে মূলত সম্মান জানানো হবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গৃহিত পদপেগুলোকে। তাই আগামী বাজেট এ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়ক চলনযন্ত্র আমদানিতে অযাচিত ভ্যাট, অগ্রিম কর, অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার করার যৌক্তিক দাবি জানাচ্ছি।
আইনের বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি থেকে মুক্ত হোক প্রতিবন্ধী প্রতিটি মানুষ। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সেও মানবিক মর্যাদায় গড়ে উঠুক সমাজে। এ প্রত্যাশা সকলের কাছে।
লেখক: আয়কর আইনজীবী