ড. হারুন রশীদ ।।
সড়ক
নিরাপদ হোক— এটি যেন চলে এসেছে প্রত্যাশার কেন্দ্রে। কেননা এর সঙ্গে
জীবন-মৃত্যুর সম্পর্ক জড়িত। দেখা যাচ্ছে দুর্ঘটনা মানেই মৃত্যু, প্রাণহানি,
অঙ্গহানি, সম্পদহানি, হাহাকার, আর্তনাদ আর আহাজারি। নতুন আইন হয়েছে সড়ক
নিরাপত্তায়। তা বাস্তবায়ন শুরু হলেও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তা খুব একটা সুফল
বয়ে আনেনি; বরং এই আইনকে প্রতিহত ও অগ্রাহ্য করার প্রবণতা লক্ষণীয়। আসলে
নিরাপদ সড়কের জন্য সবার এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। কারণ সড়ক নিরাপদ না
হলে এর মাশুল সব পক্ষকেই দিতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা কিছুতেই কমছে না; বরং
দিন দিন তা বেড়েই চলছে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে
নানা রকম সুপারিশ এসছে বিভিন্ন সময়ে। এর মধ্যে রয়েছে— বিভিন্ন গণমাধ্যমে
সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার এবং তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। স্কুলের
পাঠ্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে তা অবশ্যই
বাস্তবায়ন করতে হবে। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং,
নির্দিষ্ট স্থান ব্যতিরেকে যেখানে-সেখানে যাত্রী উঠানো-নামানো, ওভারটেকিং,
পাল্টাপাল্টি ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালবোঝাই
করা, গাড়ির ছাদে যাত্রী বহন করা, ওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস বা
জেব্রাক্রসিং থাকা সত্ত্বেও সেগুলো ব্যবহার না করার প্রবণতাকে আইন
প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
আজ ২২ অক্টোবর
জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করা হচ্ছে। দিবসটির এ
বছরের প্রতিপাদ্য ‘গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি।’ সড়ক দুর্ঘটনা
হয় না এমন দেশ নেই। কিন্তু দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতি যত কমিয়ে আনা
যায় সেটিই লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভালো যান, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক, সড়ক
ব্যবস্থা উন্নতকরণ, সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিক ও যুগোপযোগী করার বিষয়গুলো
তো রয়েছেই।
এছাড়া পথচারীদের নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য ফুটপাতগুলো
দখলমুক্ত করে যেখানে ফুটপাত নেই সেখানে ফুটপাত তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে এবং
নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে আবার যেন ফুটপাত দখল না হয়, এ বিষয়ে সজাগ
দৃষ্টি রাখতে হবে। সড়কের ত্রুটিগুলো অচিরেই দূর করতে হবে। সরকার কর্তৃক
গৃহীত ‘সেইফ’ প্রকল্পের মাধ্যমে এক হাজার ৪১০ জন গাড়িচালক প্রশিক্ষক তৈরি ও
তিন লাখ গাড়িচালককে আপগ্রেডিংয়ের জন্য ১২ ও ২৪ দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালার
পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হলে লাইসেন্সবিহীন চালকরা
২৪ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে বৈধ লাইসেন্সের আওতায় আসবে এবং হালকা ও
মধ্যম গাড়ির চালকরা ১২ দিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই ভারী গাড়ির লাইসেন্স
পাবে, যা দেশে দক্ষ চালক সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে। যানবাহন চলাচলের জন্য
আলাদা সড়ক (সার্ভিস রোড) নির্মাণ করতে হবে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ
গ্রহণ করা হবে বলে আশা করছি।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু শুধু একটি পরিবারে
গভীর শোক, ক্ষত সৃষ্টি করে না, আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলে ওই পরিবারকে।
কোনো কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি প্রাণ হারান।
তখন ওই পরিবারের যে কী অবস্থা হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা
পঙ্গুত্ববরণ করে, তাদের পরিবারের অবস্থা আরও করুণ, আরও শোচনীয়।
এটা খুবই
দুঃখজনক যে, অনেক চেষ্টার পরও সড়কে নিরাপত্তা ও পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে
পারছে না সরকার। জোরালো অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন আইন ও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে
মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর একচেটিয়া প্রাধান্যের কারণেই এ খাতে শৃঙ্খলা
আসছে না। এছাড়া সরকার, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন একাকার হয়ে গেছে। ফলে
সিদ্ধান্ত হয় কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। আইন আছে কিন্তু এর প্রয়োগ করতে গেলেই
বাধা আসে। ফলে রক্ষা হচ্ছে না যাত্রীস্বার্থ। অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে সড়কে।
তাহলে নিরাপদ সড়ক কি অলীক কল্পনার বিষয় হয়েই থাকবে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থার হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ২১ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ
হারাচ্ছে। এখনো প্রায় প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এক
হিসাবে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে দেশে প্রায় দেড় লাখেরও বেশি সড়ক দুর্ঘটনা
সংঘটিত হয়েছে। এতে ৫০ হাজারের বেশি লোক প্রাণ হারায়। আহতের সংখ্যা এর চেয়েও
কয়েকগুণ বেশি। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রতি বছর দেশের ক্ষতি হচ্ছে প্রায়
পাঁচ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ শতাংশ। যানবাহনের উচ্চগতি, নাজুক
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সমস্যা, পরিকল্পনা ও নীতির দুর্বলতা,
অসচেতনতা বিষয় সড়ক দুর্ঘটনা ত্বরান্বিত করছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে
কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক
পরিসংখ্যানে জানা যায়, এক বছরে প্রায় ২০ হাজার ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনায় তিন
হাজার মানুষ নিহত হয়। আহত হয় এক লাখ। এদের বেশির ভাগই পঙ্গুত্ববরণ করে।
দুর্ঘটনার
কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাই কমবেশি জানেন। বহুবার এসব নিয়ে আলোচনা
হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—দেশে সড়ক অবকাঠামো এবং স্থলভাগের আয়তন অনুপাতে
জনসংখ্যার চাপ বেশি। সড়কের তুলনায় মোটরযানের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। একই সড়কে
চলছে বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, রিকশাসহ নানা রকম মিশ্র যানবাহন। উপরন্তু
সড়ক ও মহাসড়কগুলো ত্রুটিপূর্ণ। দেশব্যাপী মহাসড়কের অনেক স্থানেই রয়েছে
বিপজ্জনক বাঁক। এসব বাঁকের কারণে প্রায়ই সেসব জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে।
এছাড়া
অবকাঠামোগত কারণেও দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকি খুব বেশি বলে মনে করেন
অনেক বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি দুর্ঘটনা মহামারির আকার ধারণ করার জন্য যেসব
কারণকে দায়ী করা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চালকের অসতর্কতা ও বেপরোয়া
গাড়ি চালানো। এ সমস্যা বারবার চিহ্নিত হলেও এর কোনো প্রতিকার নেই।
প্রতিবার
দুর্ঘটনার পরপরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদন কোনো
দিন আলোর মুখ দেখে না। সংগত কারণেই দোষীদের শাস্তিও হয় না। সমাজের উঁচু
স্তর থেকে নিচু শ্রেণির মানুষ যারাই দুর্ঘটনার শিকার হন না কেন, কোনো একটি
ঘটনার বিচার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মেলা ভার। বিচারহীন, প্রতিকারহীন অবস্থায়
কোনো কিছু চলতে থাকলে সেটির পুনরাবৃত্তিও তো ঘটবেই।
গতকাল ছিলো জাতীয়
নিরাপদ সড়ক দিবস। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক
দুর্ঘটনা রোধ করি।’ সড়ক দুর্ঘটনা হয় না এমন দেশ নেই। কিন্তু দুর্ঘটনার
সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতি যত কমিয়ে আনা যায় সেটিই লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভালো যান,
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক, সড়ক ব্যবস্থা উন্নতকরণ, সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিক
ও যুগোপযোগী করার বিষয়গুলো তো রয়েছেই। এর সঙ্গে দুর্ঘটনায় পতিতদের ত্বরিত
চিকিৎসা পাওয়ার বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় আইনি জটিলতার কারণে আহতদের
চিকিৎসা দিতে সমস্যা হয়। এ সমস্যাটি সমাধানেও ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিটি
সড়ক-মহাসড়ক হোক নিরাপদ এটাই সবার কাম্য।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।