রণবীর ঘোষ কিংকর ||
হারিয়ে
যাওয়া বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন পূনরুদ্ধারে কুমিল্লার চান্দিনা ও
দেবীদ্বারে চরকায় সুতা কাটা শুরু হয়েছে। এখানকার ২টি কারখানায় তৈরিকৃত
সুতায় এ পর্যন্ত ৫টি মসলিন শাড়ি, ৭টি মসলিন ওড়না ও ৬টি নমুনা কাপড় তৈরি
করতে সক্ষম হয়।
কুমিল্লার ওই দুই উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা সোনাপুর ও
রামপুরে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া মসলিন সুতা দিনে দিনে সূক্ষ থেকে
সূক্ষতর হচ্ছে। ৮ মেট্রিকাউন্ট থেকে বর্তমানে ৫৫৬ মেট্রিকাউন্ট সূতা তৈরি
করছেন এখানকার তাঁতীরা। যা প্রকল্পের সাফল্য বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বস্ত্র
ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ‘বাংলাদেশের
সোনালী ঐতিহ্য মসলিন তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ এর
আওতায় চান্দিনা উপজেলার সোনাপুর, দেবীদ্বার উপজেলার রামপুর গ্রামের অন্তত
৪৯টি চরকায় সুতা তৈরির কাজ করছেন নারীরা। যার মধ্যে চান্দিনার সোনাপুর
কারখানায় ৩৭টি চরকা।
কেউবা মাসিক বেতনে আবার কেউবা দৈনিক বেতনে ‘মসলিন’
এর সুক্ষ সুতা তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফুটি কার্পাস তুলা নামের বিশেষ এক
ধরণের তুলা দিয়ে তৈরিকৃত ওই সুতায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ তারাবো এলাকায়
হ্যান্ড লুমে বুনন করা হয় মসলিন শাড়ি। যা বাংলার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করেছে
অন্তত ১৬৫ বছর পর।
বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়- ‘মসলিন’ শব্দটি এসেছে
ইরাক থেকে। বিশেষ ওই শাড়ি ইরাকের ‘মসুল’ নামক একটি স্থানে বিক্রি ও
অতিসূক্ষ কাপড় তৈরি করার ফলে তৎকালিন ইংরেজরা মসুল ও সূক্ষ এই দুইয়ের
সমন্বয়ে কাপড়টির নাম দিয়েছিল ‘মসলিন’। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে মসলিন বলতে
তৎকালীন ঢাকা ও তার পাশ্ববর্তী এলাকায় তৈরিকৃত সূক্ষ কাপড়কে বুঝায়। মোঘল
স¤্রাট জাহাঙ্গীর তার স্ত্রী নূরজাহানকে মসলিন কাপড় দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব
দিয়েছিলেন।
কাঁচের মত স্বচ্ছ ওই মসলিন কাপড় একটি আংটির ভিতর দিয়ে
অনায়াসে আনা-নেওয়া করা যেতো এবং একটি দিয়াশলাই বক্সে রাখা যেতো বলেও
জনশ্রুতি রয়েছে।
১৮৫৬ সালের ইংল্যান্ডে মসলিন প্রদর্শণীর পর বাংলাদেশ
থেকে বিলুপ্ত হয় ঐতিহ্যবাহী ও রাজসিক মসলিন শাড়ি। আর পুনরুদ্ধার হয় ২০১৮
সালের শেষ দিকে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের
উদ্ভিদ বিজ্ঞান মাঠ, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে গাজীপুরের শ্রীপুর খামার,
নরসিংদীর পলাশ এলাকার তাঁত বোর্ডের মাঠে বিশেষ ফুটি কার্পাস তুলা চাষাবাদ
হচ্ছে। সেই তুলায় চান্দিনার সোনাপুর ও দেবীদ্বারের রামপুর এলাকার ২টি
কারখানায় তৈরি হচ্ছে চরকায় কাটা সূক্ষ ওই সূতা।
প্রকল্প পরিচালক ও তাঁত
বোর্ডের প্রধান (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) মো. আইউব আলী জানান- ১৮৫৬ সালের পর
বাংলাদেশে আর মসলিন তৈরি হয়নি। পাকিস্থান শাসনামল থেকে শুরু করে
বাংলাদেশের ৪০ বছরেও কেউ উদ্যোগ নেয়নি। ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাট ও বস্ত্রমন্ত্রণালয় পরিদর্শণে এসে ‘মসলিন’
পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেন। তারপর থেকে শুরু হয় গবেষণা।
রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গবেষণা করে ‘ফুটি কার্পাস’ তুলা চাষ করে সাফল্য
এনে দেন। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ
তাঁত বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ‘বাংলাদেশ সোনালী ঐতিহ্য মসলিন তৈরির প্রযুক্তি
ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ শুরু করেন।
তিনি জানান- ওই
প্রকল্পের অধীনে ৪০জনের মধ্যে ৬জনকে বাঁছাই করে চান্দিনার সোনাপুরে
প্রশিক্ষণ দিয়ে শুরু করা হয় চরকায় সুতা তৈরির কাজ। হাতের চরকায় প্রথম দিকে
৮-১০ মেট্রিকাউন্ট সুতা তৈরি করলেও বর্তমানে ৫৫৬ মেট্রিকাউন্ট মিহি সুতা
তৈরি করছে এখানকার তাঁতীরা। চান্দিনা ও দেবীদ্বারের চরকায় তৈরি সুতায় প্রথম
দিকে ৬টি নমুনা কাপড় তৈরি করা হলেও পরবর্তীতে ৫টি শাড়ি তৈরি হয়। এর মধ্যে
পরীক্ষা মূলক প্রথম শাড়িটি ২০১৮ সালের ১লা নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে উপহার
দেওয়া হয়।
প্রকল্প পরিচালক আরও জানান- ফুটি কার্পাস তুলায় প্রতিটি শাড়ি
তৈরিতে খরচ হচ্ছে ৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। বাংলার ঐতিহ্য মসলিন পুনরুদ্ধার
করতে আমাদের প্রকল্প নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
সোমবার (২৪ মে) চরকায়
সুতা কাটার কাজ পরিদর্শণে আসেন জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড.
মো. সহিদুল্লাহ, যুগ্ম সচিব ও বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন
কমিটির সদস্য গাজী মো. রেজাউল করিম, উপ-সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান। এসময়
উপস্থিত ছিলেন চান্দিনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বিভীষণ কান্তি দাশ,
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মো. মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখ।
ওই প্রকল্পের অধীনে মসলিন সুতা কাটার চরকা আরও বৃদ্ধি করাসহ চান্দিনায় শাড়ি তৈরির হ্যান্ডলুম স্থাপন করার আহবান জানান স্থানীয়রা।
মাধাইয়া
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. অহিদ উল্লাহ জানান- এক সময়ের কুমিল্লা ঐতিহ্য
খাদি কাপড় তৈরি, সুতা কাটার কাজ বেশি হতো চান্দিনার সোনাপুর, কলাগাঁও,
বাখরাবাদ, বেলাশহর, ভোমরকান্দিসহ বিভিন্ন স্থানে। এখানকার মানুষ এক কাজে
বেশ পারদর্শী ছিল। তাই মসলিন সুতা কাটার চরকা বৃদ্ধিসহ হ্যান্ডলুম স্থাপন
করলে একদিকে এ এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে অপরদিকে ঐতিহ্যবাহী
মসলিন কাপড় তৈরির পরিমানও বাড়বে।