শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
একাদশ পর্ব
কুমিল্লায়
নজরুল ইসলামের শতবর্ষ আগে আগমন উপলক্ষে কতিপয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে
পারে। উল্লেখ্য, নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি। তাঁর
কাব্যমাধুর্যে বহুবিধ বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে বিদ্রোহী কবি,
সাম্যবাদের কবি, প্রেমের কবি, যুগন্ধর কবি, মানুষের কবি ইত্যাদি নানাভাবে
বিশেষিত করা হয়। এসব বিশেষণের তাৎপর্য অত্যন্ত যৌক্তিক ও অনুপম। কাজেই
বাংলাসাহিত্যে তাঁর উজ্জ্বল অবস্থান প্রশ্নাতীত। নজরুল যদি কুমিল্লায় না-ও
আসতেন, কুমিল্লাবাসী তাঁকে কবি হিসেবে স্মরণ-মননে ধারণ করতো। তবে তা হতো
প্রথাগত ও একাডেমিক। যেহেতু কবি ১৯১১-১৯২৪ সালে পাঁচবার কুমিল্লায়
এসেছিলেন, এগারো মাস অবস্থান করেছিলেন, জীবনের উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা
কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত হয়েছে, কুমিল্লার তৎকালীন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গের
সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, ফলে কুমিল্লাবাসীর মূল্যায়ন সে অর্থে
প্রথাগত নয়, একাডেমিকও নয়। কুমিল্লাবাসী বিগত একশত বছর যাবত ব্যক্তি
নজরুলকেই অনুসন্ধান করার প্রয়াস পেয়েছে অধিক। গায়ক হিসেবে, বংশীবাদক হিসেবে
অর্থাৎ ব্যক্তিচরিত্রের নানা বিষয়-বৈচিত্র্যে তাঁকে আবিষ্কার করতে চেয়েছে
নির্মোহভাবে।
এধারায় যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদেরকে
বিশেষভাবে স্মরণ করা যেতে পারে। মরহুম সুলতান মাহমুদ মজুমদার লিখলেন
নজরুলকে নিয়ে স্মৃতিকথা- ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি।’ এ নিয়ে পরিশিষ্টে
বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
মরহুম মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস অকান্ত শ্রম
দিয়ে অনুসন্ধানী স্পৃহায় নজরুলের কুমিল্লার জীবনকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন,
তিনিই প্রথম ‘কুমিল্লায় নজরুল’ নামে একটি গবেষণাপত্র বাংলা একাডেমি
পত্রিকায় প্রকাশ করেন এবং পরবর্তীতে পুস্তকাকারে চারবার প্রকাশিত হয়। তিনি
প্রথাগত গবেষণাকে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে নির্ভরযোগ্য করার জন্য কুমিল্লাশহর
ও দৌলতপুরের অনেকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। যাঁদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ
করেছেন, তাঁরা নজরুলকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ দেখেছেন এবং তাঁদের সঙ্গে
নজরুলের ব্যক্তি সম্পর্কও ছিল। এমন কি জনাব আবদুল কুদ্দুস ঢাকায় নার্গিস
বেগমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সে সাক্ষাৎকার প্রীতিপ্রদ ছিলো না। তখন
নার্গিস বেগম আজিজুল হাকিমের স্ত্রী ও সন্তানের জননী। নানা বিবেচনায় এখন
পর্যন্ত নজরুলের কুমিল্লা-জীবন সম্পর্কে তথ্যনিষ্ঠ দলিল হলো মরহুম মোহাম্মদ
আবদুল কুদ্দুসের ‘কুমিল্লায় নজরুল’ গ্রন্থটি। মেদহীন বইটিতে নিখাত
প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপিত হয়েছে। জনাব আবদুল কুদ্দুস ‘আমি যাযাবর কবি’ বই
প্রকাশ করে তাতে শতবর্ষ আগে নজরুল কুমিল্লায় যে সকল কবিতা-গান রচনা করেছেন,
তার একটি তালিকা প্রণয়ন করেছেন। সে সময় এইকাজ করেছেন, এটি খুবই কষ্টসাধ্য
ছিল। এই সূত্র ধরে আরও গবেষণা হওয়া দরকার। মরহুম আবদুল কুদ্দুসের
নজরুল-বিষয়ক রচনাগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পরিশিষ্টে দেয়া হয়েছে।
তিতাশ চৌধুরী চাকরি সূত্রে কুমিল্লাবাসী। দীর্ঘদিন তিনি ও তাঁর স্ত্রী
রাশিদা তাহির কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া কলেজ ও সরকারি মহিলা কলেজে চাকরি
করেছেন। একসময় কুমিল্লায় সাহিত্যিক মহলের অংশগ্রহনে ‘অলক্ত’ পত্রিকা
প্রকাশিত হয়েছিল। তিতাশ চৌধুরী সম্পাদক ছিলেন, পরবর্তীতে এই পত্রিকাটি
সম্পাদকের নিজস্ব সম্পদ হয়ে যায়। নানা মাত্রায় প্রশাসনের সহযোগিতায় অলক্ত
একটি অবস্থান সৃষ্টি করেছিল। সম্পাদকের পছন্দের সহযোগী নিয়ে বাৎসরিক একটি
সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের আয়োজন করে কুমিল্লায় অলক্ত যে ধারা সৃষ্টি
করেছিল এবং স্বীকৃতিলাভ করেছিল, সম্পাদকের মৃত্যুর পর অলক্ত ইতিহাসের খাতায়
আটকে গেছে। তিতাশ চৌধুরী নিজেও লেখালেখি করতেন এবং তাঁর লেখার বিষয়বস্তু
বহুমাত্রিক। মৌলিক রচনা কবিতা, গবেষণার আদলে অন্যান্য লেখা, অলক্তের হাত
ধরে স্বনামখ্যাত সাহিত্যিকদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ লাভ
করেছিলেন তিনি। তিনিও নজরুলের উপর কয়েকটি বই রচনা করেছেন, তাতে নিজস্ব কিছু
মতামত ও তথ্য উপাত্তহীন সংযোগ করায় বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে। আমি শুধু বলতে
চাই, তিনিও নজরুল নিয়ে ভেবেছেন। বই রচনা করেছেন, অন্তত কুমিল্লায় থাকার
কারণেই।
আনোয়ারুল হক ‘নজরুল-নার্গিস প্রসঙ্গ: মূল্যায়ন’ নামে কুমিল্লার
বিষয় নিয়ে একটি বই রচনা করেছেন। ড. আলী হোসেন চৌধুরী ‘নজরুল জীবন ও
সৃষ্টিতে কুমিল্লা’ নামেও একটি বই লিখেছেন। তাঁদের নজরুল-বিষয়ক অন্যান্য
সমৃদ্ধ গ্রন্থ রয়েছে। যেহেতু কুমিল্লা প্রসঙ্গ নজরুল-বিষয়ক আলোচনা,
এক্ষেত্রে প্রথাগত কথা তাঁদের গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। গভীর অনুসন্ধান নেই।
এক্ষেত্রে শাহজাহান চৌধুরী ‘নজরুল-এ্যালবাম’ প্রকাশ করেছেন। তাতে কুমিল্লায়
নজরুল কোথায় কোথায় গিয়েছেন এ স্থানগুলোর ছবি ও পরিচিতি এছাড়া কুমিল্লায়
নজরুল প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা লিখেছেন। শাহজাহান চৌধুরীই প্রথমে উদ্যোগ
গ্রহণ করে নজরুলের স্মৃতি-স্থানগুলো সংরক্ষণের অন্যতম আগ্রহী ছিলেন।
ব্যাংকে চাকরি করেও ব্যাপকভাবে ক্যামেরায় ছবি তুলেছেন। আমি স্বীকার করি,
আমরা এখন যে সকল ছবি নানা মাত্রায় ব্যবহার করি, অধিকাংশই তাঁর তোলা ছবি।
কেউ স্বীকার করি, অনেকে করি না। আমি জানি, একসময় ঢাকায় নজরুল ইন্সটিটিউটের
একজন কর্মকর্তা তাঁর তোলা ছবিগুলো স্বীকৃতি প্রদান করে ছাপবেন, কিন্তু
ছবিগুলো ঠিকই ছাপা হয়েছিল, তাঁর কোনো স্বীকৃতি ছিল না। শাহজাহান চৌধুরীর
প্রতি ব্যাপারেই আগ্রহ ও আবেগ বেশি এবং নিজেই তা প্রচারে আন্তরিক, কোনো
ব্যাপারে অপেক্ষা করতে চান না, তিনি নজরুলের ব্যাপারে খুবই আবেগপ্রবণ।
নজরুলের জন্মস্থান বর্ধমানের আসাসসোল-চুরুলিয়া গিয়েছেন, স্মৃতিময়
স্থানগুলোর ছবি তুলে এনেছেন, এমন কি সেখানকার মাটিও নিয়ে এসেছেন, এটা তাঁর
ব্যক্তিগত আবেগ। অনেকসময় নজরুল অনুষ্ঠানে পোশাক পরিচ্ছদেও স্বাতস্ত্র্যভাবে
নিজেকে সাজিয়ে তুলেন। এ নিয়ে অধিক কথা বলার প্রয়োজন মনে করি না। সাজা ও
হওয়া-এ দুটি আলাদা বিষয়। তারপরও শাহজাহান চৌধুরীর প্রতি আমার বক্তব্য
হলো-যদি এক সাথে চলতে পারি, একসাথে বলতে পারি, একসাথে চলতে গিয়ে নিজের
অবস্থান সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে সবকিছুর মধ্যেই একটা নান্দনিকতা থাকে,
আমার বর্তমান বয়সের অবস্থানের কথা বিবেচনা করে কথাগুলো বললাম, কেউকে আঘাত
দেয়ার জন্য নয়। আমাদের বুঝতে হবে-মূল্যায়নটা বাইর থেকে হয়, নিজের মূল্যায়ন
নিজে করার মধ্যে স্বচ্ছতা থাকে না, থাকলেও গ্রহণযোগ্যতা লাভ হয় না।
আত্মপ্রচারে
তারা বেপোয়ারা, উপভোগকারীরা হয়ে পড়ে কান্ত। শুধু নজরুলের বেলায় নয়,
আদিখ্যেতা সব ব্যাপারেই। এখন প্রশ্ন হলো-আমরা কুমিল্লায় নজরুলকে কীভাবে
মূল্যায়ন করব? ‘কুমিল্লায় নজরুল’ বা ‘নজরুল ও কুমিল্লা’ এভাবেই আলোচনার
ক্ষেত্রটি রচিত হয়েছে। আমরা ‘কুমিল্লার নজরুলও বলতে পারছি না, কারণ তিনি
কুমিল্লার ভূমিপুত্র নন। আবার ‘নজরুলের কুমিল্লা’ বলতে গেলে নজরুল
কুমিল্লাকে কতটুকু ধারণ করতেন? বিশেষত তাঁর রচনায় গোমতীর কথা আছে,
কুমিল্লার কথা কিন্তু তেমনভাবে নেই।
‘দুদিন না যেতে একি সেই পুণ্য গোমতীর কূলে
প্রথম উঠিল কাঁদি অপরূপ ব্যথা গন্ধ নাভি পদ্মমূলে।
নজরুল
যদি কুমিল্লাকে তেমনভাবে চিহ্নিত করতেন, কুমিল্লায় প্রেমের পারিজাত
পরিস্ফূটনে যে কবিতা লিখেছেন, কুমিল্লার প্রকৃতি ও ঋদ্ধ জনপদের বর্ণনা
কিন্তু কোথাও নেই। নজরুল তাঁর ‘হারা ছেলের চিঠি’ গল্পে উল্লেখ করেছেন-
‘ময়নামতি শাড়ির খুঁটে চোখ মুছে ভরা কলসী কাঁখে সে ধানক্ষেত পারিয়ে সুপারি
গাছের সারির মাঝে মিলিয়ে গেল।’ এখানে ‘ময়নামতি’র কথাটি রয়েছে। সুতরাং
‘নজরুলের কুমিল্লা’-এভাবেও ভাবা যায় না। তাহলে কীভাবে কুমিল্লাকে সম্পর্কিত
করব? ব্যক্তি-সম্পর্কই এখানে প্রাধান্য পায়। নজরুল কুমিল্লায় বৈবাহিক
সূত্রে মধুর আত্মীয়, আবার কারও বন্ধু বা পুত্রসম ¯েœহের আধার। কিন্তু
কুমিল্লাবাসী আত্মীয়তার সম্পর্কে পরিচয় দিলেও আজ তাঁকে সামগ্রিকভাবে
মূল্যায়ন করে থাকে। এদিক বিবেচনা করে কুমিল্লায় অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম
নজরুল-নামাঙ্কিত হয়েছে। কুমিল্লা শহরে নজরুল এ্যাভিনিউ,
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুলের নামে ছাত্রাবাস, স্কুলের নাম নজরুল মেমোরিয়াল
একাডেমি, নজরুল একাডেমী (পিপুলিয়া), নজরুল থিয়েটার, নজরুল নিকেতন, নজরুল
তোরণ ইত্যাদি।
পরিশেষে বলতে চাই- নজরুল ও কুমিল্লা নজরুলের
কুমিল্লায় আগমনের শতবর্ষ পরেও উজ্জ্বল স্মৃতিবহ হয়ে নিরন্তর কুমিল্লাবাসীকে
উদ্দীপ্ত করে রেখেছে। জয় হোক নজরুলের কুমিল্লায় শতবর্ষ আগে আগমন, জয় হোক
কুমিল্লাবাসীর নজরুল-স্মৃতিকাতরতা।