ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ||
করোনাভাইরাসের প্রভাবে তিগ্রস্তের তালিকা বেশ লম্বা। সব খাতে তির পরিমাণ নিরূপণ করা গেলেও মানবসম্পদ বিশেষ করে শিার তি সেভাবে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তার পরও আমাদের পিপিআরসি গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। যার মাধ্যমে অন্তত শিায় করোনার প্রভাব স্পষ্ট হচ্ছে। বিআইজিডির সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক স্তরের এক-পঞ্চমাংশ ও মাধ্যমিক স্তরের এক-চতুর্থাংশ স্কুলগামী শিশু শিণ ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে। শিাপ্রতিষ্ঠান খোলা আরও দীর্ঘায়িত হলে শিশুর শিণ ঝুঁকি আরও বাড়বে- এটাই স্বাভাবিক। ২০২০ সালের মার্চের মাঝামাঝি থেকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের শিাব্যবস্থায় বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। যেসব শিশু সমাজের দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত, তাদের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন। অনেক দিন ধরে বন্ধ থাকার ফলে শিায় ঘাটতি, শিার্থীদের ঝরে পড়া, মানসিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাসহ দীর্ঘমেয়াদি নানান ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমরা জানি, স্বাভাবিক সময়েই অর্থাৎ চলমান মহামারির আগে মাধ্যমিক স্কুলগামী শিশুর একটি বড় অংশ (২১%) ও প্রাথমিক স্কুলগামী শিশুর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ (১৪%) ঝরে যেত। গ্রামের চেয়ে শহরের বস্তিতে থাকা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশুদের এ ঝরে পড়ার হার বেশি। মহামারিতে শিাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিার্থীদের রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। ২৩ মে সমকালেরও শীর্ষ প্রতিবেদনে এসেছে, 'করোনায় ল-ভ- শিা ব্যবস্থা'। এর ফলে বিপাকে সাড়ে চার কোটি শিার্থী ও ৫০ লাখ শিক। যদিও এ সময় আনুষ্ঠানিক শিা কার্যক্রম বন্ধ ছিল; তবুও 'কভিড ইমপ্যাক্ট অন এডুকেশন লাইফ অব চিলড্রেন' শিরোনামের আমাদের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, অধিকাংশ শিার্থী ছয়টি উপায়ে তাদের পড়াশোনা চালিয়েছে। এগুলো হলো- তদারকিবিহীন নিজস্ব পড়াশোনা, পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় পড়াশোনা, অনলাইন বা টিভির মাধ্যমে দূরবর্তী শিণ, কোচিং/প্রাইভেট এবং স্কুল থেকে মাদ্রাসায় ভর্তি। তবে এসব েেত্রও অনেক অনিয়ম ছিল, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আমাদের পর্যবেণে শিশুদের মাঝে যে ব্যাপক শিণ ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব কিন্তু ভয়াবহ হতে পারে। সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ভবিষ্যতে শিার্থীর শেখার মতা কমে যাবে এবং একই সঙ্গে ঝরে পড়ার হার বাড়বে। আমরা দেখেছি, বিশেষত গত বছরের মাঝামাঝি পর্যায়ে প্রশাসনের দূরবর্তী শিণের ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। বিশেষ করে টিভিতে সূচি অনুযায়ী শিণ পরিচালনা করা হয়। কিন্তু দূরবর্তী শিণের জন্য যে সুবিধা থাকা দরকার, তা আছে বা ব্যবহার করছে খুব কম শিার্থী। ফলে সরকারি ও বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে করোনাকালে লেখাপড়া শেখার হারও কম। তবে এটা সত্য যে, এ সময় কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানো টিউশনে যাওয়ার প্রবণতা সে অর্থে কমেনি। পড়াশোনায় যুক্ত থাকার আরেকটি পদ্ধতি হলো বাবা-মা ও ভাইবোনের সহায়তায় পড়া। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ের চেয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে এই সহায়তাপ্রাপ্তির হার কম। মাদ্রাসায় বদলি হওয়ার প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। মাধ্যমিকের চেয়ে প্রাথমিক শিার্থীদের জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার খরচও বেড়েছে।
যদিও এখন প্রায় সব অভিভাবকই তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী; তবুও অর্থনৈতিক অবস্থা এ েেত্র গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অথচ এ সময়ে নানা কারণেই শিার খরচ বেড়েছে। ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মার্চ অবধি শিা খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। ফলে শিার সুযোগপ্রাপ্তিতে সংকট তৈরি হয়েছে। এ সময়ে স্কুলগামী শিশুর অনেকেই কোনো না কোনো উপার্জন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। এখানে ছেলে ও মেয়ে উভয় শিশুই সে কাজ করছে। গ্রামাঞ্চলে যেখানে শহরের তুলনায় মানুষের আয় ও কাজের ভালো সুযোগ রয়েছে, সেখানেও এই হার বেশি।
শিার্থীরা যেভাবে দীর্ঘ সময় আনুষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরে রয়েছে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকরা শিার এই ঘাটতি নিয়ে যেমন চিন্তিত, তেমনি সন্তানদের ঘরে পড়াশোনার প্রতি অনুৎসাহ নিয়েও কম চিন্তিত নন। তার সঙ্গে শিার ব্যয়ভারও যেভাবে বাড়ছে, তা নিয়েও অভিভাবকদের শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে।
আমরা দেখছি, শিাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে সৃষ্ট প্রধান সংকটগুলো হলো- শিণ ঘাটতি, শিা ব্যয় বৃদ্ধি এবং সামাজিকীকরণের সমস্যা। এ পর্যায়ে শিার ঘাটতি ঠেকাতে, শিায় অনাগ্রহ কমাতে এবং অভিভাবকদের শিা-সংক্রান্ত আশঙ্কা দূর করতে পুনরায় শিাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া দরকার। সরকার যখন সবকিছু খুলে দিচ্ছে, একই সঙ্গে শিাপ্রতিষ্ঠানও দ্রুত খুলতে পারে। সে েেত্র শ্রেণিকরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনাসহ শিার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ- যাবতীয় ব্যবস্থা শিাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা চাই। কভিড-পরবর্তী পর্যায়ে মানবসম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য অতিরিক্ত কার্যক্রম, কাসের বাইরের শিণ কর্মসূচিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। নইলে আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ শুধু শিা থেকেই দূরে সরে যাবে না, অদ হিসেবেও বেড়ে উঠবে।
শিা খাতে করোনায় যে তি হয়ে গেছে, তা পোষাতে বেশ সময় লাগবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে তি পোষাতে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। বাজেট সামনে রেখে এ বিষয়ে বিশদ ভাবা যেতে পারে। দেশে প্রচলিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বৃত্তি প্রদান কর্মসূচিকে শিা খরচ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। শিার্থীদের আগে শিাবৃত্তি হিসেবে ১০০ টাকা করে প্রদান করা হতো। এবার তা বাড়িয়ে ৫০০ করলে অনেক পরিবার উপকৃত হবে। এতে আমাদের হিসাবে সরকারের ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ২৯৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রয়োজন হবে। সরকার যেহেতু আগামীর বাজেটে করোনার প্রভাব মোকাবিলায় বাড়তি ব্যয়ের পরিকল্পনা করছে, সেহেতু এ বরাদ্দ শিার স্বার্থেই করা দরকার।
প্রায় প্রতিবছরই বলা হয় শিায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হবে। কিন্তু সে অর্থে শিার বরাদ্দ বাড়ে না। ইউনেস্কোর প থেকে শিা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলেও বাংলাদেশে এ বরাদ্দ জিডিপির হিসাবে ২ শতাংশ কিংবা তার আশপাশেই ঘুরপাক খায়। এমনকি ২০২০-২১ অর্থবছরেও সরকারের প থেকে বলা হয়, করোনা মোকাবিলায় শিা খাতে বরাদ্দের প্রাধান্য থাকবে, সেটিও ছিল জিডিপির ২ দশমিক ০৯ শতাংশ মাত্র। আমাদের অনুধাবন করা প্রয়োজন, বাংলাদেশের এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা দ জনশক্তির অভাব। যেটা আমি আগেও বলেছি, সস্তা শ্রমিকের আমাদের অভাব নেই, কিন্তু দ শ্রমিক নেই। ফলে আমরা দেখছি, যখন তৈরি পোশাকসহ বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানেই টপ লেভেলের উল্লেখযোগ্য জনশক্তি বিদেশ থেকে এসে বাংলাদেশে উচ্চ বেতনে কাজ করছে। এই দ জনশক্তি তৈরি না হওয়ার অন্যতম কারণ আমাদের মানসম্মত শিার অভাব। শিায় এনরোলমেন্ট বাড়ছে বটে, কিন্তু ঝরে পড়া থেমে নেই। আবার মানের সমস্যাটাই সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। শিায় বরাদ্দ না বাড়ালে শিার মান কীভাবে নিশ্চিত হবে?
শিায় করোনায় সৃষ্ট তি কমাতে সরকারকে অবস্থার আলোকে শিাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিাপ্রতিষ্ঠান খুলতে দেরি হলে শিার্থীর তিও বাড়বে। সে জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে প্রয়োজনীয় ব্যয় বরাদ্দ রাখা চাই। শিাবৃত্তির পরিমাণ ৫০০ টাকা করার পাশাপাশি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা শিাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ সংশ্নিষ্ট সবকিছু বাজেটে বরাদ্দ রাখা দরকার।

এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, পিপিআরসি; চেয়ারপারসন, ব্র্যাক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা