প্রভাষ আমিন ||
মুখে
যতই নারী-পুরুষ সমান বলা হোক, বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশে নারীর ঝুঁকি অনেক
বেশি। নারীর চলার পথে পথে কাঁটা। পুরুষের এগোনোটা যত সহজ, নারীদের এগিয়ে
যাওয়া ততটাই কঠিন। বিশাল ভার্চুয়াল নারীদের চলার পথ আরও কঠিন করে দিয়েছে।
একটা মোম গালি দিয়েই নারীকে থামিয়ে দেয়া যায়। চর্যাপদের একটা কবিতার লাইন
আছে, ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। নারীর শরীরও তেমনি নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু।
শিশুকাল থেকেই নারী অনেকের লালসার ল্য হয়, নানা কায়দায় যৌন নির্যাতনের
শিকার হয়। কী ঘর, কী বাহির; নারী কোথাও নিরাপদ নয়। রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত,
স্কুল-কলেজ, বাস-ট্রেন সর্বত্রই কিছু অমানুষের অশ্লীল দৃষ্টি, অশ্লীল
আঙুল, নিষ্ঠুর হাত নারীকে তাড়া করে ফেরে।
বারবার এ ঘটনাগুলো ঘটে কারণ
নারী কোথাও সুবিচার পায় না। যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ।
কিন্তু নারী এ অপরাধের শিকার হয়েও বিচার চাইতে পারে না। চারদিক থেকে তার
মুখ বন্ধ করে রাখা হয়। বাংলাদেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যানের সাথে বাস্তবতার যোজন
যোজন ফারাক। ধর্ষণের ঘটনার অতি সামান্যই প্রকাশ্যে আসে। অনেকেই থানা-পুলিশ
পর্যন্ত যান না। গেলেও বিচারের দাবি চালিয়ে যাওয়ার মতো মানসিক শক্তি সবার
থাকে না। প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা খুললে ধর্ষণের খবর মিলবে। কিন্তু ধর্ষণের
খবরের পাশে কয়টি বিচারের খবর দেখেন? আগেই বলেছি পরিসংখ্যানের সাথে
বাস্তবতার যোজন যোজন ফারাক। তার পরও পরিসংখ্যান বলছে, বড় জোর ২ ভাগ ধর্ষিতা
শেষ পর্যন্ত বিচার পান। এই বিচারহীনতাই ধর্ষকদের আরও সাহসী করে তোলে।
নারীর
বিচার না পাওয়ার সংস্কৃতি শুরু হয় একদম ঘর থেকে। জীবনে কোনো দিন অশ্লীল
স্পর্শের শিকার হননি, এমন সৌভাগ্যবতী নারী খুজেঁ পাওয়া ভার। কাজিন, মামা,
চাচা, খালু, প্রতিবেশী, এমনকি বাবার হাতেও কন্যাশিশু নিরাপদ নয়। কিন্তু
সমস্যা হলো, এই বিভীষিকার কথা সেই শিশুটি কারও সাথে শেয়ারও করতে পারে না।
বললে, প্রথমে কেউ বিশ্বাস করে না। উল্টো শিশুটিকেই খারাপ ভাবে। তাই দিনের
পর দিন তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয় এবং মুখ বুজে সইতে হয়। সারাজীবন তাকে
বয়ে বেরাতে হয়, সেই অশ্লীল আঁচড়। যত বড় হয়, বিপদ তত বাড়তে থাকে। তখন আর
নিছক স্পর্শ নয়, সুযোগ পেলেই পুরুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে। এমনকি ধর্ষিতা হওয়ার পরও
নারী বিচার চাইতে পারে না।
ধর্ষণের পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় নারী দীর্ঘ
সময় ধরে গোসল করে নিজেকে ‘পবিত্র’ করতে চায়, একই সঙ্গে ধর্ষণের সব প্রমাণ।
পরে আইনের কাছে যেতে চাইলেও অপরাধ প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু মেয়ের সাথে
হওয়া ধর্ষণের মতো বড় অপরাধকেও প্রথমে আড়াল করতে চায় পরিবার, এমনকি মা-ই তার
মুখ চেপে ধরে সবার আগে। জানাজানি হলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না, মেয়ের
গায়ে সারাজীবনের জন্য দাগ লেগে যাবে, মেয়ের বিয়ে হবে না ইত্যাদি অজুহাতে
ধর্ষণকে ধামাচাপা দেয়া হয়। পরিবার থেকে উল্টো মেয়েকেই দোষ দেয়া হয়, তুই
ওখানে গেলি কেন, আর কারও সাথে হয় না তোর সাথে হয় কেন; ইত্যাদি বলে বলে
মেয়ের জীবন অতিষ্ঠ করে দেয়া হয়।
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনার পর ধর্ষণের
চেয়েও বড় অপরাধ হয়। বিশেষ করে গ্রামের দিকে ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে
দেয়াটাকেই সবচেয়ে বড় ন্যায়বিচার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, গ্রাম্য মাতবররা
ভাবেন, যাক মেয়েটার তো একটা গতি হলো। কী ভয়ঙ্কর কথা! যার থাকার কথা
কারাগারে সে চলে যায় বাসরঘরে। একজন নারীকে সারাজীবন জেনেশুনে একজন ধর্ষকের
সাথে সংসার করতে বাধ্য করা হয়। এমনকি কখনো কখনো পুলিশ বা আদালতও ধর্ষকের
সাথে ধর্ষিতার বিয়ের মধ্যস্ততা করেন। আমার কাছে এই বিয়েটিকে ধর্ষণের চেয়েও
বড় অপরাধ মনে হয়। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছিল যে
মাদকাসক্ত, সেও আদালতে সেই ছাত্রীর সাথে বিয়ের আবেদন করেছিল। ভাবা যায়।
ধর্ষকের
সাথে ধর্ষিতার বিয়ের এ প্রবণতা আমাদের সমাজে ধর্ষণকে উৎসাহিত করে। কোনো
সুন্দরী মেয়েকে আপনার ভালো লাগলো; যিনি সামাজিক মর্যাদায়, যোগ্যতায় আপনার
চেয়ে অনেক আগানো, তাকে আপনি প্রেমের প্রস্তাব দিলেন, তিনি রাজি হলেন না;
এরপর আপনি সুযোগ বুঝে তাকে ধর্ষণ করলেন এবং সামাজিক মধ্যস্ততায় আপনাদের
বিয়ে হয়ে গেল। কী ভয়ঙ্কর অবিচার। আবার অনেক সময় একবার ধর্ষণ করে সেটা
সবাইকে বলে দেয়ার ভয় দেখিয়ে বারবার ধর্ষণ করা হয়।
ইন্টারনেট আসার
পর মেয়েদের নির্যাতনের নতুন নতুন উপায় বের হয়েছে। প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে
গেলে প্রেমিক তাদের অন্তরঙ্গ সময়ের কোনো ছবি ইন্টারনেটে ভাইরাল করে। তাতে
দুর্বিষহ হয়ে যায় মেয়েটির জীবন। কোনো মেয়েকে একবার ধর্ষণ করে তার ভিডিও করে
রাখা হয়। তারপর সেই ভিডিও ভাইরাল করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে বারবার তাকে ধর্ষণ
করা হয়।
আসলে যুগ যুগ ধরে সমাজ মনে করে আসছে মেয়েদের সব সম্ভ্রম তার
শরীরে। তাই একবার ধর্ষণের শিকার হওয়া মানে মেয়েটি এটো হয়ে যাওয়া, অশুচি হয়ে
যাওয়া। তাই ছেলেরা প্রেমে ব্যর্থ হলে মেয়েটিকে ‘নষ্ট’ করে দিতে চায়। এমনকি
মেয়েদের অনেকে একই ধারণা পোষণ করে। মনে করে ধর্ষণের খবর ফাঁস হলে তার জীবন
শেষ হয়ে যাবে। এ সুযোগটাই নেয় ধর্ষকরা।
সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। প্রথম
বুঝতে হবে, নারীর মর্যাদা, সম্ভ্রম তার শরীরে নয়। তার শিায়, জ্ঞানে, দতায়।
ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধী ধর্ষক, ধর্ষিতার এখানে কোনো দায় নেই। তাই ধর্ষককে
ফাঁসির দড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে ঠান্ডা মাথায় আইনি লড়াই চালাতে হবে। কেউ
ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দিলে, মুখের ওপর বলতে হবে, দে ভাইরাল করে। তাতে
তোর মুখে সবাই থুথু দেবে, তুই ধর্ষক, তুই অপরাধী। আমরা গণমাধ্যমে ধর্ষিতার
নাম-পরিচয় গোপন রাখি। কারণ পরিচয় ফাঁস হলে সমাজ তার দিকে বাঁকা চোখে
তাকাবে। তাই সমাজের ভাবনাটাও বদলাতে হবে। ধর্ষিতার দিকে বাঁকা চোখে না
তাকিয়ে ধর্ষককে ঘৃণার চোখে দেখুন। বিয়ের ব্যবস্থা না করে তাকে ধরিয়ে দিন।
চিত্রনায়িকা
পরীমনিকে ধর্ষণচেষ্টা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ঘটনার চার দিন পর তিনি মুখ
খুলেছেন। এই চার দিন তিনি অনেকের দ্বারে দ্বারে গেছেন। কিন্তু বিচারের
উদ্যোগ তো কেউ নেয়ইনি। বরং আর দশটা মেয়ের মতো পরীমনির মুখও বন্ধ রাখার
চেষ্টা হয়েছে। পরীমনি নিজেই বলেছেন, ‘আমাকে বলা হচ্ছিল, তুমি নায়িকা, তুমি
একথা বললে, ভাবো ইজ্জত কোথায় যাবে! ইজ্জত তো আমার হানি হয়েছে। এটার বিচার
চাওয়া কি ইজ্জত যাওয়ার ব্যাপার! আমি তো জানি না।‘ দেখুন এখানে নায়িকা
পরীমনি আর অজপাড়াগাঁয়ের নির্যাতিতা মেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
পরীমনিকে নিয়ে এখন নানামুখী আলোচনা। তার লাইফস্টাইল, তার বিলাসিতা নিয়ে
নানা প্রশ্ন। তার সত্য মিথ্যা জানি না। তবে তিনি যে সাহস করে, ইজ্জতের কথা
না ভেবে নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিচার চেয়েছেন; এজন্য তাকে ধন্যবাদ।
আমাদের
মেয়েদের সাহসের সাথে মুখ খুলতে হবে। সব ধর্ষকের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
ধর্ষকদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। অশ্লীল স্পর্শ করে যেন কেউ পার পা পায়,
ধর্ষণ করে যেন কেউ বিয়ের সুযোগ না পায়। একটা জিনিস স্পষ্ট করে মাথায় রাখতে
হবে, ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ঘটনায় নারীর কোনো দায় নেই। সব অপরাধ ধর্ষকের।
চিৎকার করে সেই ধর্ষকের নাম সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে। বাঁচতে চাইলে, বলতে
হবে। মুখ বুজে থাকলে যুগের পর যুগ ধরে চলতে থাকা এ অবিচার চলতেই থাকবে।
চিৎকার করো মেয়ে, যত দূর গলা যায়।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ