ড. নাদির জুনাইদ ||
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার উঁচু মান না থাকা, গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রাপ্তির প্রতি কিছু শিকের বেশি আগ্রহ দেখানো প্রভৃতি ঘটনার জন্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত কিছু কলামে ল্য করি সমালোচনা করা হচ্ছে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকদেরই। যেন এই সমস্যাগুলোর জন্য একমাত্র শিকরাই দায়ী, অন্য আর কোনো পরিস্থিতির ভূমিকা নেই। যারা এমন সমালোচনা করেন, তারা ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর ওপর সামাজিক ব্যবস্থা এবং পরিবেশের জোরালো প্রভাব সম্পর্কে সচেতন নন বা এই সম্পর্কে জানেন না তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তার পরও যখন দেখতে হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার জন্য বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থার দায় বিশ্নেষণ না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকদেরই কেবল প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে, তখন সমালোচনা করার সময় সমস্যার গভীরে দৃষ্টি দেওয়া হয়নি তা-ই স্পষ্ট হয়।
সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরস্পরকে প্রভাবিত করে এই অতি সহজ কথাটি মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তার পরও বলতে হলো কারণ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যার জন্য একমাত্র শিকদেরই দায়ী করছেন, তারা এই দিকটি এড়িয়ে যাচ্ছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয় যে, সমাজের টিকে থাকা বিভিন্ন নেতিবাচক দিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রভাবিত করবে না। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে সমস্যা দেখা যাচ্ছে, তার জন্য কিছু শিকের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, সংবাদমাধ্যম, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন নেই? সামাজিক ব্যবস্থার অপকারী দিকগুলো নির্মূল করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর গোষ্ঠী মিলিতভাবে উদ্যোগ না নিলে কেবল শিকরা চাইলেই কি সমাজ আর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদ্যাসাধনার জন্য তিকর দিকগুলো দূর হয়ে যাবে?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যা টিকে আছে বিদ্যমান ব্যবস্থার জন্য। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত 'হীরক রাজার দেশে' (১৯৮০) ছবিতে উদয়ন প-িতের মতো শিক তো ছিলেন; কিন্তু তিনি কি জি হুজুরের দলদের থামাতে পেরেছিলেন? পাঠশালা যখন রাজা বন্ধ করে দিলেন- কৃষক, শ্রমিক, গ্রামের বাউল যখন নিপীড়িত হচ্ছিল, উদয়ন প-িত কি একা সেই সব অন্যায় বন্ধ করতে পেরেছিলেন? পরে গুপী-বাঘা আর অন্যদের অংশগ্রহণে যখন বিপ্লব হলো, তখনই কেবল সেই রাজ্যের পীড়নমূলক ব্যবস্থা ভেঙে গেল।
হীরক রাজ্যে অন্যায় টিকে থাকার জন্য তাই যেমন উদয়ন প-িতকে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে বলার যুক্তি ছিল না, তেমনি শিার্থীদের জ্ঞান এবং চিন্তার গভীরতা অর্জন করতে অনুপ্রাণিত করেন এমন বিদ্যানুরাগী শিকদেরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়মের ব্যাপারে প্রশ্নের মুখোমুখি করা অযৌক্তিক। কারণ তারা নিজ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ইতোমধ্যেই ব্যথিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ভালো মান নিশ্চিত করার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের মতা কতটুকু যে, চেষ্টা করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বৃহৎ সমস্যার অবসান তারা ঘটাতে পারবেন? জ্ঞান সাধনার পরিবর্তে নানা পদ প্রাপ্তির প্রতিই যে শিকদের আগ্রহ বেশি, তাদের কেবল প্রশ্ন করলেই তারা নিজেদের বদলে ফেলবেন না। সামাজিক ব্যবস্থা যদি তাদের পুরস্কৃত করতেই থাকে, তাহলে এমন শিকদের অগ্রহণযোগ্য আচরণ বন্ধ হবে কি?
সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে আলাপচারিতায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকও বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরো সমাজের চেয়ে ভিন্নভাবে সততা আর ন্যায়পরায়ণতা টিকে থাকবে- এমন আশা বাস্তবসম্মত নয়। সমাজে যদি অবয় দৃশ্যমান হয়, বিশ্ববিদ্যালয়েও অবয় দেখা যাবে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে কিছু ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক মতার দাপট দেখানোর যে চর্চা দীর্ঘদিন ধরে টিকে আছে, সেই অবস্থার সমাধান তো করতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা যদি মতা দেখানোর সংস্কৃতি পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যান করে, কেবল তখনই বন্ধ হবে এমন একটি অশুভ চর্চা। দেশের বিদ্যমান সংস্কৃতি চর্চার রূপ মানুষের মন যেভাবে প্রভাবিত করে, তার কারণেও বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়। কম বয়সীদের রুচি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, প্রভাবিত হয় পরিবার আর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও। লম্বা সময় ধরেই ল্য করছি আমাদের সমাজে বিনোদনধর্মী সংস্কৃতির এবং শোবিজ জগতের নানা দিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিার্থীর নখদর্পণে, কিন্তু দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের গভীর বক্তব্যধর্মী উপন্যাস, বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের লেখালেখি, বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র, এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে কম বয়সীদের ধারণা দিন দিন কমছে।
গণমাধ্যম-সৃষ্ট একজন নায়ককে পথে দেখলে বহু কম বয়সীই চিনবে, কারণ এই নায়করা গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচার পান। কিন্তু অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা বা খ্যাতিমান সাহিত্যিক, অধ্যাপক, বৈজ্ঞানিককে নিজেদের পাশে দেখলেও বহু কম বয়সীই চিনতে পারবে না। কারণ তাদের পরিচিত করে তোলার যথেষ্ট উদ্যোগ এই সমাজে নেওয়া হয় না। শ্রেণিকে শিার্থীরা প্রতি সপ্তাহে মাত্র কয়েক ঘণ্টা চিন্তাসমৃদ্ধ আলোচনা শুনে কাটায়। আর মূলধারার গণমাধ্যম দেখা আর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার মাধ্যমে তাদের দীর্ঘ সময় কাটে প্রতিদিন। হালকা বিনোদনধর্মী উপাদানের নিয়মিত এবং অধিক প্রচার দ্বারা রুচি প্রভাবিত হলে সেই মনে বিদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে চিন্তার গভীরতা অর্জনের আহ্বান গুরুত্ব পাবে না। যদি কম বয়সীরা ছোটবেলা থেকেই অগভীর উপাদান গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, সে েেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র কয়েক বছরে শিকদের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক শিার্থীকেই চিন্তাশীল বিষয়ে আগ্রহ না থাকার অভ্যাস থেকে মুক্ত করা যায় না।
ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর থেকেই ছাত্রছাত্রীরা অধ্যয়নরত বিষয়ের লেখাপড়ার পরিবর্তে বিসিএস পরীার গাইড বই পড়তেই বেশি মনোযোগী হয়ে উঠছে- এমন কথা শোনা যায়। বাস্তবতার কারণে যদি শিার্থীরা ছাত্রজীবনে জ্ঞানসাধনায় নিজেকে নিবেদিত না রেখে একটি বিশেষ চাকরি প্রাপ্তির জন্য গ-িবদ্ধ পড়ালেখায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাচর্চার উঁচু মান প্রতিষ্ঠা করা তো সম্ভব নয়। যদি একটি মাত্র চাকরিকেই সমাজে অন্যসব চাকরি এবং উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় করে ফেলা হয়, সেই দায় কার এবং এতে করে সমাজের রূপ কেমন হবে? এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া সাদামাটা আর সহজ করে ফেলার সুযোগ নেই। রুশ নাট্যকার আন্তন চেখভ বলেছিলেন, সাধারণ মানুষ যদি রুশ ঔপন্যাসিক নিকোলাই গোগোলের লেখা বুঝতে না পারে, তাহলে গোগোলের লেখা সহজ করার পরিবর্তে মানুষের চিন্তাশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করা প্রয়োজন, যেন গোগোলের বক্তব্য তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদি স্কুল-কলেজেই ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার একটি মজবুত ভিত্তি তৈরি না হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু মানের সঙ্গে তাল মেলানো শিার্থীদের জন্যও কঠিন হয়। তাই দেশের বিভিন্ন গ্রাম এবং শহরে যে স্কুলগুলো আছে, সেখানে লেখাপড়ার ভালো মান যদি রাখা না যায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাচর্চার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রশ্ন করতে হয়, স্কুলশিকদের কি যথেষ্ট মর্যাদা এবং অর্থ বর্তমান সময়ে দেওয়া হয়, যার কারণে মেধাবী মানুষেরা স্কুলশিক হতে আগ্রহী হবেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য শিক-শিার্থী উভয়েরই আন্তরিক আগ্রহ যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজন মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়ার মানের উন্নয়ন এবং সামাজিক পরিবেশে জ্ঞানসাধনার গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন। জ্ঞানের পরিবর্তে প্রভাবশালী পদ প্রাধান্য দেওয়ার প্রথা এবং অগভীর সাংস্কৃতিক উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত প্রচার চালু রেখে সমাজে বিদ্যাচর্চার প্রসার ঘটানো যায় না। মতাশালীদের অনৈতিক নির্দেশ যারা মেনে নেন না, শিার উঁচু মান টিকিয়ে রাখার গুরুত্ব যাদের কাছে সবচেয়ে বেশি, এবং সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ করার নৈতিক দৃঢ়তা যাদের আছে, এমন বিচণ এবং বিদগ্ধ শিকরাই যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পান, তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে কাঙ্তি পরিবর্তন। বিদ্যা-আসক্ত এবং আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিরাই তখন শিক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাবেন। বলা বাহুল্য, বেশিরভাগ শিক চাইলেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে না। শিকদের সঙ্গে উদ্যোগী হতে হবে রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গকেও। কেবল তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে থাকা সমস্যাগুলো আর থাকবে না।
অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়