শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন। ৭ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণায় বলেছিলেন-‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’।৭ মার্চ বলেছিলেন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে পেছনে একবার ঘুরে আসতে চাই।
বঙ্গবন্ধুর জীবনকে আমি চারভাগে ভাগ করতে চাই।
ক. ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত।
খ. ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সাল (ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত)।
গ. ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত।
ঘ. ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে
১৯৭৫ সালের রাষ্ট্রপতি হওয়া এবং ১৫ আগস্ট পর্যন্ত।
তন্মধ্যে গ ও ঘ পর্ব দু’টি নিয়ে বেশি বলতে চাই না। কারণ, তা ছিল সময়ের দাবির আলোকে নেতৃত্বের ক্রমবিকাশ এবং জয়যাত্রা।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিব ছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অন্যতম সক্রিয় কর্মী। তখন তাঁর অন্তর্গত বিশ্বাসের ক্ষেত্রটি বিকশিত ছিল মুসলমান বাঙালি হিসেবে। তিনি মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক আবাসভূমি চেয়েছিলেন, তাঁর পূর্বসূরিরা যেভাবে প্রভাবিত করেছিলেন, সহজ বিবেচনায় তা মেনে নিয়েছিলেন। পাকিস্তান হলো- পূর্ব-পশ্চিম ১২০০ মাইলের ব্যবধানে যাত্রা শুরু করল। এই যাত্রাকালে ১৯৪৮ সালেই বুঝে গেলেন-এই যাত্রা শুভযাত্রা নয়। মোহভঙ্গ হতে দেরি হলো না। নিজের অন্তর্গত অস্তিত্বের অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিজেকে নবতর রূপে আবিষ্কার করলেন যে, তিনি (শেখ মুজিব) জাতিসত্তা বিবেচনায় মুসলমান বাঙালি নন, আসলে অকৃত্রিম ও মৌলিক পরিচয় হলো, তিনি ‘বাঙালি মুসলমান।’ সেদিন থেকে মহান নেতার সংগ্রামী অভিযাত্রা শুরু হলো। অবশ্য তা ঘোষণা দিয়ে নয়, ক্রমান্বয়ে সময়ের অনুকূল হাওয়ায় নৌকায় পাল তুলে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ‘পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হলো। শেখ মুজিব জেলে, কমিটির ১নং যুগ্ম সম্পাদক। ধুরন্ধর মোশতাক বললেন-‘মুজিব জেলে, আমি হাজির, বয়সেও আমি জ্যেষ্ঠ, আমাকে ১নং যুগ্ম সম্পাদক করা হোক।’ ভাসানীর নির্ভেজাল জবাব-‘মুজিব যা পারবে, তুমি তা পারবে না।’ অর্থাৎ শেখ মুজিব যা করতে পারবে, তা কেউ করতে পারবে না। ভাসানী তাঁর এই মহাবাক্যটি আজীবন বিশ্বস্ততার সাথে যাপন করেছিলেন। কোনো ব্যাপারেই ভাসানী সুস্থির ছিলেন না, কিন্তু এই একটি বিষয়ে ছিলেন অনড় ও প্রত্যয়ী।
পাকিস্তান হলো। জাতীয় নেতা শেরেবাংলা বাঙালি দরিদ্র মুসলিম কৃষক-শ্রমিকদের স্বার্থে অনেককিছু করেছেন পাকিস্তানের পতাকা তলে থেকেই। সামগ্রিকভাবে বাঙালির কথা সেভাবে হয়ত তিনি ভাবেননি, ভাবতে চাননি। সত্যিকার অর্থে সকল অহমিকা ত্যাগ করে তিনি গরিবের বন্ধু ছিলেন। এদিকে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু, যাঁকে তিনি গণতন্ত্রের মানসপুত্র ভেবেছেন সারাজীবন, সেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দেশভাগের সময় অখ- বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন সমগ্র বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্গত হোক, এজন্য বিভাগ পূর্বকালে কোলকাতা-নোয়াখালী-বিহারে দাঙ্গা হয়। বিশেষত কোলকাতার দাঙ্গার দায়ভার থেকে সোহরাওয়ার্দী নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। দায় মুক্ত পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলেন ১৫ আগস্ট কোলকাতার বেলেঘাটায় গান্ধীর সঙ্গে অনশন নাটকে অংশ গ্রহণ করে, তাতে লাভ হয়নি। তখন জিন্না তাঁকে পাকিস্তানে ঢুকতে দেননি। পরে পাকিস্তানে এসে নানা পরিবর্তনের ফাঁকে নিজেকে প্রতিষ্ঠা দেন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের বিশ্বাসভাজন হতে পারেননি। তিনি চাইতেন-পাকিস্তান একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হোক, কিন্তু তা করতে পারেননি, কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূলসূত্র ছিল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণে এবং মুসলমানদের একক স্বার্থ সংরক্ষণের অঙ্গীকারে। তাই পাকিস্তানের নামকরণ হয়ে যায়- ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান।’
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শেখ মুজিব তা দেখেছেন। কিন্তু স্বীয় আদর্শের বিষয়টি নিয়ে কখনও সামনে দাঁড়া করাতে চাননি। সমতালে চলেছেন, যথাব্যক্তিকে যথামর্যাদা দিয়েছেন, যথাসময়ে যথার্থ কাজটি করেছেন। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জোটবদ্ধ থেকে পাকিস্তানি আদর্শের ভীতে আঘাত দেওয়া, ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগকে শুধু আওয়ামী লীগ হিসেবে অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং ক্রমান্বয়ে প্রতিটি আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় নিজেকে সামনের কাতারে প্রতিষ্ঠিত করার কৌশল-পন্থা অবলম্বন-সবই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একমুখী করার প্রয়াস। সহযাত্রী পেয়েছেন বহু, বন্ধু পেয়েছেন গুটি কয়েক। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে পূর্ববাংলা হয়ে যায় বাঙালি জাতিসত্তার একক অখ- স্তম্ভভূমি। তখন থেকেই পূর্ববাংলায় আর কেউ মুসলমান বা হিন্দু বাঙালি থাকল না, সকলেই হয়ে গেলো বাঙালি মুসলমান, বাঙালি হিন্দু অর্থাৎ ‘বাঙালি’। এই বাঙালি জাতির আবাসস্থল হলো স্বাধীন বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ এলেন। ১ অক্টোবর ১৯৭৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেণ্ট জেরাল্ড আর ফোর্ড-এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ হয়। তখন তিনি ফোর্ডকে বলেছিলেন-
‘বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পটা যদি করতে পারি, আশা রাখি, পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাব।’
এই কথাটা কোনো বায়বীয় ছিল না। কিন্তু মার্কিনিরা তা হতে দিবে কেন? তাই তো ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। তারপরের ঘটনা প্রবাহ সবিস্তারে বলার প্রয়োজন নেই। পরিবর্তনের পরিক্রমায় আমরা কী অবস্থানে এসে পৌঁছেছি এ নিয়ে কিছু বলার তাগিদ অনুভব করছি। কারণ বঙ্গবন্ধু যেখানে আমাদেরকে বাঙালি বানিয়েছিলেন, কী করে আজ আমরা আবার মুসলমান বাঙালি, হিন্দু বাঙালি হয়ে গেলাম এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো, বাঙালি যখন স্বাধীনতার স্বাদ পেলো-তখন আমরা সকলেই বাঙালি ছিলাম। পাকিস্তানি মানসিকতা অনেকটা দূরীভূত হয়েছিল তা দৃশ্যত দেখা দিলো, কিন্তু অন্তর্গত মনোভাবটি ছিল সুপ্ত। ফলে ৭৫-এর পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাবন্থায় পৌঁছতে বেশি সময় নেয়নি। এই প্রস্তুতটি গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন। তখন ¯œায়ুযুদ্ধটা চলেছিল অন্ত:¯্রােতে। ভারতের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বরূপ কি হবে। কেউ কেউ মনে করেছিলেন যে নতুন স্বাধীন দেশ হয়ত বা কমিউনিস্ট ব্লকে চলে যাবে, আবার কেউ কেউ ভাবছিলেন যে, ভারতের ছত্রচ্ছায়ায় পাকিস্তানি অপশাসনের পরিবর্তে এ সুযোগটা হয়ত ভারত অবশ্যই অধিকারে রাখতে চেষ্টা করবে। কারণ, বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত করে অপর একটি তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে ভারতের লাভ কি? এই হিসাব-নিকেশ করতে চেয়েছিল গোপনে একটি শক্তি। কাজী জাফর আহমদের আত্মজীবনী ‘আমার রাজনীতির ৬০ বছর-জোয়ার-ভাটার কথন’-এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। উদ্ধৃতিটি দীর্ঘ হলেও নি¤œরূপ-
‘যুদ্ধের একপর্যায়ে মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়। তাঁর সাথে কলকাতায় প্রথম দেখা হয়েছিল। মেজর জিয়া শুধু জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন না, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে তাঁর একটি বিরাট ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল। আমাদের ছাত্র সংগঠন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের দিনাজপুর জেলার অন্যতম নেতা সাঈদ ইস্কান্দার মেজর জিয়ার শ্যালক ছিল এই সুবাদে আমরা মেজর জিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। যুদ্ধ শুরুর দিকে সাঈদ দিনাজপুরে ছিল। আমরা যখন মেজর জিয়ার সাথে তার সম্পর্কের কথা জানতে পারলাম, তখন তাকে কলকাতায় চলে আসার জন্য খবর পাঠালাম। সে কলকাতায় এলে তাকে বলেছিলাম সার্বক্ষণিকভাবে তার দুলাভাই মেজর জিয়ার সঙ্গে থাকতে। সে তাই করেছিল। আমি যখন ত্রিপুরা বা মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় যুদ্ধের প্রয়োজনে থাকতাম, তখন সাঈদ ইস্কান্দার আমার সাথে থাকত। সে আজ পৃথিবীতে নেই।
ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মনগরে মেজর জিয়া আমার সাথে দেখা করার জন্য খবর পাঠান। আতিকুর রহমান সালু ও সাঈদ ইস্কান্দারসহ আমি যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছি। মেজর জিয়া আমাদের জিপে তুলে নিয়ে বলেন, “আপনাদের সাথে আমার জরুরি কথা আছে। আমার সাথে করিমগঞ্জে চলেন। যেতে যেতে আলাপ করা যাবে।”
ধর্মনগর থেকে করিমগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। এ দূরত্ব অতিক্রম করতে আমাদের প্রায় ৭ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। মেজর জিয়া নিজেই জিপ চালাচ্ছিলেন। তাঁর পাশের সিটে বসেছিলাম আমি। পেছনের সিটে ছিল সালু ও সাঈদ। এ দীর্ঘ সময় মেজর জিয়া অনেক কথা বলেছিলেন। আমার যতটুকু মনে আছে তাই তুলে ধরছি।
মেজর জিয়া বলেছিলেন, “মুক্তিযুদ্ধ তো শেষ হওয়ার পথে।”
এ কথা শুনে আমরা চমকে উঠেছিলাম। এরপর তিনি বলেছিলেন, “মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায় শেষ হবে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের মধ্যদিয়ে। এরপর শুরু হবে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়। আপনারা তো বুঝতেই পারছেন, আমরা স্বাধীনভাবে কোনো কিছু করতে পারছি না। আমাদের সবকিছুই করতে হচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে। ভারত চায় না যে বাংলাদেশে গেরিলা যুদ্ধ প্রলম্বিত হোক। কারণ যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে যুদ্ধের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতে থাকবে না। এ জন্যই ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবসান ঘটবে।”
আমি বললাম, “আপনি মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের কথা বললেন। সেটা সম্পর্কে আপনার চিন্তা ভাবনা কী?”
তিনি বললেন, “মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে আমরা একটা স্বাধীনতা পাব। এই স্বাধীনতা আমরা পাব ভারতের সাহায্যে। তাই সেটা প্রকৃত স্বাধীনতা নয়।
মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটি স্বাধীন ভূখ- পাওয়ার পর শুরু হবে আসল লড়াই। স্বাধীনতা লাভের পর যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে তাদেরকে প্রকৃত অর্থে দেশপ্রেমিক বলা যাবে না। তারা চলবে ভারতের নির্দেশ মোতাবেক। সে সময় আমরা কী ভূমিকা পালন করব এ ব্যাপারে আপনারা চিন্তাভাবনা শুরু করুন।”
আমি বললাম, “আপনি যেভাবে বললেন, আমরা সেভাবে ভাবিনি। এতো দ্রুত মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে তা আমরা চিন্তা করিনি। আপনিই বলুন কী করা যেতে পারে।”
তিনি বললেন, “আমি তো চিন্তা করছি সেনাবাহিনী ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে যোগ দেব।”
আমি বললাম, “খুব ভালো।”
তিনি বললেন, “সেনাবাহিনী চাকরি ছেড়ে আমি যদি রাজনীতিতে যোগ দেই তাহলে আমার ভরণপোষণের ব্যবস্থা কে করবে?”
আমি বললাম, “আপনার ভরণপোষণের জন্য কত টাকা প্রয়োজন?”
তিনি বললেন, “৫ হাজার টাকা দিলেই হবে।”
আমরা সবাই একটু চমকে উঠলাম। কারণ তখন ৫ হাজার টাকা মানে অনেক টাকা।
আমি বললাম, “আমরা এ সম্পর্কে এখন কোনো ওয়াদা করতে পারব না।”
আমি পরে বুঝতে পেরেছিলাম, টাকার বিষয়টি মেজর জিয়া সিরিয়াসলি বলেননি। আমাদের সাথে সামান্য ঠাট্টা করেছেন মাত্র।
যাই হোক, আমরা সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম মেজর জিয়া রাজনীতিতে আসবেন। এরপর তাঁর সাথে আমার দেখা হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন তাঁকে ডিঙিয়ে মেজর শফিউল্লাহকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয়। জিয়া শফিউল্লাহর চেয়ে সিনিয়র ছিলেন।
তিনি আমাকে বলেছিলেন, “এখন আমি কী করব?”
আমি তাকে কোনো পরামর্শ দিতে পারিনি।
তারপর তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, “খবঃ ঁং ধপপবঢ়ঃ ঃযব যঁসরষরধঃরড়হ রহ ধহঃরপরঢ়ধঃরড়হ ড়ভ ধ নবঃঃবৎ ভঁঃঁৎব.”
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাসদের উত্থান ঘটে এবং একসময় সমগ্র দেশকে, ক্ষমতাসীন বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অস্থির করে তুলে। এ প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমদ ‘জাসদের উত্থান পতন; অস্থির সময়ের রাজনীতি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন-
‘তেহাত্তরে রাজনীতিতে পট পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে, পিকিংপন্থী দলগুলো শেখ মুজিবকে ভারতের দালাল ও আওয়ামী লীগকে ভারতের পুতুল সরকার হিসেবে প্রচার করতে থাকে। তাদের এক অংশের অন্ধ ভারতবিরোধিতার প্রশ্রয়ে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ফাঁড়ি, থানা, বাজার ও ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটতে থাকে।’
তিনি উল্লেখ করেন-
‘ভারত-বিরোধিতা ক্রমে সাম্প্রদায়িকতায় রূপান্তরিত হয়। এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে ‘মুসলিম আইডেন্টিটি’ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এসময় ‘মুসলিম বাংলা’র স্লোগান ও আন্দোলনের দিকে কেউ কেউ ঝুঁকে পড়েন।’
এই ধারাবাহিকতায় জাসদ ১৯৭৪ সালের ২০ জানুয়ারি ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালন করার ঘোষণা দেয়। জাসদ তাদের ২৯ দফা দাবি ১৫ মার্চের মধ্যে মেনে নেওয়ার জন্য সরকারকে সময় বেঁধে দেয়। ১৭ মার্চ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি জাসদের ‘উসকানিমূলক ও উত্তেজনা সৃষ্টির রাজনীতির’ সমালোচনা করেন এবং জাসদের রাজনীতি দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী বলে দেশের ও জনগণের স্বার্থেই এই রাজনীতির মোকাবিলা করতে আহ্বান জানানো হয়।
এরূপ নানা ঘটনাপ্রবাহের ফলশ্রুতি হলো ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে জিয়াউর রহমানের উত্থান এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতবিরোধী মানসিকতায় নবতর বাংলাদেশের অভিযাত্রা। খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেণ্ট হয়ে যে সকল বিয়ষগুলো তাৎক্ষণিকভাবে পরিবর্তন করে পাকিস্তানি ধারায় পুন:স্থাপন করলেন, তা কিন্তু কাকতলীয় বিষয় ছিল না। এর মধ্যে খোন্দকার আবদুল হামিদ নামে একজন সাংবাদিক জোড়ালোভাবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মূল ¯্রােত বা প্রবাহকে স্তব্ধ করে দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের জানালাগুলো খুলে দিলেন। তিনি বাংলা একাডেমিকে কটাক্ষ করলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে রূপান্তর ঘটালেন, ভারতবিদ্বেষ বিষয়টি রাষ্ট্রীয় চিন্তাচেতনায় অনুপ্রবেশ ঘটালেন। পরবর্তীতে রাজনীতিতে, সমাজচেতনায় ও ধর্মীয় মূল্যবোধে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মানসিকতাকে প্রতি:স্থাপন করার বিষয়গুলো তো জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। হয়ে ওঠে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু বিষয়টি স্পষ্টতর হয় এবং এই ক্ষত এখনও নিরাময় করতে পারেনি বর্তমান সরকার। বর্তমান সরকার দাবি করে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ, কিন্তু তার দলের মধ্যে গুপটিমেরে বসে আছে বিপথগামী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। তা না হলে হিন্দু-বৌদ্ধদের উপর এত নির্যাতন কেন? এত ভারত বিদ্বেষ কেন? বৌদ্ধদের উপর নির্যাতনের দুর্ভোগ তো রোহিঙ্গা-যন্ত্রণা। এক সময় সংসদে প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন-‘লোকে বলে হরে কৃষ্ণ হরে রাম, আওয়ামী লীগের অপর নাম। এই আওয়ামী লীগের আমলে যখন বৌদ্ধ ও হিন্দুদের উপর নির্যাতন হয়, তখন মনে রাখতে হবে-যেখানে বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু, পাশেই মিয়ানমারে বৌদ্ধরা সংখ্যাগুরু। যেখানে হিন্দুরা সংখ্যালঘু, সীমান্ত পার হলেই সেখানে তারা সংখ্যাগুরু। একথাটা সরকারকে মনে রাখতে হবে।’
আজ অবাক হয়ে যাই যে ইসলামপন্থী কিছু দল বলছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আসতে দেয়া হবে না। কারণ, তিনি মুসলিম বিদ্বেষী, মুসলিম-নির্যাতনকারী এবং বায়তুল মোকারমের উত্তর গেটে স্লোগান হয়-‘মোদিকে আসতে দেয়া হবে না, এদেশে হিন্দুকে থাকতে দেয়া হবে না।’ এই সারিতে যোগ দিয়েছেন ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মত ব্যক্তি। সমকাল পত্রিকার ১৩ মার্চ ২০২১ সংখ্যায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী কলামে তিনি বলেন-‘অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণ করতে হবে।’
একটু পেছনে হাঁটি। ১৯৬৫ সালে পাকভারত যুদ্ধ হয়েছিল। তখন পূর্বপাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ভারত লাহোর-শিয়ালকোট জয় না করে পূর্বপাকিস্তান বিনা যুদ্ধে দখল করতে পারত। ভারত তা করেনি। আবার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন মিত্রবাহিনী যদি হানাদার মুক্ত বাংলাদেশ থেকে না যেতো, তবে কি হতো? তা করা হয়নি। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু বহু আগেই ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়া করে রেখেছিলেন, সুতরাং বিষয়টি সুরাহা ছিল রাজনৈতিক। ভারতের তখনকার সরকারের দূরদৃষ্টি ছিল, তারা সা¤্রাজ্যবাদী হওয়ার মতো কলংকিত তকমা গ্রহণ করতে চায়নি। চীন তখন বলেছিল- ভারত সম্প্রসারণবাদী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তখন বলেছিলেন-‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, সবিনয়ে বলছি ঠিকই বলেছেন, আমরা সম্প্রসারণবাদী, তবে আমাদের লোভ সা¤্রাজ্যের নয়, মানুষের মুক্তির সা¤্রাজ্যের।’ বর্তমান ভারত সরকার সাম্প্রদায়িক একটি দল দ্বারা পরিচালিত। তারা উগ্রবাদী, তাদের দূরদৃষ্টি খুবই সংকীর্ণ। বাংলাদেশে এখন সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতন-নিপীড়ন হলে ভারতীয় দূতাবাস চঞ্চল হয়ে ওঠে। দূতাবাস হলো সে দেশের সরকারের প্রতিনিধি। ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী কোন মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণ করতে চান? তিনি বলেছেন-
‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে মনে হচ্ছে-লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত বিজয় প্রকারান্তরে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পরই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আজকে সেই বিজয় পুনরুদ্ধরের সময় এসেছে। হারিয়ে যাওয়া বিজয় পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব সবাইকেই নিতে হবে।’
ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরীর কণ্ঠে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন জিয়াউর রহমান কাজী জাফর আহমদকে যা বলেছিলেন তা একই সুরে গাঁথা। এ প্রসঙ্গে একটি নতুন তথ্য দিতে চাই। ১৯৭১ সালে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতায় আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম, একথা অস্বীকার করা যাবে না। সেজন্যই তথাকথিত বেইমানরা মনে করত যে ভারতের সাহায্য পৃষ্ট স্বাধীনতা আসল স্বাধীনতা নয়। তারা জানে না যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে দু’বার স্বাধীন করেছিলেন। একবার ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর এবং দ্বিতীয় বার ১৯৭২ সালে ১৭ মার্চ তাঁর জন্মদিনে। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন- ‘আপনার সৈন্য বাংলাদেশ থেকে কবে সরিয়ে নিবেন?’ মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শিতায় অবাক হয়েছিলেন এবং সাথে সাথে বলেছেন যে আপনার জন্ম দিন ১৭ মার্চ ১৯৭২ সালে ভারতীয় সৈন্যরা স্বদেশে ফিরে যাবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- পাকিস্তানিরা যে অস্ত্রশস্ত্র আত্মসমর্পণের পর রেখে গেছে এবং ভারতীয় সৈন্যরা নিয়ে গেছে, তা ফেরৎ দিতে অনুরোধ করেন এবং জানান যে পাকিস্তানি অস্ত্র ব্যবহার করতে স্বাধীন বাংলাদেশের সৈন্যরা প্রশিক্ষিত। এতো কিছুর পরও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘শক্রতা নয়, বন্ধুতা’- এ বিশ্বাসে ও আচরণে বঙ্গবন্ধু সরকার এবং বর্তমানে শেখ হাসিনা সরকার ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র বলেই জানে। সম্পর্কটাও তদ্রƒপ অটুট। কিন্তু জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া ভারতকে এক নম্বর শত্রুরাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করে ভারতবিরোধী মানসিকতা জন্ম দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করে গেছে। সাম্প্রতিক ভারতের দেয়া করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণ নিয়েও এই মহামারি কালে তাদের যাপিত বিশ্বাসকে আরেকবার উন্মোচন করে জাতিকে অবাক করেছে।
এখন প্রশ্ন- জিয়াউর রহমান এবং বর্তমানে ডা: জাফরউল্লাহ কোন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছেন?
১৯৭৫-এর পর জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে নিষিদ্ধ দল ও ব্যক্তিকে যেমন একমঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন এবং সুচারুরূপে কর্মপ্রবাহ সৃষ্টি করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার মাধ্যমে এবং তথাকথিত ধর্মীয় মূল্যবোধকে পাকিস্তানি কায়দায় পুন:স্থাপনে, যা বশংবদ এরশাদ অনেকটা এগিয়ে নিতে পেরেছিলেন, এ আলামত তো স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। তখন তাদের চিনতে ভুল হতো না, তারা ছিল প্রকাশ্য। এখন তারাই নানা কায়দায় বর্তমান অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু আশীর্বাদপুষ্ট আওয়ামীলীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের পোশাকধারীরাই চিহ্নিত হচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত ‘বিচারের বাণী নীরবে বিভৃতে কাঁদতে থাকে।’
২১ মার্চ ২০২১ সমকাল পত্রিকার প্রধান খবর-‘বিচার বহুদূর’। রামু- ৯ বছরেরও শেষ হয়নি বিচার প্রক্রিয়া, নাসিরনগর-রহস্যের জট খোলেনি চার বছরেও, ভোলা-তদন্তে ঘুরপাক খাচ্ছে তিন মামলা।’ শাল্লার ঘটনায় ফেইসবুকে লেখা হয়-‘হিন্দুদের ভেতর কম্পন তুলে গেলাম।’ এবং যশোরের মাগুরায় ৫০ হিন্দুবাড়িতে ধর্ম পরিবর্তনের জন্য পরিবারের প্রধানকে চিঠি পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে।
সমকাল পত্রিকার ভাষ্যমতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতালটি কুমিল্লায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে গড়ে তোলা হয়। পরে সেটা স্থানান্তর হয় ঢাকার সাভারে। এই ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামটি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ কর্মকা-ের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্ধ দিয়েছিলেন প্রায় ৩১ একর জমি। এই কেন্দ্রের এখন একচ্ছত্র অধিপতি ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী, যিনি এখন অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণ করতে চাইছেন, প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ আহ্বান করেছেন। বলতে ইচ্ছে করছে-তিনি কার প্রেতাত্মা। আমাদের মনে রাখতে হবে-ভারতে এখন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার নেই, অটলবিহারীর বিজিপি সরকার নেই, ক্ষমতাসীন গুজরাটী নরেন্দ্র মোদির বিজিপি সরকার, সঙ্গে অমিত শাহর মতো কুলাংগার, পশ্চিমবঙ্গে দিলিপ ঘোষের মতো ষ-া। একটু তো ভাবতে হবেই। ভারতের নতুন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নাগরিত্ব নিয়ে যখন প্রশ্ন তুলে বলা হয় যে তিনি বাংলাদেশি। তখন বিজিপি বলে- হিন্দু মাত্রই ভারতবাসী। আলামত তো ঘোষিত হচ্ছেই। করোনা প্রাণ হরণ করে, মোদিরা মানুষের জান কবজা করে, তাঁরা মসজিদ ভেঙে মন্দির বানায়। সুতরাং এতটুকুই বলতে চাই-মন্দির মন্দিরের জায়গায় থাকুক, মসজিদ-প্যাগোডা স্ব স্ব স্থানে অবস্থান করুক। আমরা বাংলাদেশের মানুষ শুধুই ‘বাঙালি’ হয়েই থাকি। অন্য পরিচয়ের কথা জাতির পিতা দিতে বারণ করে গেছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের বোধোদয় হউক-এ কামনা।