শাহীন আলম, দেবিদ্বার ।
আরিফুল ইসলাম, কুমিল্লা সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। পাশাপাশি দেবিদ্বার সদর এলাকার একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। তার বাড়ি দেবিদ্বার উপজেলার রাধানগর গ্রামে। বাবা-মা, এক ভাই ও দুইবোন নিয়ে তার অভাবের সংসার। ছোট দুই বোনের মধ্যে একজন ১০ম শ্রেনী ও অন্যজন ৭ম শ্রেণীতে পড়ছে। বড় এক ভাই বেকার আর বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। অভাব অনটনের সংসারে মাস ছয়েক আগে বাধ্য হয়ে শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি এখন ডেইলি রোজে রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করছেন।
আরিফুল ইসলাম জানান, পুরো রমজান মাস রাজমিস্ত্রীর কাজ করেছি। উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়েই এ কাজ শুরু করেছি। আমরা অনেক বেলা না খেয়েও দিন পার করেছি। স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ার পর থেকে অভাব অনটনে সংসার চালানো হিমসীম খেতে হচ্ছে। আরিফুল ইসলামের মত শিক্ষকতা পেশা বদলিয়েছন বিবিএ’র ৩য়বর্ষের ছাত্র ফরহাদ আহমেদ নাহিদ, তার বাড়ি উপজেলার গুনাইঘর ইউনিয়নের রামপুর গ্রামে। তিনি বলেন, ঢাকার কয়েকটি কোম্পানীর সাথে আলাপ হয়েছে। সুবিধাজনক বেতন পেলে চলে যাব। ইয়াসমিন আক্তার, ডলি আক্তার, সোনিয়া বেগম, বিএডপ্রাপ্ত শিক্ষক রওশনারা বেগম, ইংরেজিতে অর্নাসের ছাত্র মো. আলাউদ্দিন, সাইফুল ইসলাম সাইম, মো. আল-আমিন তারা সবাই বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
সাথে কথা হয় তাদের। অভাব অনটনে টিকতে না পেরে আল-আমিন ও মো. শাহজাহান ঢাকার একটি গার্মেন্স ফ্যাক্টরিতে চাকরি নিয়েছেন। ইয়াসমিন, ডলি সোনিয়া বেগম বাসায় টেইলার্সের কাজ করছেন নিয়মিত। ইংলিশে অর্নাসের শেষ বর্ষের ছাত্র মো. আলাউদ্দিন একটি মসজিদে ইমামতি করছেন। সাইফুল ইসলাম সাইম এনজিওতে চাকরি করছেন। বিএডপ্রাপ্ত শিক্ষক রওশনারা বেগমের অবস্থা আরও নাজুক। স্বামী মারা যাওয়া পর সংসারে দেখা দিয়েছে তীব্র সংকট। প্রাইভেট টিউশন বন্ধ। ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছেন তিনি। এখন লোকলজ্জার ভয় কাটিয়ে অন্যত্র হাত পেতে সংসার চালাচ্ছেন। এছাড়াও কেউ কেউ শিক্ষকতা ছেড়ে মুদি-স্টেশনারী দোকানেও কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন।
একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিক মোর্শেদ আলম। তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের ভাড়া জমা পড়েছে ১০ লক্ষ টাকা। শিক্ষক কর্মচারীর বেতন দিতে পারছি না, তারা সবই চলে গেছেন। ভাবছি শিক্ষকতা পেশায় বদলিয়ে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালিয়ে যাব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনায় দেবিদ্বারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যথাসময়ে টিউশন ফি আদায় না হওয়ায় বেতন-ভাতা না পাওয়ায় ১৬০টি বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অন্তত ২২শ’ শিক্ষক পরিবারের নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। টানা ১৫ মাস বেতন-ভাতা না পেয়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে পেশা বদলাচ্ছেন অনেক শিক্ষক, কর্মচারী এমনকি প্রতিষ্ঠান মালিকও। বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারী ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। করোনা মহামারীর কারণে শিক্ষামন্ত্রনালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী গত বছরের মার্চ মাস থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি অনুদান থাকলেও প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেতন পাচ্ছেন না বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারিরা। বেসরকারি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. এটিএম সাইফুল ইসলাম মাসুম জানান, টানা ১৫ মাস কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের বেতন বন্ধ থাকায় বেসরকারী শিক্ষক পরিবারে এখন দিশেহারা অবস্থা। বেতনের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ তাদের প্রাইভেট-টিউশনিও। শিক্ষকতা পেশা পালটাচ্ছেন পরিচিত অনেক শিক্ষক। আমার পরিচিত এক শিক্ষক চান্দিনা রোডে স্টেশনারীর দোকান দিয়েছেন।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা একেএম আলি জিন্নাহ বলেন, অনেক বেসরকারী শিক্ষক বেকার হয়ে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছেন। তারা বাধ্য হয়েই পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এভাবে পেশা বদলালে ভবিষ্যতে শিক্ষক সংকটে পড়বে দেশ।
দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাকিব হাসান বলেন, বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দুরবস্থা সত্যিই দু:খজনক। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত স্কুল-কলেজ খোলবে। কেউ আবেদন করলে উপজেলা প্রশাসন থেকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষকদের সহযোগিতা প্রদান করা হবে।