ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বিজয়ের ৫০ বছরেও মাটির ভাঙ্গা ঘরে বীরাঙ্গনা নূরজাহান
Published : Thursday, 16 December, 2021 at 12:00 AM
রণবীর ঘোষ কিংকর।
বীরাঙ্গনা নূরজাহান বেগম। কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার বরকইট ইউনিয়নের কিছমত-শ্রীমন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা। জন্মের পর থেকে জীবন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছে প্রতিটি মুহুর্ত। বিজয়ের ৫০ বছরেও পরিবার নিয়ে ভাঙ্গা এক মাটির ঘরে বসবাস তাঁর।
স্বাধীনতা সংগ্রামে শত্রু পক্ষের ছোড়া বোমা বিস্ফোরণের বিকট শব্দে দৌঁড়ে জীবন বাঁচাতে গিয়ে পাকবাহিনীর মুখোমুখী হয়ে হারিয়েছেন নিজের সম্ভ্রম। পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়ে কষ্টের মধ্যেই কাটিয়ে দিলেন সারাটি জীবন।
তৎকালিন ফরিদপুর বর্তমান মাদারীপুর জেলার ইটখোলা বাজিদপুর গ্রামে জন্ম নূরজাহান বেগম এর। বৈবাহিক সূত্রে স্বামীর বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলায়। বিজয়ের ৫০ বছরে তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখা যায় জরাজীর্ণ মাটির ঘরে কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন ৭২ বছর বয়সী ওই বীরাঙ্গনা নারী।
সেই দিনের বীভৎস্য ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ভারী হয়ে উঠে তাঁর কন্ঠ, দুই চোখের কোনে পানি জমে তাঁর। জন্মের তিন মাস বয়সে মাকে তালাকে দেন বাবা। নানীর কাছেই বড় হন তিনি। বয়স যখন ১২/১৩ তখন চাচাতো মামা আনাছ মোড়ল এর সাথে ঢাকায় আসেন নূরজাহান বেগম।
একান্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, মামা রাজমিস্ত্রির কাজ করতো। ইস্কাটনে তার বাসায় থেকে বাচ্চাদের দেখাশুনা করতাম। কিছুদিন পর কাকরাইলের মীর আশরাফ নামে এক সাহেবের বাসায় কাজ নিয়ে দেয় মামা। সেখানে কাজ করা অবস্থায় পাশের পাশার বাবুর্চি নীল মিয়া আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ায় বিয়ে দিয়ে দেন মামা। আমার স্বামী আমাকে নিয়ে তেজগাঁও তেজকুনীপাড়া এলাকায় মাসিক ৫টাকায় বাসা ভাড়া করেন। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝিতে জন্ম নেয় আমার প্রথম সন্তান আব্দুর রশিদ। ওই বাসায় থেকে অন্যের বাসায় কাজ করে চলতো আমাদের সংসার। ’৭১-এ শুরু হলো সংগ্রাম। আমাদের মতো সেখানে ভাড়ায় থাকতো আরও ১৪টি পরিবার। বিবিসি থেকে খবর বলে যেন, ঘরে বাতি (আলো) না জ্বালাই। আমরা যারা ছিলাম কোন উপায় না পেয়ে মাটির নিচে গর্ত করে থাকতাম।
হঠাৎ একদিন কারওয়ান বাজার রেল গেইট এলাকায় বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে পুরো এলাকা। অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় আমাদের এলাকাও। আমাদের সাথে থাকা এক পরিবার তার সন্তানকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছিল। ওই বোমার সেল এসে পড়ে ওই মহিলার উপর। এক সাথে মৃত্যু ঘটে মা-ছেলের।
সব কিছু ফেলে প্রাণ ভয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যাই আমরা সবাই। কোলের শিশুকে নিয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে দিশে হারিয়ে ফেলি। টানা কয়েকদিন একটু দৌঁড়ে আবার একটু হাটার পর এক নদীর তীরে যাই। সেখানে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেই। আর কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানী ও রাজাকাররা এসে আটক করে আমাদের। আমার স্বামীসহ যারা পুরুষ ছিল সবাইকে মারধর করে। আমার সন্তানকে টেনে নিয়ে যায় কোল থেকে। আমার মত আর তিন মহিলাকে তুলে নেয় নৌকায়। তারপর চালায় নির্যাতন। টানা কয়েকদিন নির্যাতনের পর অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরে দেখি নদীর তীরে আমি একা। আর কেউ নেই! শরীরের ব্যথায় একটুও হাটতে পারছিলাম না।
কিছুক্ষণ পর মুক্তিবাহিনীরা আমাকে দেখে সব কিছু শুনে তুলে নেয় তাদের তাদের নৌকায়। তাদের নৌকায় ছিলাম প্রায় ১৫ দিন। নৌকায় থেকে পানি সেচ করি তাদের সেবা করি। যখন নৌকা থামায় তখন মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভাত, ভাতের মার, তরকারি চেয়ে এনে নিজেও খাই, মুক্তিবাহিনীদেরও খাওয়াই। আমি যখন আমার স্বামী, সন্তানদের জন্য বারবার বলছিলাম, তখন একদিন লঞ্চ খাটে এনে আমাকে নামিয়ে দেয়। পরে ওই লঞ্চে করে সদরঘাট আসি। সদরঘাট নেমে হাটতে হাটতে এক বাড়িতে আশ্রয় নেই। সেখানে কয়কদিন থাকার পর শুনি বাংলাদেশ স্বাধীন হইছে। কথাটি শুনে, মনে খুব শান্তি পাইছি। সেখানে থেকে কারওয়ান বাজার এসে আমার শ্বশুর বাড়ির এলাকার এক চাচা শ্বশুর বাদশা মিয়াকে দেখে আমি চিনে ফেলি। তাকে সাথে নিয়ে তেজকুনী পাড়া গিয়ে দেখি কেউ নেই, মাটির নিচে যেখানে থাকতাম তাও ছিন্নভিন্ন। তখন ওই বাদশা মিয়া আমাকে কাঁচপুর এনে দিয়ে যান। তিন নদী পার হয়ে দাউদকান্দি এসে দেখি গাড়ি-ঘোড়া কিছুই নাই। দেশ স্বাধীনতার প্রায় তিন মাস পর বাড়ি এসে দেখি আমার স্বামী ও সন্তান।
এতো কিছুর পরও আমাকে ছেড়ে যায়নি আমার স্বামী নীল মিয়া। স্বাধীনতার পর আরও তিন সন্তান আসে আমাদের ঘরে। তিন ছেলে ও এক মেয়ে সহ পাঁচজনের অভাবের সংসারে লেখাপড়াও শেখাতে পারিনি সন্তানদের। তিন ছেলে সকলেই ঢাকায় চা বিক্রি করতো, মেয়েটাকে বাড়িতে বিয়ে দেই। একটি সন্তান জন্মের পর মেয়েটাও মারা যায়। কিছুদিন পর হারাই নিজের স্বামীও। ঢাকায় থেকেছি বস্তিতে। বাড়িতে মাটির ঘর। ওই একটি ঘরেই সকলের বসবাস। ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতিন সকলেই থাকে ওই ভাঙ্গা মাটির ঘরটিতে। সামান্য বৃষ্টিতে ভিজে যায় পুরো ঘর। বৃষ্টি আসলে কোথাও দেই পলিথিন আবার কোথাও দেই বালতি।
তিনি কান্না বিজরিত কন্ঠে বলেন, জন্মের পর শুধু কষ্টই ভোগ করে গেলাম, সুখের মুখ আর দেখিনি। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাই, তাতে খাবার দাবার ও মাসের ওষুধ খেয়েই শেষ। একটি টিন বদলানোর ক্ষমতাও নাই।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আশরাফুন নাহার জানান, আমি চান্দিনায় যোগদান করার পর ওই বীরাঙ্গনার কথা শুনেছি। তবে আমি আসার আগেই একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে ওই তালিকায় তাঁর নাম নেই। আগামী তালিকায় অবশ্যই তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।