অ্যাডঃ আব্দুল আজিজ মাসুদ ।।
সুপ্রিম
কোর্ট বারের এবারের নির্বাচনে খসরু ভাইয়ের অংশগ্রহণ করাটা ছিল স্যুইসাইডাল
গেম বা আত্মঘাতী খেলা। গত বৎসর দেশে করোনা সনাক্ত হলে খসরু ভাই খুবই কঠোর
ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বকশি বাজারের বাসায়ই থাকতেন। শুধু অতি জরুরী
মামলাগুলো ভার্চ্যুয়াল কোর্টে শুনানী করতেন ঘরে বসেই। কোন মোয়াক্কেল দোতলায়
উঠা নিষেধ ছিল। তারা নীচের অপেক্ষা করতেন উপরে শুধু সংশ্লিষ্ট আইনজীবী
যেতে পারতেন। আর একজন আইনজীবী সহকারী। এতো কঠোরতার মাঝেও বারের নির্বাচনে
দাঁড়িয়ে তিনি যেন একেবারেই স্বাস্থ্যবিধি ভুলে ঢিলেঢালা হয়ে গেলেন। জনসংযোগ
বাড়িয়ে দিলেন। এটাই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। নির্বাচন হলো তিনি আশাতীত
ভোট পেয়ে নির্বাচনের বৈতরণী পার হলেন কিন্তু স্বপ্নের সভাপতির চেয়ারটিতে
বসতে পারলেন না। এর আগেই আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে
পরপারে যেতে হলো। রেখে গেলেন বহু স্মৃতি।
১২ মার্চ রাতে নির্বাচনী ফলাফল
ঘোষণা করলে বিজয়ের সংবাদ শুনে তাঁর নির্বাচনী এলাকার শত শত নেতাকর্মী
কোর্ট আঙিনায় ভীড় জমায় ফুল নিয়ে। এখানে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে
কিছু কথা বলে তাদেরকে বিদায় করেন। পরদিন দুপুরে হাইকোর্টের আইনজীবী
ইব্রাহীম খলিলের অন্যায় গ্রেফতারের প্রতিবাদে কোর্ট আঙিনায় মানববন্ধনে
অংশগ্রহণ করেন এবং জোরালো বক্তব্য রাখেন। এটাই ছিল তাঁর বারের সভাপতি
হিসেবে প্রথম এবং শেষ সভা বা প্রতিবাদ সভা। পরদিন ১৪ মার্চ বিকেলে ধানমন্ডি
৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে সাদা প্যানেলের পুরো কমিটিসহ ফুল দিতে
গেলেন। পুষ্পার্ঘ প্রদান শেষে তিনি নিজেই মোনাজাত পরিচালনা করলেন। আমরা এক
সাথে ছবি উঠালাম। এটাই তাঁর সাথে আমাদের শেষ সান্নিধ্য। পর দিন ১৫ মার্চ
নিয়মিত করোনা টেস্টে পজিটিভ ফলাফল আসলে সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি হলেন।
এতো
দিনের নির্বাচনী ধকল শেষে আমি পরদিনই কুমিল্লায় চলে আসি। এসে দেখি স্ত্রী,
মেয়ের জ্বর, গলা ব্যাথা। আতঙ্কিত হলাম আবারো করোনায় আক্রান্ত হলাম কি না?
তাই আমি সহ সকলে করোনা টেস্ট দিলাম। দু দিন পর আল্লাহর রহমতে রেজাল্ট এলো
নেগেটিভ, স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ইতিমধ্যে খসরু ভাই করোনা মুক্ত হয়ে
বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বার কাউন্সিলের সাধারণ সদস্য পদে নির্বাচন
করার জন্য দলীয় নমিনেশন পেপার তাঁর পক্ষে সংগ্রহ করা হয়েছে। হঠাৎ করে খবর
এলো খসরু ভাইয়ের অবস্থা খারাপ। ঢাকা এলাম দ্রুত সিএমএইচ এ গিয়ে দেখি ডা.
মুনমুন কেবিনে বাবার সাথে সারাক্ষণ। খসরু ভাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, ডাকা
বারণ। শুধু দেখে চলে এলাম, কথা বলার সুযোগ পেলাম না। খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম
ফুসফুসের সংক্রমণ শতকরা ২২% থেকে ৩৬% বৃদ্ধি পেয়ে ক্রমাবনতির দিকে।
মুনমুনকে জিজ্ঞেস করলাম উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য কোন হাসপাতালে নেয়ার
পরিকল্পনা আছে কিনা? বলল নেই। তার মতে এখানেই সন্তোষজনক চিকিৎসা হচ্ছে।
ভারতের এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও পরামর্শ নেয়া হয়েছে। আসলে আমরা যা-ই চেষ্টা
করিনা কেন, ভালো ডাক্তার, ভালো চিকিৎসা, ভালো পরামর্শ পাওয়া সব-ই ভাগ্যের
ব্যাপার। সবই আল্লাহ্র ইচ্ছা। না হয় তাঁর চেয়ে আরো খারাপ অবস্থার রোগীও
সাধারণ চিকিৎসায় সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। যাক পরদিন
অবস্থার আরো অবনতি হলে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হলো। আইসিইউতে দেখতে
গেলাম। ভাইকে কিছুটা ওপর করে শুয়ায়ে রাখা হয়েছে, বুঝাই যাচ্ছিল খুব কষ্ট
হচ্ছে। ডাক দিলাম খসরু ভাই বলে, আমার দিকে চোখ মেলে তাকালো। বললাম আমাকে
চিনেছেন কি না, ইশারায় বললেন চিনেছেন। ইশারায় আকুতি জানালো উঠিয়ে বসানোর
জন্য বা চিৎ করে শুয়ানোর জন্য। এটার তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা।
খসরু
ভাইয়ের সাথে আমাদের অনেক স্মৃতি। তিনি ১৯৬৬ সনে গ্রামের মাধবপুর হাইস্কুল
থেকে মেট্রিক পাশ করার পর আমাদের মোগলটুলীর বাসায় চলে আসেন। আমার আব্বা
তাঁর বড় মামা। আব্বা তখন ন্যাশনাল ব্যাংকের (পরে সোনালী ব্যাংক) কর্মকর্তা।
ভর্তি হন ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বাণিজ্য বিভাগে। তখনও বুড়িচং
ব্রাহ্মণপাড়ায় কোন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ কলেজ থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক ও
¯œাতক ডিগ্রি লাভ করে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবিদ আলী চৌধুরীর সাথে ইনকাম
ট্যাক্স প্রাকটিস শুরু করেন। পাশাপাশি তাঁর ভগ্নিপতি বশরত আলী ভূঁইয়ার সাথে
টিনের ডিলারশিপের ব্যবসাও করেছেন কিছুদিন। মূলত আমার কাকার পাইকারী ব্যবসা
প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ননী বাবু এই ব্যবসার দেখাশুনা করতেন। পরে আবার
সোনালী ব্যাংকে চাকুরি করেন কিছুদিন। ১৯৭৬ সনে কুমিল্লা আইন কলেজ থেকে
এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি এই কলেজের নির্বাচিত ভিপিও ছিলেন। ১৯৭৮ সনে
ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা বারে যোগদান করে আইন পেশায় স্থির হন।
এরপর থেকে
তাঁর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অল্প দিনের মধ্যে কুমিল্লার আইন অঙ্গনে
তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর আইন পেশার শুরু থেকে আইনজীবী সহকারী হিসেব
নিত্যসঙ্গী ছিলেন আশুতোষ দেবনাথ, আমাদের আশু বাবু তাঁর ভাষ্য মতে, “তরুণ
আইনজীবী হিসেবে স্যারের সুনামে কুমিল্লা বারের প্রবীণ আইনজীবীদের মাথায় যেন
বাজ পড়ে।” আশু বাবুও অনেক সময় তাদের দ্বারা অপদস্ত হন বলে তিনি জানান। ৭৮
সনেই তিনি কোর্টের সন্নিকটে মগবাড়ী চৌমুহনীতে ভাড়া করা বাসায় তিন ভাইকে
নিয়ে উঠেন। বিয়ে করেন বিখ্যাত আদ্রা মিঞা বাড়ির মেয়ে ফৌজিয়াকে শ্বশুর যুগ্ম
সচিব আবদুল হাই। এক ছেলে এক মেয়ের পিতা হন। তাঁর মন্ত্রীত্বকালে
ক্যান্সারে স্ত্রী মারা গেলে ২য় বিবাহ করেন।
মূলত তিনি কলেজ জীবন থেকেই
সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হন। ৭১ এ স্বাধীনতা সংগ্রামে
অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মুজিব বাহিনীর বুড়িচং থানা কমান্ডার। ট্রেনিং
নেন ভারতের দেরাদোনে। খসরু ভাইয়ের ছাত্র জীবন, রাজনৈতিক ও কর্ম জীবনের
বিরাট একটা অধ্যায় কেটেছে কুমিল্লা শহরের মোগলটুলী এলাকায়। এই এলাকায়
সর্বস্তরের মানুষের সাথে ছিল তাঁর মেলামেশা এবং তাঁর মোগলটুলী অধ্যায়ের
স্মৃতিময় দিনগুলির কথা সব সময় স্মরণ করতেন। কোর্টের অবসরে তিনি আমাকে প্রায়
সময়ই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এলাকার বিভিন্ন জনের খোঁজখবর নিতেন। আমি অবাক হয়ে
যেতাম তাঁর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা দেখে। অনেক সময় আমার মাধ্যমে অনেককে
আর্থিক সাহায্য সহযোগিতাও করতেন। অনেকে তাঁর সাথে দেখা করে অনেক সুযোগ
সুবিধাও আদায় করতেন। তিনি এ ব্যাপারে ছিলেনন খুব-ই উদার। সহজে কাউকে
ফেরাতেন না। তিনি গণ হারে দরখাস্তে সুপারিশ করতেন, ফোনও করতেন। এ ব্যাপারে
তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, আমার একটা সুপারিশ বা একটা ফোনে যদি কারো
একটি উপকার হয় তাহলে তো তাঁর একটা পরিবার বেঁচে গেলো, আমার তো কোন ক্ষতি
হলো না।
খসরু ভাই ছিলেন তৃণমূল পর্যায় থেকে ধাপে ধাপে উঠে আসা একজন
জাতীয় নেতা। তাঁর এই উত্থান অনেকই সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু তার মেধা,
সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁর রাজনৈতিক উত্থানকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি। তিনি
মন্ত্রী হয়েছেন, ৫ বার সাংসদ হয়েছেন, আওয়ামী লীগের মত সংগঠনের প্রেসিডিয়াম
সদস্য হয়েছেন। তিনি এতেই সন্তুষ্ট ছিলেন, বলতেন আমি আর কি চাই? আল্লাহ্
আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছেন। তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতি কি জিনিস বুঝতেন না।
তাঁর দীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসরের রাজনৈতিক জীবনে কেউ বলতে পারবে না, তিনি কাউকে
মামলা হামলায় হয়রানি করেছেন। তিনি কখনো দলে গ্রুপিং করা বা একান্ত নিজস্ব
গ্রুপ লালন পালন করেন নি। তিনি দেশ ও জাতির জন্য কাজ করে গেছেন নিষ্ঠার
সাথে। তাঁর পেশা ছিল “আইন”, আইন পেশার বাইরে তাঁর অন্য কোন আয়ের উৎস ছিল
না। আইন পেশার মাধ্যমেও তিনি দল ও জাতির জন্য কাজ করেছেন অবিরত। বিএনপির
চার দলীয় জোট সরকারের আমলে সারা দেশে যখন হাজার হাজার নেতাকর্মী মিথ্যা
মামলায় হয়রানির শিকার হয়ে ঘর ছাড়া, তখন খসরু ভাই তাদের পাশে দাঁড়ালেন আইনী
সহায়তা নিয়ে, বিনা পয়সায় আইনী লড়াই করে গেছেন তাদের পক্ষে, আমরা তাঁকে
সহযোগিতা করেছি।
আমাদের প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল রাজনৈতিক কোন মামলায় এক
পয়সাও নেয়া যাবে না। অনেক সময় তিনি নিজে কোর্ট ফি, এফিডেভিটের খরচ
দিয়েছেন। এখনও মনে আছে বড় বড় নেতাদের এলাকার নেতাকর্মীর বহু মামলা গভীর রাত
পর্যন্ত লিখেছি পরদিন স্যার শুনানী করেছেন।
১/১১ এর সামরিক
তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যোগদান করার জন্য তাঁকে অনেক লোভনীয় প্রস্তাব ও শেষে
হুমকি ধমকী দেওয়া হয়েছিল। তিনি এসবের তোয়াক্কা না করে বলেছেন, “শৈশব থেকে
ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ করে আসছি সুতরাং জীবন গেলেও দলের বিরুদ্ধে
যেতে পারব না।” এরপর তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি অভিযোগ আনয়নের জন্য ঢাকা,
কুমিল্লা ও গ্রামের বাড়ি মীরপুরে চিরুনী অভিযান চালিয়েছে কিন্তু তারা
ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ তিনি ছিলেন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ।
তিনি ছিলেন
দলের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ছিল তাঁর
অগাধ শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ভালোবাসা। ১/১১এর সময় মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার
নেত্রী কে যখন হাজিরার জন্য সংসদ এলাকা স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালতে আনা
হতো তখন খসরু ভাই অসুস্থ্য অবস্থায়ও হুইল চেয়ারে করে নিয়মিত আদালতে হাজির
থাকতেন। তার হুইল চেয়ার চলাচলে আমরা সহযোগিতা করতাম। হুইল চেয়ারটি আমাদের
কুমিল্লার বাসায় এখনও সংরক্ষিত আছে।
খসরু ভাই নানা কারণে ইতিহাসে
স্থান করে নিয়েছেন। বিশেষ করে ১৯৯৬ সনের ১২ই নভেম্বর মহান জাতীয় সংসদে
কুখ্যাত ইনডেমনিটি রিপিল বিল উত্থাপন এবং পাশের মধ্য দিয়ে। ঐ দিনে তাঁর ৩৯
মিনিটের বক্তৃতা বাংলাদেশে ইতিহাসে স্বণাক্ষরে লিখা থাকবে। যা সংসদ নেত্রী
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সারাদেশের অসংখ্য মানুষকে কাঁদিয়েছে।
তাছাড়া আইনাঙ্গনে তাঁর রেকর্ডেড কেস গুলোও ভবিষ্যত আইনজীবীদের জন্য
রেফারেন্স হয়ে থাকবে। খসরু ভাই ছিলেন একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান, জাতীয়
নেতা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তিনি বহু সেমিনার, সিম্পোজিয়াম কনফারেন্সে
দেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি ছিলেন অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস ও পরামর্শক।
এক আলোচনা সভায় ডেপুটি স্পিকার এডভোকেট ফজলে রাব্বি মিঞা বলেছেন, মতিন
খসরুর মৃত্যুতে বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়াবাসীর সামান্য ক্ষতি হয়েছে কিন্তু দেশ ও
জাতির হয়েছে বিরাট ক্ষতি।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম র্কোট, মোবাইল: ০১৭১১-৪৬৪২১৩