ফারুক আহম্মদ ||
১৫ আগস্ট ১৯৭৫। শুক্রবার দিন। সকালবেলা। সেদিনও ভোরের আলো ফুটে সকাল হয়েছে। তবে সেই ভোরের আলো সত্যিকারের আলো ছিল কিনা কে জানে? নাকি সেই আলো ছিল নিকষ কালো অথবা রাতের চেয়ে বেশি অন্ধকার! সবখানেই একটা ভুতুড়ে অবস্থা বিরাজ করছে। গোটা বাংলাদেশের মানুষ স্তম্ভিত। ঘড়ির কাঁটা যেন একটা জায়গায় এসে আটকে গেছে। পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে না। গাছের পাতাও নড়ছে বলে মনে হচ্ছে না, স্থির হয়ে আছে। অথচ প্রতি সকালে দখিনা সমীরণ এসে আশেপাশের গাছের পাতাকে যে শুধু দোলাতো তা নয়, এই জারুলতলী বাজারের লোকজনের শরীর-মনকেও জুড়িয়ে যেত। জারুলতলী বাজারে সকালে লোকজনের নাস্তা করার হিড়িক পড়ে। অনেক দূর গ্রামের লোকও এখানে এসে জড়ো হয়। উদ্দেশ্য যে শুধু নাস্তা খেতে আসা তা নয়, এর সঙ্গে হাওয়া খেতেও আসে। ঘুম থেকে ভোরে উঠেই হোটেলের বাবুর্চিরা হালুয়া-পরোটা থেকে শুরু করে নানান জিনিস বানানোর কাজে মন দেয়। কে কত ধরনের খাবার তৈরি করে কাস্টমারদের নিজ দোকানে টানতে পারে এ নিয়ে চলে তুমুল প্রতিযোগিতা!
সেই জারুলতলী বাজারে আজ সকালে লোকজনের ভিড় দূরের কথাÑঅনেকটা জনমানবশূন্য! এত বড় বাজারে হাতের আঙ্গুলে মানুষ গোনা যাবে। যারা আছে তাদের অনেকে আবার দোকানের মালিক-কর্মচারী। চার ভাগের তিন ভাগ দোকানেরই ঝাঁপ বন্ধ। তন্মধ্যে কিছু আছে বাইরে থেকে তালা দেওয়া! বাকি দোকানগুলোর বেশিরভাগেরই ঝাঁপ আংশিক বা অর্ধেক নামানো। দু-চারটা দোকান আছে কেবল খোলা! ঝাঁপি বন্ধ হলেও ভেতরে মানুষজন যে চুপিসারে কথা বলছেÑবাহির থেকে সেই শব্দ কিছুটা হলেও শোনা যাচ্ছে। পুরো পরিবেশটাই অন্যরকম! চারদিকে থমথমে ভাব। চরম অনিশ্চিত ও ভীতিকর একটা অবস্থা! দূরে কোথাও হতে গুমোট কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। স্থির বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কান খাড়া করলে টের পাবে। এ যেন স্বজন হারানোর কান্না !
প্রায় সকলেই রেডিওর সংবাদ শুনছে। এমনও হচ্ছে একটা রেডিওতে তিন-চারজন মানুষ কান লাগিয়ে রেখেছে। বিস্মিত হয়ে খবর শুনছে তারা আর চোখ বড় করে ফেলছে।
মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে: ‘আমি মেজর ডালিম বলছিÑশেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে...।’
কিছুক্ষণ পর পরই রেডিওতে এ ঘোষণা প্রচারিত হচ্ছে।
পুরো বাজারের একটা দোকানের সামনে লোকজনের উপস্থিতি একটু বেশি। সেটা হলো সর্দারের দোকান। সময় যত গড়াচ্ছে লোকজনের ভিড় ততই বাড়ছে। সর্দার বক্তৃতা দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে শ্রোতারা হাততালি দিয়ে তাকে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।
তিন-চার দোকান দূরে বিপরীত পাশে হারিছ মিয়ার চায়ের স্টল। চা বানানো ছাড়া তেমন মাল-সামান সেখানে নেই। তবে চা ভালোই বানান হারিছ মিয়া। বয়স সত্তরের মতো হবে তার। পাকা দাড়ি, বিশাল শ্মশ্রুম-িত। ছোট্ট এ দোকানটা কবেই তিনি গুটিয়ে ফেলতেন! কিন্তু সারাদিন একা ঘরে পড়ে থাকতে তার ভাল্লাগে না। বহু আগেই স্ত্রী বিয়োগ হয়েছেন। ভাবলেন বাড়িতে বসে থাকলে আরো বেশি রোগে-শোকে ধরে ফেলতে পারে! তাই চা-দোকানটাতে নিত্য সময় দেন। কিছু লোকজন চা খেতে আসে। এতে করে কিছু টাকা আয় হয়। আবার মানুষজনের সাথে গল্পগুজব করে দিনটা কাটিয়ে দেওয়া যায়। ফলে মনটা ভালো থাকে।
হারিছ মিয়া তার ভাঙ্গা রেডিওটা বার বার বাড়ি মারছেন আর কানের কাছে নিয়ে ধরছেন। ইদানীং তিনি কানে তেমন শুনেন না, চোখে দেখেনও কম। তবে রেডিওতে যা প্রচারিত হচ্ছে তা তিনি ঠিকই শুনতে পেয়েছেন। একটুও ভুল শোনেননি!
ভোরে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি মসজিদ থেকে ভেসে আসছিল। প্রত্যেক মুসলমানকে নামাজের জন্য ডাকা হচ্ছিলো।
আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম...
ঘুম হতে নামাজ উত্তম...
হারিছ মিয়া ঘুম থেকে উঠে অজু করলেন। নামাজ শেষে কী মনে করে যেন মাথার কাছে রাখা রেডিওর নব ঘুরালেন! ঐ মুহূর্তে মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে পান। ঘড়িতে তখন ছয়টা দশ বাজে।
‘আমি মেজর ডালিম বলছি: শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে হয়েছে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন...।’
এ খবর কয়েকবার শোনার পরও হারিছ মিয়া বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পরে লোক পরম্পরায় জানতে পারলেন সবই সত্য!
হারিছ মিয়া আফসোস করছেন। তার মুখ থেকে বিড়বিড় করে বেরুচ্ছিলোÑ‘যে মানুষটা এদেশকে স্বাধীন করলো তাঁকে তোরা খুন করতে পারলি! পাকিস্তানি শত্রুরাও যা করার সাহস কোনোদিন পায়নি। তোদের বুক একটুও কাঁপলো না? স্ত্রীÑপুত্রÑপুত্রবধুÑআত্মীয়দের মেরে ফেললি! দশ বছরের শিশু রাসেলের বুকে গুলি চালাতেও তোদের বিবেকে বাঁধলো না? শুয়োরের বাচ্চারা! তোরা নিমক হারাম! মীরজাফরের দল! তোরা মানুষ চিনলি না! বঙ্গবন্ধুকে চিনলি না...!’
সর্দার সাহেবের গলা উঁচু থেকে উঁচুতর হচ্ছে। তিনি তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মুজিবকে বংশসহ হত্যা করার কাজটি কত ভালো হয়েছে তার বয়ান দিচ্ছিলেন। হত্যাকা- নিয়ে নানারকম বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যও করছিলেন তিনি! অনুসারীরা বেশ মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিল এবং আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করছিল। বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সমর্থক ছিল এমন বহুলোক ¯্রােতের অনুকূলে গা ভাসিয়েছে। তারা ভোল পাল্টিয়েছে। সর্দারের ছায়াতলে এসে এখন ভিড় করছে। ভিড়ের মধ্য থেকে খাটোমত একজন বললো, ‘এখন হতে সর্দার সাহেবই এলাকার চেয়ারম্যান...।’
উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে তাকে সমর্থন জানালো।
সর্দার সাহেবের লোকজন কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলো আর বেশ হাসাহাসি করছিল। তাদের কথা থেকে বুঝা গেলোÑওই এলাকার নির্বাচিত চেয়ারমান বউ-বাচ্চা সুদ্ধ পালিয়ে গেছে। তাকে না পেয়ে তার বাড়ির সব তছনছ করে দিয়ে এসেছে।
ব্যাঙ্গাত্মক সুরে একজন বললো, ‘দুর্নীতিবাজ শেখ মুজিবকে শেষ কইরা দেয়ার পর দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যানও পলাইয়া গেছে। মুজিবের সৈনিকরা অহন কোথায়? সব ইঁদুরের মতন খাদে ঢুইক্কা গেছে! হা হা হা...।’
অন্যরাও দাঁত বের করে হাসছিলো।
সর্দার এবং তার লোকদের কাজকারবার হারিছ মিয়া দূর থেকে লক্ষ করছিলেন। হারিছ মিয়ার কাছে খুব খারাপ লাগছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন এ এলাকার বহু মানুষকে সর্দার নির্যাতন করেছিল। অনেক মাÑবোনের ইজ্জত লুটেছিল সে। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আমাদের স্বাধীনতাকামী অনেক মা-বোন, দেশপ্রেমিক ভাইদের তুলে দিয়েছিল। সেই বর্বরতা হারিছ মিয়ার মন থেকে মুছে যায়নি। এবার জানি কী হয়!
হারিছ মিয়ার গা ভয়ে ছমছম করছিল।
এ মুহূর্তে হারিছ মিয়ার সামনে একজন লোক বসা। সে হলো কেরামত। সারাদিনই কেরামত বাজারে পড়ে থাকে। তন্মধ্যে হারিছ মিয়ার দোকানে বেশি সময় কাটায়। এর অবশ্য কারণ রয়েছে। হারিছ মিয়ার কাছে সে অনেক বেশি আদর-ভালোবাসা পায়। অন্যদের কাছে এতটা পায় না। এখানে বসে থেকে কেরামত চা-চুরুট টানে।
ভয়ের মধ্যেও ইশারায় কাছে ডেকে নিয়ে হারিছ মিয়া কেরামতকে ফিসফিস করে বললো, ‘কেরামত কিছু শুনছস্!’
কেরামত মাথা নেড়ে বুঝায় সে কিছু শুনে নাই।
‘ঢাকায় কী ঘটছে, কিচ্ছু শুনছ্ নাই?’
আবারো না-সূচক মাথা নাড়ে কেরামত।
কেরামত আসলে শুনবে কী করে? শুনলেও তার ততটা বুঝার কথা নয়। গত কয়েক বছর ধরেই সে পাগলপ্রায়! এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। মূলত দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই তার এ অবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এসে কেরামত পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে। স্বাধীনতাবিরোধী-রাজাকার বাহিনী তার কর্মকা-ের কথা পাকবাহিনীকে জানিয়ে দেয়। ক্যাম্পে আটকে রেখে তার উপর অনেকদিন ধরে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। রাইফেলের বাঁট দিয়ে মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করা হয়। আরো অনেকের উপর নির্যাতন চলে। নির্যাতনের পর মারা গেছে মনে করে এদেরকে নিকটতম এক ঝোঁপের ধারে ফেলে রেখে চলে যায়। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় কেরামত। বেঁচে গেলে কী হবে? এরপর থেকে সে অপ্রকৃতিস্থের মত চলাফেরা করে। সর্দারের ইন্ধনেই কেরামতকে ধরে নিয়ে গেছে এমনটাই মানুষজন সন্দেহ করে এসেছে।
একাত্তর সালে কলেজে পড়তো কেরামত। তখন সে টগবগে যুবক। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে কয়েকজন বন্ধুসহ ঢাকায় গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। রেইসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর কোটি কোটি মানুষের মত সেও উদ্দীপ্ত হয়েছিল। গ্রামে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য সকলকে উদ্ধুদ্ধ করছিলো। এমনকি দল গঠন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিল। যুদ্ধ যখন শুরু হলো তখনই মাঠে নেমে পড়লো।
‘কেরামত, বড় খারাপ খবর! এর চাইতে খারাপ খবর আর হইতে পারে না! কিছু জানোয়ার সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবার-পরিজনকে মাইরা ফালাইছে!’
কথাটা বলার সময় হারিছ মিয়ার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। কেরামত বললো, ‘কী কন চাচা!’
‘হ, সত্যি কথা। তুই চাইলে শুনতে পারছ; কী কয় শোনÑ।’
রেডিওটা কেরামতের কানের কাছে ধরলেন হারিছ মিয়া। নিজেও কানটা রেডিওর সঙ্গে গেঁথে রেখেছিলেন।
আশেপাশের কে কী মনে করে সেটা ভেবে হারিছ মিয়া আগেই দোকানের ঝাঁপিটা টেনে দিয়েছিলেন।’
হারিছ মিয়া ফিসফিস করে বললেন, ‘কেরামত, শুনতে পাইলি? বিশ্বাসঘাতক মোশতাক ক্ষমতা দখল করলো। ওর সঙ্গে মেজর ডালিমসহ দুষ্ট লোকজন যোগ দিছে...।’
কেরামত বিস্ময়ের সুরে মাথায় হাত রাখলো।
এদিকে সর্দারের লোকজন আনন্দ মিছিল বের করেছে। নিজেরা মজা করে মিষ্টি খাচ্ছে, পাশপাশি যাকে পাচ্ছে তার হাতে মিষ্টি তুলে দিচ্ছে।
কেরামত সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর শুনে তৎক্ষণাৎ হারিছ মিয়ার দোকান থেকে বের হয়ে গেলো। হারিছ মিয়া কিছু বুঝে উঠার আগেই কেরামত জোর গলায় উচ্চারণ করতে লাগলোÑ
‘বিচার চাই, বিচার চাই
মুজিব হত্যার বিচার চাই...।’
সবাই উঁকি-ঝুঁকি মেরে কেরামতকে দেখছিল আর তার কথা শুনছিল।
অল্পসময়ের মধ্যে কেরামত আরো নতুন দুটো বাক্য জুড়ে দিলোÑ
‘বিচার চাই, বিচার চাই
মুজিব হত্যার বিচার চাই
খুনি মোশতাকের বিচার চাই
খুনি ডালিমের বিচার চাই
বিচার চাই, বিচার চাই
মুজিব হত্যার বিচার চাই...।’
পুরো বাজার ঘুরে হাত উঁচিয়ে কেরামত একাই চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছিলো। মিছিলের সামনে যখন সে এসে পড়লো তখনই সর্দারের লোকেরা ক্ষোভে ফুলে-ফেঁপে উঠলো।
সবাই মিলে কেরামতকে মারধর শুরু করলো। তার গায়ের জামাকাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেললো। এক পর্যায়ে কেরামত মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সর্দার সাহেব রাগী গলায় বললো, ‘গ-গোলের বছর ওর শিক্ষা অয়নাই, এবার জানে মাইরা শিক্ষা দিমু!’
কেরামতের গলায় পা দিয়ে ধরলো সর্দার। তারপর দাঁত কটমট করে বললো, ‘তোর কেরামতি এবার দেখা।’
কেরামত তাতেও দমলো না। সে স্লোগান দেয়া অব্যাহত রাখলো। পুরো শক্তি দিয়ে সে উচ্চারণ করলো, ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই...।’
স্বরযন্ত্রে চাপ পড়াতে কেরামতের কথা অস্ফুট শোনালো।
সর্দারের মাথা গরম হয়ে গেলো। পা দিয়ে সে গলায় আরো জোরে চেপে ধরলো এবং হুঙ্কার মেরে বললো, ‘তোরে আইজ সত্যি সত্যি মাইরা ফালামু!’
সর্দারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন বললো, ‘বাদ দেন। পাগলের কথা কে শোনে?’
শেষমেশ গায়ে যতটুকু বল আছে ঠিক ততটুকু দিয়ে সর্দার কেরামতকে লাথি-উষ্ঠা মেরে দলবল নিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলো।
হারিছ মিয়া দুঃখ পেলেন। মনে মনে ভাবলেন কেরামতকে সংবাদটা না জানালে হয়তো এমন হত না। তাছাড়া এ বিপদে পাশে দাঁড়াতে না পেরে তার দুঃখ বহুগুণে বেড়ে গেলো।
এদিকে কেরামতের প্রাণ ওষ্ঠাগত! নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে!
পুরো দিন অতিবাহিত হলো। অনেক রাত পর্যন্ত কেরামতকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তাকে মারধর করার সময় সাহস করে কেউ বাধা দেয়নি। বাধা দেয়া দূরের কথাÑমুমূর্ষু মানুষটাকে দেখতে একটা কাকপক্ষীও এগিয়ে এলো না। ভয়ে সবাই তটস্থ। প্রত্যেকরই নিজের জান বাঁচানোর চিন্তা!
পরদিন খবর পাওয়া গেলো উপজেলা সদর হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে কেরামত। বেওয়ারিশ হিসেবে তার নাম খাতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কে বা কারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো এসবের কিছুই জানা গেলো না!
কাছের বা দূরের কেউ কেরামতের খোঁজ নিতে এলো না, পাছে আবার কপালে শনি নেমে আসে কিনা এ আশংকায়!
একজন কিন্তু এলো! সে হলো রজব। সবকিছু অতিক্রম করে রজব কেরামতকে দেখতে রাজধানী ঢাকার সোবহানবাগ থেকে এসেছে!
পুরো ঢাকা শহরই বলতে গেলে ফাঁকা। এমন ঘোর সময়ে কেউ ঘরের বাহিরে পা ফেলার সাহস করে না। বেরুতে গেলে একশো একবার ভাবে। কারণ কখন কী ঘটে কিছুই বলা যায় না। যে কেউ ঘরের বাইরে গেলে লাশ হয়ে ফিরতে পারে! আর্মিরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। সোবহানবাগ এলাকায় অনেক বেশি সৈন্য গিজগিজ করছে। সারাদেশে কারফিউ চলছে। পুরো ক্ষমতাই এখন আর্মিদের নিয়ন্ত্রণে। রক্ষীবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশ বাহিনী তাদের চাপে কোণঠাসা হয়ে আছে। কোনো শব্দ নেই, বেশ ভীতি কাজ করছে তাদের মনে!
স্ত্রীর বাধা থেকে শুরু করে কোনো বাধাই রজবকে আটকাতে পারলো না। কেরামত তার কত বড় উপকার করেছে রজবই শুধু জানে! বার বার পরীক্ষা দিয়েও রজব মেট্রিক পাস করতে পারছিল না। বরাবরই অঙ্কে ফেল করছিল। কেরামত অঙ্কে খুব ভালো ছিল। অঙ্কতে লেটার মার্কস নিয়ে সে মেট্রিক পাস করেছিল। শেষবার রজব কেরামতের খাতা দেখে লিখেছিল। সেদিন কেরামত না দেখালে মেট্রিক পাস করা কোনোদিনই তার কপালে জুটতো না। বর্তমানে সে যে চাকরি করে তাও ওই সার্টিফিকেটটা দিয়েই! চাকরিটা না মিললে বউ-বাচ্চাকে নিয়ে শহরে এত আরামে জীবন কাটানো অসম্ভব ব্যাপার ছিল। এমনিতে বার বার মেট্রিক ফেল করার কারণে জুনিয়র ছেলেরা তাকে কত অপমান-অপদস্থ করত। কেউ কেউ তাকে ‘আদুভাই’ বলে ক্ষেপাতো। মুখ বুঝে সব সহ্য করত রজব। অথচ কেরামত তার সঙ্গে কী সুন্দর আচরণ করতো! ‘ভাই’ সম্বোধন করা ছাড়া কোনো কথা বলতো না।
পরিবারের লোকজনেরও অনেক অবহেলা-কটু কথা সহ্য করতে হয়েছে রজবকে। এবার পাস না করলে ঘর থেকে বের করে দেবেÑএমন কথা বাবার মুখ থেকে শুনতে হয়েছিল তাকে। সেই কেরামতকে দেখতে না গেলে নিজেকে অকৃতজ্ঞ হিসেবে প্রমাণ করা হবে।
হাসপাতালে গিয়ে রজব দেখলো কেরামতের সারা শরীরে ব্যান্ডেজ লাগানো। ব্যথার যন্ত্রণায় সে কাতরাচ্ছে।
রজব ভেবেছিল কেরামত হয়তো তাকে চিনতে পারবে না।
‘রজব ভাই, আপনে এলেন!’ রজবকে অবাক করে দিয়ে আবেগের স্বরে কেরামত বললো। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
রজবও চোখের জল আটকে রাখতে পারলো না!
সুদীর্ঘ বছর পরে হলেও কেরামতের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটলো। ঠিকই বাংলার মাটিতে মুজিব হত্যার বিচার হলো। আত্মস্বীকৃত খুনিরাÑযারা এতদিন দম্ভ করে বেড়াতো তাদের অনেকেই ফাঁসির রজ্জুতে ঝুললো। বাদ বাকিদেরও নিশ্চিত গলায় ফাঁস পড়বে!
সর্দারেরও বিচার হয়েছে। জেলখানায় জ্বলে-পুড়ে মরছে এখন!
কেরামত হয়তো এসবের কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। বহু আগেই সে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।
মরে গিয়েও মুজিব আজো বেঁচে আছেন। শত-সহ¯্র বছর ধরে মানুষের অন্তরে আসীন থাকবেন। বাংলার আকাশ-বাতাসে থাকবে চিরদিন মুজিবের নাম। মুজিব আদর্শের লড়াকু সৈনিকরাও বেঁচে থাকবে, যেমনটি মরে গিয়ে কেরামত বেঁচে আছে।
[email protected]