নাজনীন আহমেদ ||
সরকার
ঘোষিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে কোভিড উদ্ভূত অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
মোকাবিলার মূল হাতিয়ার হিসেবে নেওয়া হয়েছে শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে
কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে। রফতানিনির্ভর এবং দেশীয় বাজারনির্ভর উভয় প্রকার
শিল্পের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো
কাঁচামালের ওপর শুল্ক কমানো আবার শিল্পে উৎপাদিত শিল্পপণ্যের ওপর সম্পূরক
শুল্ক কিংবা সারচার্জ কমানো,ভ্যাট কমানো এসব উদ্যোগ শিল্পের বিকাশকে
উৎসাহিত করবে। এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল পণ্য উৎপাদনকারী
শিল্প, ওষুধ শিল্প, কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, লাইট
ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, হাঁস-মুরগি-মাছের
খাবার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, এদের কলেবর বাড়ার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের
সুযোগ তৈরি হবে। তবে একটু লক্ষণীয় যে এই সুযোগ-সুবিধাগুলো নিতে পারবে মূলত
মাঝারি থেকে বড় শিল্পগুলো। অতি ক্ষুদ্র, কিংবা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য
বিশেষ কোনও কিছু এই বাজেটে নেই। তারা হয়তো পরোক্ষভাবে কাঁচামালের ওপরে
শর্করা সে সুবিধা পাবেন তবে তাদের অনেকেরই পুঁজির সহায়তা দরকার হবে। তাই এই
বাজেটে মূলত শিল্পের বহুমুখীকরণের প্রচেষ্টা থাকলেও তাতে অতি ক্ষুদ্র,
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা কম। হয়তো কৃষি যন্ত্রপাতি
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রী প্রস্তুতকারী অতি
ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান কিছুটা উপকার পাবে।
আসন্ন বাজেটে করপোরেট
কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বিভিন্ন খাতে। এ উদ্যোগ ইতিবাচক। কিন্তু
মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট কর
বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা এই সময়ে ঠিক হয়নি। এসব প্রতিষ্ঠানের কর বৃদ্ধি
স্বাভাবিক অর্থনৈতিক অবস্থায় করা যেতে পারতো। এখন যেহেতু একটি জরুরি
অবস্থায় মোবাইলভিত্তিক অর্থ আদান-প্রদান জরুরি এবং ব্যাপকভাবে মানুষ
ব্যবহার করে, তাই এইটা না বাড়ানোই ভালো।
বর্তমান বাজেটে নারী
উদ্যোক্তাদের কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত
টার্নওভারের ওপরে তাদের কর দিতে হবে না। এই সুবিধা নারী উদ্যোক্তাদের
ব্যবসায় উৎসাহিত করবে। তাছাড়া ডে-কেয়ার সেন্টার যারা গড়ে তুলতে চান, এমন
নারী উদ্যোক্তারা কিছু সুবিধা পাবেন, যা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে নারীর
অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায়। তবে মোবাইল আর্থিক সেবার খরচ যদি বাড়ে, তাহলে
অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে যেসব নারী ব্যবসা বাণিজ্য করেন, তাদের
ব্যবসার অর্থ আদান-প্রদানের কিছুটা সমস্যা হতে পারে।
প্রস্তাবিত বাজেটে
নারীর স্বাস্থ্যকথা বিবেচনা করে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর ভ্যাট
প্রত্যাহার করা হয়েছে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করি। সেক্ষেত্রে
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কিছু সুবিধা দিলে স্যানিটারি ন্যাপকিনের
মূল্য প্রান্তিক নারীদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে বলে মনে করি।
স্বাস্থ্য
খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ
গত বছরের মতোই আছে এবং লক্ষ্যগুলো একই রকম। এর মূল কারণ হলো চলমান গত বছর
বাজেট ঘোষণার সময় স্বাস্থ্য খাতের জন্য যে কার্যক্রমের টার্গেট করা হয়েছিল,
তার অনেকগুলোই বাস্তবায়ন হয়নি। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ে আইসিইউ-সহ অন্যান্য
আধুনিক স্বাস্থ্য সুবিধা দেওয়া, সেই সংক্রান্ত লোকজনের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি
বিষয়গুলো এখনও অর্জিত হয়নি। তাই আসন্ন নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য যে
বরাদ্দ তাতে সেই পুরনো অঙ্গীকারগুলো আবার এসেছে। আর আমরা যদি গত বছরের
বাস্তবায়নের হার দেখি তবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি নিয়ে খুব উৎসাহিত
হওয়ার কিছু নেই, যদি না তা ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় এবারও।
প্রস্তাবিত
বাজেটে পরিবহন খাতের ব্যয় বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এই পরিবহন খাতে অনেক মেগা
প্রকল্প আছে। সেগুলোর বাস্তবায়নে যদি অগ্রগতি হয়, তাহলে তা অর্থনৈতিক
অগ্রগতি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। অনেকেই মতামত দিয়েছেন যে
মেগা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ না দিয়ে সেগুলো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির
নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি সেটা মনে করি না। বরং মেগা প্রকল্পগুলো যত
দ্রুত বাস্তবায়ন হবে তত অপচয় কম হবে এবং তার মাধ্যমে মানুষ নিজেই জীবিকা
খুঁজে নিতে পারবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায়
নতুন কোনও উদ্যোগের কথা বলা হয়নি; বরং চলমান কর্মসূচিগুলোর কলেবর বৃদ্ধির
কথা রয়েছে। তবে করোনার কারণে নতুনভাবে দরিদ্রদের জন্য ক্যাশ সহায়তার বিষয়টি
রয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানিকৃত মোবাইল ফোনের ওপর অতিরিক্ত শুল্কের
কথা বলা হয়েছে। এ কারণে মোবাইলের দাম বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এটি ঢালাওভাবে
সব মোবাইলের জন্য না করে শুধু দামি মোবাইলের জন্য কর বাড়ানো যেতে পারে।
কারণ, এখন শিক্ষাব্যবস্থা অনলাইনে হচ্ছে। অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতিতে
অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয় ডিভাইস, যেমন স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ না থাকার কারণে
দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে ঠিকভাবে অংশ নিতে
পারছেন না। তাই তাদের জন্য কম দামি মোবাইল যাতে হাতের নাগালে আসে সেজন্য কম
দামি মোবাইলের ওপরে শুল্ক কমানো উচিত। বাজেটে অবশ্য দেশি মোবাইল
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা লাভ করে সে জন্য
মোবাইল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের ওপর শুল্ক কমানো হয়েছে। কিন্তু এসব
প্রতিষ্ঠান তাদের কলেবর বাড়িয়ে এখনই দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না।
আমাদের অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় কম খরচের মোবাইল দরকার এখনই। তাই আমদানিকৃত
অল্প দামি মোবাইলের ওপর এ বছর শুল্ক বাড়ানো ঠিক হবে না। বেশি দামি
মোবাইলের ওপর কর বাড়ানো যেতে পারে।
লেখক: সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)।