ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
ঢালাও বিধিনিষেধের 'ফাঁদে' পা দেওয়া যাবে না
Published : Friday, 7 January, 2022 at 12:00 AM
শহীদুল্লাহ সিকদার ||
করোনাভাইরাসের নতুন রূপ ওমিক্রনের বিস্তারে সারাবিশ্বে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। আমাদের দেশেও রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও ব্যাপক হারে সংক্রমণের খবর এখনও পাওয়া যায়নি। এর পরও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ভয়াবহতা আমাদের জন্য লাল সংকেত দিচ্ছে। তাই এ মহামারি মোকাবিলায় এরই মধ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গণপরিবহনে আগের মতো এক আসন খালি রেখে অর্ধেক সংখ্যক আসনে যাত্রী পরিবহনের বিষয়টি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকার ভাবতে শুরু করেছে। হয়তো দ্রুত এ ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সিদ্ধান্ত আসবে। মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে গণপরিবহনে সীমিত সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলাচল অন্যতম। অফিস-আদালতও রুটিন করে সীমিত জনবল দিয়ে পরিচালনা করা যেতে পারে। তবে কোনোভাবেই ঢালাও বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত হবে না। জীবন ও জীবিকার কথা বিবেচনায় নিয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। যেমন- বিশেষ কোনো এলাকায় সংক্রমণ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে শুধু সেই এলাকাকেই লকডাউনের আওতায় আনা যেতে পারে। পুরো দেশে লকডাউন চাপিয়ে দেওয়াটা উচিত হবে না। কারণ এ ধরনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। জীবন ও জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সরকার সিদ্ধান্ত নিলে সেখান থেকে আশানুরূপ ফল আসবে। সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্তে সুফলের চেয়ে ভোগান্তি বাড়বে। যদি একটি উপজেলা, জেলা, মহানগরী বা মহানগরীর একটি ওয়ার্ডে করোনা ছড়িয়ে পড়ে তাহলে শুধু ওই এলাকাকেই বিধিনিষেধের আওতায় আনতে হবে। পুরো অঞ্চল বা দেশকে সেই আওতায় আনা যাবে না।
করোনা থেকে বাঁচতে হলে প্রধান কাজ হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। মাস্ক পরিধান, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। বিয়েশাদিসহ সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে লোকজনের ব্যাপক উপস্থিতি বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে লোকজনের ব্যাপক উপস্থিতি যেন ওমিক্রন ছড়িয়ে না দেয়, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। গণপরিবহনে অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী পরিবহন করলেই চলবে না; সবার মুখে মাস্ক নিশ্চিত করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাসে মাস্ক পরিধান করে, কিন্তু বাস থেকে নেমেই রেস্টুরেন্ট বা অন্য কোথাও গিয়ে লোকজনের সঙ্গে আড্ডা দেয়। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। কারণ নিজেরা সচেতন না হলে এ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
করোনা প্রতিরোধে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও টিকা দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়েছেন। প্রথম ডোজ নেওয়া নাগরিকের সংখ্যা আরও বেশি। এমনকি আমাদের দেশে বুস্টার ডোজ বা তৃতীয় ডোজ টিকা দেওয়াও শুরু হয়ে গেছে। আশা করি, এই ধারাবাহিকতায় দেশের সব মানুষ পর্যায়ক্রমে টিকা পাবেন। কিন্তু টিকা নিলেই যে আর করোনায় সংক্রমিত হবে না- এমনটা বলা যাচ্ছে না। ইউরোপের অনেক দেশে টিকা নেওয়ার পরও সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। তবে এ কথা সত্য, টিকা নেওয়া ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলেও মারা যাওয়ার হার কম। কারণ তার শরীরে করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পায়। করোনা থেকে মুক্ত থাকতে চাইলে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। গত ছয় মাস ধরে আমাদের দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি এ হার বাড়তে শুরু করেছে।

কেউ কেউ বলেন, মার্চ-এপ্রিলে বাংলাদেশে সংক্রমণ বেড়ে যায়। এবার কিন্তু জানুয়ারিতেই চোখ রাঙাচ্ছে করোনা। বিশেষ করে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন এ ভয় অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। ওমিক্রনে আক্রান্ত হওয়ার সংবাদে আমরা কিছুটা চিন্তিত হলেও আশাবাদী যে, সবাই সচেতন হলে আগের মতোই এ মহামারি মোকাবিলা করে দেশ-জাতি নিরাপদ থাকবে। ভাইরাসের ধর্ম হচ্ছে- এরা অন্য বাহন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে বেঁচে থাকতে পারে না। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা গেলে এ ভাইরাস মোকাবিলা যতটা সহজ, ততটা অন্য কোনো উপায়ে সম্ভব নয়।
আমি আগেও বলেছি, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আমাদের বিশেষজ্ঞরা যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তা মেনে নিতে হবে। যেমন- গণপরিবহনে অর্ধেক সংখ্যক আসনে চলতে হবে। এভাবে অফিস-আদালতে নিয়ন্ত্রণ আনা যেতে পারে। কিন্তু শিল্প-কারখানার চাকা বন্ধ করে দিয়ে দেশের অর্থনীতি অচল করা যাবে না। আমরা আগেও দেখেছি, লকডাউনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গার্মেন্ট চালু রাখা হয়েছিল। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। অনেক দিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। ঝিমিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন উদ্যম তৈরি হয়েছে। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। জানি, যদি সংক্রমণের ভয়াবহতা বেড়ে যায় সে ক্ষেত্রে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ না করে হঠাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া উচিত হবে না। বরং এখানে পারস্পরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে অর্ধেক সংখ্যক শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে রুটিন করে ক্লাস নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলতে হবে। শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
ওমিক্রন দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেও এতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার হার কম। তাই বলে কোনো ধরনের গাফিলতি করা যাবে না। এ ভাইরাস মোকাবিলায় ঘর থেকে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। যদি কোনো কারণে আমাদের দেশে এর ব্যাপক হারে বিস্তার ঘটে, তাহলে সে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। পর্যাপ্ত আইসিইউ, অক্সিজেনের অভাবে অনেককে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। এত সংখ্যক রোগীর হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ থাকবে না। এর পরও সরকার যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিচ্ছে। রোগী শনাক্তে পরীক্ষা পদ্ধতি এবং দ্রুত ফলাফল নিশ্চিত করতে হবে। এটা মফস্বল শহর থেকে একেবারে গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। নতুন উপসর্গ বিষয়ে চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। উপসর্গ দেখা দিলে রোগ গোপন না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
সঠিক পরিকল্পনা নিতে পারলে যে কোনো সংকট মোকাবিলা সম্ভব- সেটি বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে। দীর্ঘ লকডাউনে অনেকে আশঙ্কা করেছিল, দেশে খাদ্য সংকট হবে। কিন্তু কৃষকের প্রাণান্ত চেষ্টা আর সরকারের সঠিক পদক্ষেপে আমাদের সে সংকট হয়নি। বরং সেই সংকটকালে কৃষকের ধান কাটতে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সচেতন মানুষ কাস্তে হাতে মাঠে নেমেছিলেন। এ দেশে কোনো মানুষ না খেয়ে বা বিনা চিকিৎসায় মারা যায়নি। তাই ওমিক্রন নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। আবার মৃত্যুহার কম ভেবে সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকলেও চলবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবিকার তাগিদে নিজ নিজ দায়িত্ব চালিয়ে যেতে হবে। পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, লকডাউনের সময় ঘরে ঘরে উপহারসামগ্রী পৌঁছে দিয়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আমাদের সন্তানরা। প্রয়োজন হলে আবার তারা এগিয়ে আসবে- এ বিশ্বাস আছে।

অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার: সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়