প্রেমাশীষ চৌধুরী (বাদল)||
লেখালেখির
অভ্যাস আমার একেবারেই নেই। কেউ কেউ বলে আপনিতো কুমিল্লার সাংস্কৃতিক
অঙ্গনের কথা জানেন কিছু লিখেন না কেন ? কুমিল্লার তিনজন বিশিষ্ট
শিল্পী-২০২১ সালে প্রয়াত হয়েছেন। তাই তাদের সম্বন্ধে কিছু লিখে, তাদেরকে
স্মরণ করে মনটাকেও একটু হালকা করতে চাই।
প্রথমেই মিলন আহমেদ, পিতা:
আবদুল গফুর, মৃত্যু সন: ০৭/০২/২০২১ইং। যার সাথে আমার ছাপ্পান্না বছরের
পরিচয়। ওনার সুরে আমি গান করছি, আবার আমার সুরকরা গানও উনি বাজিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির পূর্বে বড় বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও ওনার ভূমিকা
ছিল। প্রয়াত ওস্তাদ কুলেসু দাস, গণসংগীতে সুখেন্দু চক্রবর্তী ওনারা
রিহারসালে মিলন ভাইকে বলত- মিলন তুমি এই গানটাতে গিটারে একটা ফোঁটা দিও।
অত্যন্ত মিষ্টি সুরে সেই ফোঁটাই গানটাকে সমৃদ্ধ করে ¯্রােতাদের আকৃষ্ট করত
এমনি গুণী শিল্পী ছিলেন মিলন ভাই। ওনার অনেক ছাত্র/ছাত্রী উনি সৃষ্টি করে
গেছেন। অত্যন্ত বিনয়ী ও ভদ্রলোক ছিলেন। আবার রসিক লোকও ছিলেন। আমাকে দেখলে
উর্দুতে কথা বলতেন এবং হাসতেন এটার অর্থ হলো আমাকে সেই যুদ্ধের দিনগুলি
স্মরণ করে দিতেন। সেই হাসি মুখখানি আমার এখনো স্মৃতি হয়ে রয়ে গেল। মিলন ভাই
আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন। ৫ই মার্চ টাউন হলে কালিপদ মেমোরিয়াল ও সংগীত
পরিষদ এই করোনাকালীন প্রতিকূল অবস্থায় নিয়ম মেনে উনার স্মরণসভা করে- এই
জন্য আমি ওনাদের ধন্যবাদ জানাই। পরিশেষে আমি কুমিল্লার সাংস্কৃতিক
আন্দোলনের একজন শব্দ সৈনিক হিসাবে উনাকে আমার ছালাম জানাই ও ওনার আত্মার
সৎগতি কামনা করি। পরিবারের জন্য প্রার্থনা করি- যাতে সকলে সুখী থাকে।
বাঁশরী
দত্ত: স্বামী ব্যারিষ্টার নিখিলেশ দত্ত। ওনার পিতা ছিলেন কুমিল্লার
এডভোকেট অতীন্দ্র নাথ ভদ্র। ওনার দুই মেয়ে বাঁশরী ভদ্র ও রাখি ভদ্র।
পাকিস্তানি আর্মি যুদ্ধের সময় ওনার পিতা অতীন্দ্র নাথ ভদ্রকে ধরে কুমিল্লা
ক্যান্টনমেন্টে নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। বাঁশরী দত্ত এই শহীদ পরিবারের
একজন কন্ঠশিল্পী ছিলেন। আমার সংগীত জীবনের শুরুতেই বাঁশরীদি কুমিল্লার
সংগীত জগতে রবীন্দ্র সংগীতে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ছিলেন। ওনার জুনিয়র শিল্পী
পাপড়ি সিংহ, শিউলী সিংহ, তারাও কুমিল্লার রবীন্দ্র সংগীতের বিশিষ্ট শিল্পী
ছিলেন। ঐসময় কুমিল্লা রবীন্দ্র সংগীতের কদর ছিল। স্বাধীনতার পর আমি কয়েকটা
অনুষ্ঠানে ওনার সাথে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো ¯েœহ করতেন।
আমার জানামতে বাঁশরীদি প্রথমে ওস্তাদ সুরেন দাসের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত
তালিম নিয়েছিলেন। আমিও কিছু সময় ওনার কাছে কিছু তালিম পাই। বর্তমানে
বাংলাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ সংগীতশিল্পী অলকা দাস ওনার বাবার এই
ধারাবাহিকতা এখনো ধরে রেখেছেন। পরবর্তীতে বাঁশরীদি রবীন্দ্র সংগীত বিশারদ
পরিমলদত্তের কাছে রবীন্দ্র সংগীত শেখেন। অজিত গুহ কলেজে বেশ কিছুকাল উনি
অধ্যাপনাও করেছেন। তারপর ঢাকায় চলে যান এবং ওখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
আমার নাতনী নোটনের সাথে ওনার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। সেও ঢাকায় জাতীয়
পুরস্কারপ্রাপ্ত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী। নোটন আমাকে টেলিফোন করে জানায়
বাঁশরীদি দিল্লীতে ১৭/০৫/২০২১ তারিখে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ
করেন। ঢাকা থেকে যাবার সময় উনি সুস্থই ছিলেন এবং আমার সাথে কথা বলার আগ্রহ
প্রকাশ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত আর যোগাযোগ হয়নি। কে জানতো বাঁশরীদি আর কখনো
ফিরবেন না- তাই শেষ কথা আর হলো না। এই প্রিয় শিল্পীকে আমার শেষ শ্রদ্ধা।
শহীদ পরিবারের একই কন্ঠশিল্পীকে কুমিল্লাবাসী তার অবদানের কথা চিরদিন স্মরণ
করবে।
বাসব চ্যাটার্জি তপু: এক সময় কুমিল্লার একজন জনপ্রিয় শিল্পী।
কখনো গায়ক, কখনো গীতিকার, কখনো সংগীত পরিচালক, আবার ছাত্র রাজনীতিবিদ, কখনো
সামাজিক কর্মী হিসাবে পরিচিত একখানি নাম। তাদের বাড়ির নামটা ছিল ‘শিল্পী
সদন’। বাড়ির সকলেই গুণীজন। ঐ সময়ে বাড়িটিকে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও
বলা যেতে পারে। তপু আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমি পাকিস্তান আমল থেকেই এই
বাড়িতে গান বাজনা করতাম। আমার গানের প্রেরণাও ছিল সে। ২১শে’র ভাষা আন্দোলন,
দেশাত্ববোধক গান, নজরুল গীতি সকল ধরনের সংগীত করা ছিল আমাদের দৈনন্দিন
কাজ।
এখানে উল্লেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের দুই বছর আগে তপু ও আমি মিলে
একটি গান সৃষ্টি করি। গীতিকার ছিলেন ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া। গানটি হলো ‘হায়রে
কৃষাণ তোদেরি শীর্ণদেহ দেখে যেরে অশ্রুমানে না’। যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে
আমিই প্রথম গানটি গেয়ে মঞ্চে মঞ্চে পরিবেশন করি। পরবর্তীতে গানটি
স্বপ্নরায়ের কন্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতারে রেকডিং করা হয়েছিল। স্বাধীনতা
যুদ্ধের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশে আবার আর একটি গান ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়ার
লেখা, সুর, বাসব চ্যাটার্জি তপু সেটাও রেডিও টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। প্রথমে
গানটি করেন অভিজিৎ সাহা পিনাক পরে স্বপ্নরায়। গানটির কথা এসো স্মরণ করি
লাখো শহীদের আত্মদানে মুক্ত স্বদেশ এসো সোনার বাংলা গড়ি। সেই নতুন গানও আর
সৃষ্টি হবে না সেই নতুন সুরও আর বাজবেনা। হঠাৎ ২৫/০৫/২০২১ইং তারিখে রাতে
খবর পেলাম উড়িষ্যায় ভুবনেশ্বরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২৪/০৫/২০২১ইং তারিখ
চিরবিদায় নিলেন কুমিল্লার প্রিয় শিল্পী তপুদা। উনি ১৯৭৫ইং সনে সপরিবারে
ভারতের কলিকাতা চলে গিয়েছিলেন সেখানেও তার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভূমিকা রেখে
গেছেন। ‘ইয়াস’ ঘূর্নিঝড় আসার আগেই সারারাত আর ঘুম হলোনা। মনে পড়ে গেল সেই
স্বাধীনতার স্মৃতি, উনসত্তরের গণআন্দোলন ছাত্রজীবনের কথা।
টাউন হলে
মুক্তমঞ্চে বিশাল অনুষ্ঠান। কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব ওমর ফারুক। সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া। ওস্তাদ কুলেন্দু দাস ও গণসংগীত
পরিচালক সুখেন্দু চক্রবর্তীর অনুষ্ঠানের ধারাবর্ণনায় ভিক্টোরিয়ার অধ্যাপক
বদরুল হাসান, গীতাপালে কন্ঠের গান ‘মায়ের চোখে জল নেমেছে পিতার বুকে
হাহাকার’। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের গানের সাথে নৃত্য মানুষকে
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যুগিয়েছিল ও শিহরণ জাগিয়েছিল যা কুমিল্লাবাসী আজও মনে
রেখেছেন। আমরা তখন তরুণ শিল্পী, মনে পরে গেল সেই ২৫শে মার্চ ভয়াল রাত্রির
কথা কুমিল্লা শহরে পাক বাহিনীর কিলিং হচ্ছে। ঐ সময় বাসব চ্যাটার্জি ১৯৭১ এর
২৬শে মার্চ আমার বাসায় চলে আসে। আমরা সাতদিন সাতরাত্রি একসাথে কাটাই ও পরে
ভারতে চলে যাই স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করি।
তপু কুমিল্লা সদর আসনের
মাননীয় সংসদ সদস্য বীরমুক্তিযোদ্ধা হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের
প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠজন। যারা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কুমিল্লায় বর্তমানে নিজ নিজ
গুণে প্রতিষ্ঠিত তারা সকলেই তপুর আপনজন। বলা যেতে পারে লেখক, গবেষক,
এডভোকেট গোলাম ফারুক। লেখক, গবেষক, সাংবাদিক ড. আলী হোসেন চৌধুরী, প্রাক্তন
প্রিন্সিপাল হাসান ইমাম ফটিক। ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিক শাহজাহান চৌধুরী,
অধ্যাপিকা সেলিম রহমান ওপেল, নারীনেত্রী রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত পাপড়ী বসু,
সুকন্ঠি গায়িকা দিপা দাস, সুরকার ও গায়ক এম এ কাইয়ুম খান, অভিজিৎ সিনহা
মিঠু এবং গায়িকা মিতাপাল, তাদের সকলেরই প্রিয় শিল্পী ছিলেন এই ‘তপুদা’।
এই
মুক্তিযোদ্ধা শব্দ সৈনিককে আমার শ্রদ্ধা। বাংলাদেশের পতাকা চিরদিন উড়বে
তোমার গানও মানুষ স্মরণ করবে। প্রখ্যাত শিল্পী শ্যামল মিত্রের গাওয়া তোমার
প্রিয় গানটি দিয়ে তোমাকে স্মরণ করছি।
“তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা কে বলে আজ তুমি নাই তুমি আছ মন বলে তাই’
লেখক: প্রেমাশীষ চৌধুরী (বাদল), কন্ঠশিল্পী০১৭৬২-৪৫৭৪০৯