ড. নাজনীন আহমেদ ||
কোভিডের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ আছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিকল্প হিসেবে অনলাইন ও টেলিভিশন রেডিওর মাধ্যমে শিক্ষাদান চলছে। কিন্তু তা কখনই স্বাভাবিক শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার বিকল্প নয়। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠ্যপুস্তকে আবদ্ধ শিক্ষা গ্রহণের জন্য নয়, বরং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পরস্পর নানা ধরনের আদান-প্রদান, শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে জীবন বিকাশের বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভের কেন্দ্রস্থল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই আগামীর ভবিষ্যৎ যে শিশু-কিশোর-যুবশক্তি, তারা দুর্বল ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় তারুণ্যের আধিক্য এক বড় শক্তি। কিন্তু এই শক্তি বোঝায় পরিণত হতে পারে- যদি তাদের উপযুক্ত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব না হয়, মেধা ও মননের পরিপূর্ণ বিকাশের পরিবেশ অনুপস্থিত থাকে। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত কী করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হয় স্বাস্থ্যঝুঁকি অবশ্যই যথাসম্ভব কম রেখে।
শহরের স্কুলগুলোয় অনলাইন ক্লাস হলেও গ্রামের স্কুলে তেমন সুযোগ নেই বললেই চলে। অনলাইন ক্লাস নেওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকা এবং অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনলাইন ক্লাসের উপযুক্ত ডিভাইস না থাকার কারণে এরূপ ব্যবস্থা সম্ভব হয়নি। দিনের পর দিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা চরম বিপর্যয় পড়েছে। তা ছাড়া দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত ডিভাইসের অভাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অর্থের বিনিময়ে ডিভাইস ভাড়া করে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিচ্ছে। এতে তাদের জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে। অনেকের এই ক্ষমতাও নেই। ফলে সুস্পষ্টভাবেই বৈষম্য তৈরি হয়েছে শিক্ষার সুযোগে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো ২০২০ সালে এইচএসসি যারা পাস করেছে, তাদের ভর্তির ঘোষণা না দেওয়ায় এই ছেলেমেয়েরা প্রায় পুরো একটি বছর ধরে কোনো রকম লেখাপড়া ছাড়া আছে। তাদের মধ্যে কাজ করছে চরম হতাশা। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ক্লাস করছে। কিন্তু যেসব পরিবারের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়ানোর মতো সামর্থ্য নেই, সেই শিক্ষার্থীরা আরও হতাশায় ভুগছে। কারণ তাদের সমবয়সী যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারছে, তারা এগিয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজের ক্লাস বন্ধ থাকার এই সুযোগে চলছে বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে এই অল্পবয়সী মেয়েদের স্বাস্থ্য ও জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে। তা ছাড়া অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে অল্পবয়সে মা হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। তা আগামীতে দুর্বল শিশুর জন্ম দিতে পারে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের দীর্ঘদিনের যে অর্জন, বিশেষ করে নারীশিক্ষায় বাংলাদেশের যে অগ্রগতি বিগত বছরগুলোয় হয়েছে- সেটি ধরে রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিতে হবে। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর অনেক অভিভাবককে দেখছি বাজারঘাটে পর্যন্ত শিশুদের নিয়ে যাচ্ছেন, রেস্টুরেন্টে যাচ্ছেন খেতে যাচ্ছেন। কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলেই করোনা ছড়াবে, ব্যাপারটি কি সেটিই? একদিকে যেমন ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রক্রিয়া পুরো দমে চালিয়ে যেতে হবে, অন্যদিকে তেমনি স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার কথা ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কী ধরনের স্বাস্থ্য প্রটোকল মেনে চলতে হবে, এর সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকা দরকার। এই গাইডলাইনে শিক্ষার্থীরা কী করে ক্লাসে বসবে, শিক্ষকরা কত দূরত্বে থেকে লেকচার দেবেন, ক্লাসরুম কী করে স্যানিটাইজ করা হবে ইত্যাদি নির্দেশনা থাকবে। সম্ভব হলে প্রতিক্লাসের বাইরে স্যানিটাইজার রাখতে হবে। তা ছাড়া শিশুদের একটি-দুটি ক্লাস শেষ হলে হাত ধোয়ার জন্য উৎসাহ দিতে হবে। প্রতিক্লাসের শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে অন্তত দুই দিন করে যেন ক্লাস করতে পারে, এরূপ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার মনে করছি। করোনার ঝুঁকে পুরোপুরি নির্মূল হতে সময় লাগবে। তাই স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর বিভিন্ন নিয়ম মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সীমিত হলেও খোলার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও কান্ট্রি ইকোনমিস্ট জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)
(এই প্রবন্ধের মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। এতে ইউএনডিপির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই)