গওহার নঈম ওয়ারা ||
ক্রমেই শিথিল হচ্ছে কড়াকড়ি। করোনার কালো ছায়া সহজে দূর হওয়ার নয়। অনেক দেশই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার আলামত পেয়ে দেরি না করে চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে বিপদে পড়েছে। বারবার বিধিনিষেধ তুলে আবার তা জারি করতে হয়েছে। টিকা দেওয়ার ল্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার পরও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসছে না অনেক দেশে। বাইডেন তার দেশে করোনার শঙ্কা থেকে ‘ফ্রিডম ডে’ ঘোষণা করেও এখন বুস্টার ডোজের কথা বলছেন। করোনা নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর সফল দেশ নিউজিল্যান্ড ক্রমেই সব ধরনের কার্যক্রম চালু করলেও দেশের সীমান্ত খুলছে না। সেখানে এখন সংক্রমণ প্রায় শূন্যের কোঠায়। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন মাত্র ২৬ জন। ৫০ লাখ মানুষের দেশে করোনার মহামারীতে এত কম মানুষের মৃত্যু হওয়ায় প্রশংসা কুড়িয়েছে দেশটি আর প্রধানমন্ত্রী আরডার্ন। দেশটিতে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৯১৩ জন। সুস্থ হয়েছেন ২ হাজার ৮৪৪ জন। এর পরও আরডার্ন বলেছেন, ‘আমরা এখনই সবকিছু খুলে দিচ্ছি না। মাস্ক তো নয়ই।’ আগামী বছর সীমান্ত খুলে দেওয়া হলেও সতর্কতা জারি থাকবে। মাস্ক, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, প্রয়োজনীয় েেত্র কঠোর কোয়ারেন্টিনের কোনোটাতেই জেসিন্ডা আরডার্ন ছাড় দিতে রাজি নন।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বারবার বলেছেন, ‘মাস্কটা ব্যবহার করতে হবে। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া অব্যাহত রাখতে হবে। মানে, টিকা যারা নিয়েছেন, তাদেরও। এটা মনে করলে হবে না, আমি টিকা নিয়েছি। তাই একদম নিরাপদ। সবাইকে সাবধানে থাকতে হবে।’
মাস্কসহ সব সতর্কতা এখন জীবনের বাস্তবতা। মাস্ক পরার সার্বিক বিষয়ে সবাইকে পরামর্শ দিয়ে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শ কমিটির সদস্য সচিব সাবেক রোগতত্ত্ব, রোগ-নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফোরা সংবাদমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময় জানিয়েছেন, ‘করোনা প্রতিরোধে মাস্ক সরাসরি ভূমিকা পালন করে। নিজেদের সুরা নিশ্চিত করতে মাস্ক পরার কোনো বিকল্প নেই।’ একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার েেত্র কোনো অবহেলা চলবে না। টিকা সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলেও শতভাগ মাস্ক পরার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
একটি মাস্ক, না দুটি মাস্ক
আমাদের দেশে করোনা যেভাবে ছড়াচ্ছে, এতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন অনেক েেত্র একটি মাস্কে কাজ নাও হতে পারে। তাদের মতে, একসঙ্গে দুটি মাস্ক ছাড়া বাইরে চলাফেরা নিরাপদ নয়। রাস্তায় বের হলে বা ভিড়ের মধ্যে যেতে হলে দুটি করে মাস্কে নাক-মুখ ভালো করে ঢেকে রাখাটা জরুরি। বলা হচ্ছে, ডাবল মাস্কিং কোভিডের সংক্রমণ ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ রুখে দিতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, ডাবল মাস্ক ব্যবহার করার আগে অবশ্যই বাসায় পরীা করে দেখতে হবে কোনো রকম কষ্ট হচ্ছে কিনা, ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে কিনা। এ েেত্র প্রথমে একটি সার্জিক্যাল মাস্ক এবং তার ওপর একটি কাপড়ের মাস্ক পরা যেতে পারে। এদিকে করোনার মধ্যেই নতুন আতঙ্ক ছড়িয়েছে মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। দেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ইতোমধ্যেই শনাক্ত হয়েছে। কাজেই সাবধানের মার নেই।
সব খুলে যাচ্ছে যাক, তবু আমরা নিজের জন্য ও অন্যের জন্য সতর্কতার সাথে দায়িত্ব নিয়ে মাস্ক পরি, সবাই নিরাপদে সুস্থ থাকি।
শুধু কি কোভিডের জন্যই মাস্ক
সম্প্রতি চার ধরনের মাস্কের ওপর এক সমীা চালানো হয়। ঘ৯৫ মাস্ক, ত্রিস্তরীয় ডিজপোজবেল সার্জিক্যাল মাস্ক, দ্বিস্তরীয় কটন-পলিয়েস্টার মাস্ক ও মোটা সুতির মাস্কের কার্যকারিতা পরীা করা ছিল এই সমীার উদ্দেশ্য। সমীায় দেখা গেছে, চার ধরনের মাস্কেই আর্দ্রতার পরিমাণ বাড়ে। তবে আর্দ্রতার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি মেলে মোটা সুতির মাস্কে। আমরা জানি, শ্বাস নেওয়ার সময় বাতাস আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে। আর মাস্ক এ বাতাসটিকে পরিশোধনে সাহায্য করে। শ্বাস নেওয়ার সময় যে বাতাস ফুসফুসে যায়, এতে আর্দ্রতা বাড়িয়ে তোলে মাস্ক। এতেই হয় উপকার। অন্যভাবে বলা যায়, আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি হলে ফুসফুসে ভাইরাসের বিস্তারও বাধাপ্রাপ্ত হয়। চিকিৎসার পরিভাষায় এর নাম মিইকোসিলিয়ারি কিয়ারেন্স (এমসিসি)। ফলে ফুসফুসের শ্লেষ্মা মুক্তি ঘটে। এ ছাড়া তিকারক আরও উপাদানের প্রভাব থেকে স্বস্তি পায় ফুসফুস।
ঢাকায় যখন ‘বেবিট্যাক্সি’ চলত আর তার ধোঁয়ায় চোখ-মুখ জ্বালা করত, তখন রিকশাচালক আর রাস্তায় যারা ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করতেন- তারা নাকে-মুখে একটা সুতির গামছা জড়িয়ে রাখতেন। সেটিও এক রকম মাস্কের কাজ করত। ধুলার মধ্যে বা সিমেন্টের বস্তা ওঠানো-নামানোর কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের একইভাবে মাস্কের বিকল্প গামছা ব্যবহার করতে দেখা যায়। গামছা মিইকোসিলিয়ারি কিয়ারেন্সের কাজ করে বলেই শ্রমিকরা এটা ব্যবহার করেন।
‘বায়োফিজিক্যাল জার্নাল’-এ প্রকাশিত উল্লিখিত সমীা জানায়, শ্বাসনালির হাইড্রেশন প্রক্রিয়া শরীরে রোগ প্রতিরোধ মতা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে এবং ওই হাইড্রেশন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে থাকে আর্দ্রতাযুক্ত শ্বাস। যে বাতাস যত বেশি আর্দ্র, এর হাইড্রেশন প্রক্রিয়ার পাশে থাকার মতা তত বেশি। অর্থাৎ যাদের ফুসফুসে আর্দ্রতাযুক্ত বাতাস যত বেশি প্রবেশ করবে, তাদের কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তত কমবে। একই সঙ্গে কমবে অন্যান্য সংক্রমণের আশঙ্কাও।
দ্য প্রসিডিংস অব ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসে (পিএনএএস) প্রকাশিত আরেক গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা জানান, মহামারীর বিস্তার রোধে কোনো কোনো সময় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ও বাসায় থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় মাস্ক। উত্তর ইতালি ও নিউইয়র্ক শহরে মাস্ক পরার নিয়ম জারির পর ওই সময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত এ দুই এলাকায় সংক্রমণের প্রবণতা নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। নিউইয়র্কে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর নতুন সংক্রমণের হার প্রতিদিন ৩ শতাংশ হারে কমতে থাকে। মনে রাখা প্রয়োজন, করোনা তাপ কমলে বা কব্জার মধ্যে আনতে পারলেও বায়ুদূষণের চাপ সহজে কমবে না। তাই মাস্ক ছাড়া আমাদের চলবে না। সেটিই হবে আমাদের পোশাকের অংশ।
মাস্ক প্রচারে বাগেরহাটস্টাইল
মুখে মাস্ক না পরা ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি না করার অভিনব প্রচারে নেমেছিলেন বাগেরহাটের ব্যবসায়ীরা। সেখানে মাস্ক পরা না থাকলে ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করা হবে না- এমন প্রচারমূলক পোস্টার ছাপিয়ে দোকানে দোকানে লাগিয়ে দিয়েছিলেন তারা। এতে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মধ্যে মাস্ক পরার েেত্র সচেতনতা তৈরি হয়। প্রতিবন্ধী এক চায়ের দোকানি চা পান করতে আসা লোকজন যাতে চা পানের অজুহাতে মাস্ক খুলে আড্ডায় বসে না যায়, এ জন্য বসার জায়গায় ভেজা কাদা রেখে দেন। শুকিয়ে গেলে পানি ঢেলে আবার ভেজা ভেজা করে দেন। এসব উদ্যোগ প্রচার পায় না।
মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ কোন ধরনের মাস্ক কতদিন পর্যন্ত ব্যবহার করবেন- এর একটা পরিষ্কার নির্দেশনা বারবার প্রচার করা দরকার। তা ছাড়া মাস্কের দামের ব্যাপারেও একটি সরকারি নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। অনেকেই সাশ্রয়ের জন্য হাতে বানানো কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করেন দিনের পর দিন। না ধুয়ে এই কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করলে উল্টো তির কারণ হতে পারে। আর বাজারের তিন লেয়ারের সার্জিক্যাল মাস্ক একবার ব্যবহার করেই ফেলে দিতে হবে। এটি ধুয়ে ব্যবহারের সুযোগ নেই। এসব জরুরি তথ্য নিয়মিত প্রচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
মাস্কের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ
২০২০ সালের ২৬ মার্চের আগে বাংলাদেশে একটি সার্জিক্যাল মাস্কের পাইকারি দাম ছিল দেড় টাকা। আর সর্বোচ্চ খুচরা দাম ছিল ৫ টাকা। এখন তা ২০ টাকার ওপরে। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানহীন মাস্কও স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে। অন্য জিনিসের ক্রেতা কমে যাওয়ায় মাস্ক কেনাবেচায় মন দিয়েছেন অনেক পসরী। দাম-মান দুটিতেই চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। র্যাব ও ভ্রাম্যমাণ আদালত মাস্কের নকল কারখানাও খুঁজে পেয়েছেন। ফেলে দেওয়া মাস্ক আবার ধুয়ে ও শুকিয়ে বিক্রির ঘটনাও ধরা পড়ছে কোথাও কোথাও। এটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা না গেলে মাস্ক নতুন বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সব শ্রেণির মানুষের জন্য সুলভ আর মানসম্পন্ন মাস্ক নিশ্চিত করতে হবে। ভালোমানের তিন স্তরের মাস্ক তৈরির উদ্যোগ আরও বেগবান করা প্রয়োজন। প্রয়োজন জনপ্রিয় আর সাশ্রয়ী গামছা কীভাবে ব্যবহার করলে মাস্কের একটা সহজ বিকল্প হতে পারে, এর পরীা-নিরীা ও গবেষণা। সহজলভ্য, পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও দাম সহনীয় বিকল্প নিশ্চিত করা না গেলে মাস্ক ব্যবহারে বাধ্য করার উদ্যোগ সফলতা পাবে কি?
মাস্কের ভুল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে
সংক্রমণ এড়াতে মাস্কের ব্যবহার বাড়লেও অনেকেই এর ভুল ব্যবহার করছেন। এই ভুলগুলো শুধরে দেওয়া প্রয়োজন। যেমন-
১. মাস্ক যাতে মুখের মাপের সঙ্গে খাপ খায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। দেখতে হবে মাস্কটি নাক আর চিবুক ঠিকঠাক ঢেকে রেখেছে কিনা।
২. যখন খুশি মাস্ক সরানো ঠিক নয়। এই গরমের মধ্যে মাস্ক ব্যবহার করতে অনেকেই হাঁপিয়ে ওঠেন। দাড়ি বা গোঁফ থাকলে সমস্যা বেশি। ঘামের কারণে স্বস্তি পেতে মাঝে মধ্যেই অনেকে সরিয়ে ফেলেন মাস্ক। হাত যতবার মাস্কে লাগবে, ততবার সংক্রমণের আশঙ্কা থাকবে।
৩. নাক খোলা রাখা যাবে না। অনেকেই নাক বাইরে রেখে মাস্ক ব্যবহার করে থাকেন। এটি সংক্রমণ রোধে কোনো কাজে আসে না।
৪. কথা বলার সময় বা হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় মাস্ক সরানো ঠিক নয়। অনেকেই মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় মাস্ক সরিয়ে ফেলেন। এতে নিজের অজান্তেই বিপদ ভর করতে পারে।
৫. মাস্ক খোলার নিয়মটিও জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। সামনে থেকে, না পেছনের দড়ি ধরে এটি খুলতে-লাগাতে হবে।
৬. অনেকেই মাস্কটি উল্টে নিয়ে পরেন। সাধারণ কাপড়ের মাস্কে এই ভুল হয়ে থাকে। মাস্কের যে দিকটি বাইরে থাকে, ভুল করে সেদিকটি ভেতরে রেখে পরলে সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাওয়া খুবই কঠিন।
শুধু ব্যবহার নয়, মাস্ক পরিচ্ছন্ন রাখাও খুবই জরুরি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আমাদের আরও সচেতনতার সঙ্গে চলতে হবে, সাবধানে থাকতে হবে।
লেখক ও গবেষক