ড. এ কে এম এমদাদুল হক ||
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের শুরুতে একটি বক্তব্য বিবৃত হয়েছে এভাবে “বন্ধু-বান্ধবরা বলে তোমার জীবনী লেখ। সহকর্মীরা বলে, রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আমার সহধর্মীনী একদিন জেল গেইটে বসে বলল, বসেইতো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী। বললাম, লিখতে যে পারি না, আর এমন কী করেছি যা লেখা যায়। আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোন কাজে লাগবে? কিছুইতো করতে পারলাম না। শুধু এতটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।” বঙ্গবন্ধুর এ ধরণের বক্তব্যের পর মনে পড়ে মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের কথা। যিনি বলতেন “আমি জানি, আমি কিছুই জানি না।” যারা জ্ঞানী তারা নিজেকে পন্ডিত বলে জাহির করেন না। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও কথাটি সমভাবে প্রযোজ্য।
অনেক সময় দেখা যায়, যারা আত্মজীবনী লেখেন তাদের বইটি দেখলে মনে হয়- আত্মজীবনী মানে নিজের ঢোল নিজে পিটানো। নিজেকে ফুটিয়ে তোলা, নিজের গুণকীর্তন করা। নিজের ভালো দিকগুলো সবার সামনে তুলে ধরা। এই হইলাম আমি। সবকিছুর উর্ধ্বেই ছিলাম আমি, আমিই সব।ইত্যাদি,ইত্যাদি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়ে আমরা দেখেছি, এখানে বঙ্গবন্ধু নিজের গুণ,কীর্তন করেননি। নিজেকে হিরো হিসেবে তুলে ধরেননি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ অনেকের কথাই বলেছেন এই গ্রন্থে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে যাদের প্রভাব ছিল সবার কথাই তিনি তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটিতে তিনি লিখেছেন,“ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠরে বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা, কেমন করে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল, কেমন করে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তাঁর ¯েœহ আমি পেয়েছিলাম। ”
কি চমৎকার প্রকাশ! বঙ্গবন্ধু একজন ভদ্র, বিনয়ী ও মানবিক স্বভাবের মানুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন সাহসী, তেমনি ছিলেন আপোষহীন এবং দৃঢ়চেতা । আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক। ৭ই মার্চের পটভূমি আমরা সবাই কম-বেশী জানি। তখন আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তথা ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো রাজনৈতিক নেতা। যাঁদের প্রতি আমাদের ছিল প্রচন্ড ঘৃণা। কিন্তু বঙ্গবন্ধ একটি বৈরী ও বৈষম্যমূলক রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি কোনরূপ অবজ্ঞার সুরে কথা বলেননি। ৭ মার্চের ভাষণের গভীর বিশ্লেষণে যাবো না তবে তাঁর ভাষণের কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরবো। তিনি বলেছেন “ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন,আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ নয়, আরো আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করলাম, আপনারা আসুন, বসুন আমরা আলাপ আলোচনা করে শাসনতন্ত্র তৈরি করব।” ঐ ভাষণে বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে আরো বলেছিলেন, “টেলিফোনে আমার সাথে তাঁর (ইয়াহিয়া খানের) কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরীবের উপর, আমার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। ...... আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।” উল্লিখিত বক্তব্যের ধরণ লক্ষ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে অবজ্ঞা সূচক কোন শব্দ ব্যবহৃত হয়নি বরং ভদ্রতা ও ভদ্রতার বহিপ্রকাশ ঘটেছে। শত উত্তেজনার মধ্যেও, উত্তাল জনসমুদ্রের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এতটুকু মেজাজ হারাননি। অথচ তখন তিনি যদি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, অবজ্ঞা সূচক শব্দ উচ্চারণ করতেন জনতা সেটিকে স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করত। কেননা ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো উভয়ই বাঙ্গালির বিরুদ্ধে প্রচন্ড ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল । এতে এ অঞ্চলের মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল প্রচন্ডভাবে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন বড় মাপের মানুষদের মধ্যে একজন। তাঁর বিরল গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যই তা প্রমাণ করেন। বৈশি^কভাবে তাঁর রাজনৈতি ও দর্শন স্বীকৃত। সহকর্মীদের প্রতিও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত সহানুভুতিশীল। যখন কোন সহকর্মী বিপদে থাকেন তখন তিনি এগিয়ে আসেন। এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়, তৎকালীন ছাত্র নেতা ময়মনসিংহের খালেক নেওয়াজ খান ১৯৫২ সালে জেলে ছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু খালেক নেওয়াজ খানের মাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন (০৬/০৭/১৯৫২খ্রি. তারিখে)। চিঠিটিটির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলোÑ “ আম্মা, আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম নিবেন। আপনি আমায় জানেন না তবুও আজ লিখতে বাধ্য হচ্ছি। আপনার ছেলে খালেক নেওয়াজ আজ জেলখানায়। এতে দুঃখ করার কারণ নাই। আমিও দীর্ঘ আড়াই বছর কারাগারে কাটাতে বাধ্য হয়েছি। দেশের ও জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্যই সে আজ জেলখানায়। দুঃখ না করে গৌরব করাই আপনার কর্তব্য। যদি কোন কিছুর দরকার হয়, তবে আমায় জানাতে ভুলবেন না। আমি আপনার ছেলের মতো। খালেক নেওয়াজ ভালো আছে। জেলখানা থেকেই পরীক্ষা দিচ্ছে। সে মওলানা ভাসানী সাহেবের সাথে আছে।... আপনার ¯েœহের, শেখ মুজিবুর রহমান।” এই চিঠির ভাষা প্রমাণ কওে, বঙ্গবন্ধু কী মাত্রার সংবেদনশীল মানষিকতার মানুষ ছিলেন। সহকর্মীর মাকে নিজের মায়ের মর্যাদা দিয়েছেন। এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বঙ্গবন্ধু বিনয়ী অথচ দৃঢ়চেতা হয়ে উঠার শিক্ষা পারিবারিকভাবেই পেয়েছিলেন। ড. সুনীল কান্তি দে সম্পাদিত বই “বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র এর ২২৭ পৃষ্ঠায় দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান বঙ্গবন্ধুকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠির কিছু অংশ তুলে ধরা হলো। “বাবা খোকা, শুরুতেই দোয়া জানিবা। তোমাকে আটক করিয়া রাখার অর্থ হইতেছে আমাদের মতন বদ্ধ পিতামাতা ও নাবালক ছেলেমেয়েদের এবং স্ত্রীর উপর নানারূপ অত্যাচার করা। আমরা উপায়হীন সহ্য করিতে বাধ্য। কিন্তু খোদাতায়ালা নিশ্চয়ই সহ্য করিবেন না। চিন্তা করিবানা, সবকিছু খোদাতায়ালার উপর নির্ভর। তিনি যাহা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। সত্যের জয় হইবেই। সবসময় দোয়া করিতেছি এবং খোদার দরগায় প্রার্থনা যে, তিনি যেন তোমার মঙ্গল করুক। ৮০ বছর বৃদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে লেখা খুব কঠিন তাই খুব ধীরে লিখিতে হয় এবং লিখিতে একটু দেরি হয়।... তোমার আব্বা।” এই চিঠিটি প্রমাণ করে একজন আদর্শবান পিতা তাঁর সন্তানের ন্যায্য আন্দোলনের প্রতি কীভাবে দৃঢ় সমর্থন দিয়েগেছেন এবং তাঁর প্রিয় খোকাকে ধৈর্য্য ধারণ করার কী শিক্ষাইনা দিয়েছেন। পিতার আদর্শ ও শিক্ষায় শিক্ষিত বঙ্গবন্ধু। ধৈর্য্য শক্তিতে বলিয়ান। আর এজন্যই তিনি সবার প্রতি ছিলেন অত্যন্ত মানবিক ও সহানুভুতিশীল।ফিদেল কাস্ত্রোর ভাষায় বলতে হয় বঙ্গবন্ধু ছিলেন হিমালয়ের প্রতিভু। ন¤্রতা ও ভদ্রতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণে এক মহান নেতা। সহিঞ্চু পিতার ধৈর্য্যশীল, বিনীয় ও সাহসী সন্তান বঙ্গবন্ধু। সততা ও মানবিকতার পরীক্ষায়ও উত্তীর্ন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এই শোকের দিনে তাঁর ও তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর ও বিন¤্র শ্রদ্ধা ।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড সরকারি মডেল কলেজ।