ড. সাজ্জাদ হোসেন ||
প্রায় ৫ কোটির মতো শিক্ষার্থী রয়েছে যারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কয়েকদিন আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০ দিন পার হয়ে গেলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয় মাথায় রেখে খোলার সিদ্ধান্ত নেয়নি এখনও। তবে এই অতিমারী সামাল দিতে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিক্ষা কার্যক্রমকে চালিয়ে নিতে এ্যাসাইনমেন্টভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন, অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা, টেলিভিশন ও বেতারের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে ক্লাস সচল রেখেছে সরকার। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে নিজ বাড়ি থেকেই। বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার কারণে, দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও এ খাত দৃশ্যমান ক্ষতির সম্মুখীন হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় সময়োপযোগী শিক্ষাবান্ধব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এই অতিমারীর সময়ে ক্লাস রুমের বিকল্প অনলাইনভিত্তিক পড়াশোনা চালিয়ে গেছে দেশের প্রায় সব স্তরের শিক্ষার্থী। আমাদের মতো উনয়ন্নশীল দেশে অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম চালানো নিশ্চিতভাবে দুরূহ কাজ। এটি সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের দিকনির্দেশনায়। তাঁর পরামর্শে দেশ আজ ডিটিজাল হয়েছে। এই সঙ্কটে অন্তর্র্বতীকালীন অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া উপযুক্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ, বর্তমানে ডেল্টা ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীরা অল্প সময়েই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অধিকাংশ মানুষকে টিকা দেয়া ছাড়া বিকল্প কোন উপায় হাতে নেই। টিকা নিশ্চিত ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হলে মহামারী আরও প্রকট আকার ধারণ করবে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে নানাবিধ সমালোচনা করছেন। তারা আসলে কোন গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত ছাড়া কিভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে মত দিচ্ছেন! বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে শ্রেণীকক্ষ-হোস্টেলে স্থানের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যাধিক্য। সেখানে ৩ ফিট শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কিন্তু করোনার সংক্রমণ রোধের জন্য মাস্ক পরে ৩ ফিট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে কমপক্ষে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে দেশে শিক্ষাথীর সংখ্যা অনেক বেশি। এ স্তরে প্রত্যক শিক্ষার্থী সঙ্গে একজন করে অভিভাবক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যান। প্রতিষ্ঠান খুললে অভিভাকরা জটলা করবেন নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের সামনে। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব নয়। এছাড়াও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা গণপরিবহন ব্যবহার করবে। সেখানে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে অধিক। এসব কারণে দেশে করোনার সংক্রমণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রায় প্রতিদিন ১৫/১৬ হাজার মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে এ সংখ্যা দিনে দ্বিগুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। তখন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও ভেঙ্গে পরবে নিমেষেই। এমন পরিস্থিতিতে কোনভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবি যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে না। এখন অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া দেশের জন্য মঙ্গলজনক। তবে টিকা নিশ্চিত করে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে সরাসরি ক্লাস রুমে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে সরকার বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে কয়েক কোটি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। এতো বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে টিকা নিশ্চিত না করে বিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এবার করোনার দ্বিতীয় ওয়েভে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রামের মানুষ। পরিসংখ্যান অনুসারে গ্রামের মানুষজন এখন বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন করোনাভাইরাসে। এছাড়াও গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস রুম সঙ্কট দীর্ঘদিনের। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও অসচেতনার দিক থেকে গ্রামের অনেক ঝুঁকি বেশি। অন্যদিকে গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থাও শহরের মতো উন্নত নয়। এমন পরিস্থিতিতে একবার বিপর্যয় নামলে সেটিকে রোধ করা অসম্ভব হবে।
বিশ্বে মহামারী মোকাবেলার সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হলো ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা। যে কোন জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে ভ্যাকসিন দিতে পারলে হার্ড ইমিউনিটির মাধ্যমে কঠিন ও শক্তিশালী মহামারীকে মোকাবেলা করা যায়। বিজ্ঞানভিত্তিক এই পদ্ধতিতে যেতে পারলে শিক্ষার্থীদের আর স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকবে না। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের টিকা প্রদানের লক্ষ্যে টিকা গ্রহণের বয়সসীমা সর্বনি¤œ ২৫ বছরে নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়া দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ মিলে প্রায় দেড় ২ কোটি মানুষ টিকা গ্রহণ করেছে। যাদের মধ্যে প্রায় ৮০ লাখের বেশি মানুষ দ্বিতীয় ডোজও পেয়েছেন। আগস্ট মাসের ৭ তারিখ থেকে চলছে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে গণটিকা দান কার্যক্রম। ইতোমধ্যে সরকার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কমিটি গঠন ও প্রতিদিন অনেক মানুষকে টিকা দিতে প্রস্তুতি নিয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দ্রুতই দেশে করোনা মোকাবেলা করা যাবে। সেই সঙ্গে সম্ভব হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা। এটা নিশ্চিত করতে পারলেই কমবে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
এই মহামারীর সময়ও একটি গোষ্ঠী সর্বদা সরকারের বিরুদ্ধে নানাভাবে গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে। দেশে প্রথম টিকাদানের সময় গুজব ছড়িয়ে ছিল দেশবিরোধীরা। তারা বলেছিল, এই টিকা গ্রহণ করলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। পরক্ষণে দেখা গেছে গুজব সৃষ্টিকারীও টিকা গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেন নেই বলেও নানাভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়েছে। যাতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত ও আন্তর্জাতিক মহলে সরকারের দুর্নাম হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যার সাহসী পদক্ষেপে তারা এখন পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। করোনাকালীন সময়েও সরকার জনবান্ধব ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পাস করেছে। যার মধ্যে চিকিৎসা খাতের বাজেট রয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। গত বছর এ খাতে বাজের ছিল ২৯ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসা, পর্যটন ও শ্রমজীবীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রয়েছে। বিভিন্ন শিল্পে গতি ফিরিয়ে আনতে বড় ধরনের প্রণোদনা বরাদ্দও দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এমন কঠিন সময়ে এত বড় বাজেট বরাদ্দ সবার জন্য মঙ্গল বয়ে আসবে। দেশের ক্রান্তিকালে গুজব ও মিথ্যা তথ্য ভয়াবহ সঙ্কট বয়ে আনতে পারে। গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সচেতন থাকার পাশাপাশি তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো করোনা মোকাবেলা। এটিকে মোকাবেলা করতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ অনেক বড় অর্থনীতির দেশ হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কার্যকর, বিজ্ঞানসম্মত, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপগুলো প্রশংসার দাবি রাখে অবশ্যই। তাঁর নানা সিদ্ধান্তের ফলে দেশে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের বিপর্যয় নামেনি। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অক্সিজেনের অভাবে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সেখানে আমাদের দেশ এখনও অনেক ভাল অবস্থানে আছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সবার উচিত সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে সহযোগিতা করা। বর্তমানে জীবিকার চেয়ে জীবন বাঁচানোই একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অধিকাংশ মানুষের টিকা নিশ্চিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়াই সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত হবে।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যাকলয় মঞ্জুরি কমশিন (ইউজিসি) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটিডে (বিএসসিএল)