মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পৌঁছে দেবো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে: প্রধানমন্ত্রী
Published : Thursday, 16 December, 2021 at 12:00 AM
নিজস্ব
প্রতিবেদক: দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর শুভেচ্ছা জানিয়ে
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিজয় দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে তিনি বলেছেন,
“১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ুুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র
‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা হলো বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এই অর্জনকে অর্থবহ
করতে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে
সবাইকে জানতে ও জানাতে হবে।
“প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমরা পৌঁছে দেব- বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর এ মাহেন্দ্রক্ষণে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।”
১৯৭১
সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞ
শুরুর পর স্বাধীনতার ঘোষণা দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
নয়
মাস পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে তা সফল
পরিণতি পায়, বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে।
সেই
ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, “আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান
বিজয় দিবস। বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি হল। আজ বাঙালি জাতির এক অনন্য
গৌরবোজ্জ্বল দিন।
“সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দীর্ঘ ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ৯
মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের এই দিনে চূড়ান্ত বিজয়
অর্জন করে বাঙালি। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আমি দেশবাসীকে আন্তরিক
শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।”
প্রধানমন্ত্রী গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ
করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে; স্মরণ করেন জাতীয় চার
নেতা, ত্রিশ লাখ শহীদ, সম্ভ্রমহারা দুই লাখ মা-বোন এবং জাতির শ্রেষ্ঠ
সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এ দেশ পেয়েছে
স্বাধীনতা।
যারা মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহায়তা দিয়েছেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন সরকারপ্রধান।
শোষণ
বঞ্চনার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে স্বাধীনতার বন্দরে পৌঁছাতে বাঙালির ত্যাগের
ইতিহাস তুলে ধরে শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ
নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ১৯৪৮-১৯৫২ সালের ভাষাআন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা
আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের এগার দফা এবং গণঅভুত্থ্যানের
মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠে।
“৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে
আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু
পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে দেয়নি। জাতির পিতা
অনুধাবন করেন, স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া বাঙালি জাতির ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ও
বঞ্চনার অবসান হবে না। তাই তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স
ময়দানের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের
মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
“বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবের ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। চলতে থাকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের
প্রস্তুতি। পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাতে নিরীহ ও
নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
“১৭
এপ্রিল মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে
উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। বীর
মুক্তিযোদ্ধারা ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার এবং
তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীকে পরাজিত করে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত
বিজয় অর্জন করেন। আমরা পাই লাল-সবুজের পতাকা।”
প্রধানমন্ত্রী তার
বাণীতে বলেন, জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে
পুনর্গঠন করেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, রেললাইন, পোর্ট
সচল করে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেন। মাত্র ১০ মাসে তার নির্দেশনায়
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণীত হয়। ১৯৭৫ সালে জিডিপি
প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ অতিক্রম করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু
‘স্বল্পোন্নত’ দেশের কাতারে নিয়ে যান।
“সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন একটি শোষণ-বঞ্চনামুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক
‘সোনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী
অপশক্তি ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের কালরাতে তাকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ
নির্মমভাবে হত্যা করে।
“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার পর থেমে যায়
বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা। শুরু হয় হত্যা, ক্যু আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি।
ঘাতক এবং তাদের দোসররা ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ
করতে জারি করে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’।”
দীর্ঘদিন পর আওয়ামী লীগের
ক্ষমতায় ফেরার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা দায়িত্ব নিয়েই
বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার
উদ্যোগ গ্রহণ করি।”
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ গত ১৩ বছর ধরে মানুষের
ভাগ্যোন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো
বাস্তবায়ন করছে।
“খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা এখন
পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছি। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা
বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বিশাল এলাকার ওপর
আমাদের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত
চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের মানবেতর জীবনের অবসান
হয়েছে।
“বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতি
গ্লানিমুক্ত হয়েছে। জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন
করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রয়েছে এবং বিচারের রায় কার্যকর
করা হচ্ছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ২০২১-২০৪১ মেয়াদি দ্বিতীয়
প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা
বাস্তবায়ন করছে। শত বছরের ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে।
“বাংলাদেশের
উন্নয়ন অভিযাত্রায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর সুবিধা আজ শহর থেকে প্রান্তিক
গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে শহরের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা
পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। দেশের সকল গৃহহীন-ভূমিহীনের জন্য ঘর তৈরি করে দেওয়া
হচ্ছে। বাংলাদেশের একটি মানুষও আর গৃহহীন থাকবে না।
“করোনাভাইরাস
মহামারিতে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে আমরা ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকার
২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি। ৯৯.৭৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার
আওতায় এসেছে। মাথাপিছু আয় ২০০৫-০৬ সালের ৫৪৩ মার্কিন ডলার হতে বৃদ্ধি পেয়ে
বর্তমানে ২৫৫৪ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।”
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন,
কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্প
ব্যাবসা-বাণিজ্যসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন
বিশ্বের বুকে ‘রোল মডেল’। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মর্যাদাশীল
‘উন্নয়নশীল’ দেশে উন্নীত হওয়ার জাতিসংঘের চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে।
“বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিব বাংলাদেশকে ‘স্বল্পোন্নত’ দেশে উন্নীত করেন, আর আমরা মাতৃভূমিকে
‘উন্নয়নশীল’ দেশের কাতারে নিয়ে গেলাম ‘মুজিববর্ষ’ এবং স্বাধীনতার
সুবর্ণজয়ন্তীর এ শুভক্ষণে। স্বাধীনতার পর বিগত ৫০ বছরে আমাদের যা কিছু
অর্জন তা জাতির পিতা এবং আওয়ামী লীগের হাত ধরেই হয়েছে।
“আমি দৃঢ়ভাবে
বিশ্বাস করি, আমাদের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব দরবারে
বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও
উন্নত-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে পরিণত হবে, ইনশাল্লাহ।”