ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
আতঙ্কিত না হয়ে নিয়মের মধ্যে থাকুন
Published : Friday, 7 January, 2022 at 12:00 AM
আতঙ্কিত না হয়ে নিয়মের মধ্যে থাকুনঅজয় দাশগুপ্ত ||
মানুষের চেয়ে অসহায় আর কোনো প্রাণী এখন কি আছে? গত কয়েক দশক, বিশেষত গত শতাব্দীজুড়ে মানুষের অগ্রযাত্রায় মনে হচ্ছিল তার শক্তি অসীম হলেও হতে পারে। কিন্তু সেটা ভুল বা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেছে। কোভিড আসার পর থেকে অসহায় মানবকুলের জন্য প্রকৃতি বা অলৌকিকতার আশীর্বাদ ছাড়া আর কী আছে বলা মুশকিল।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে এখন ওমিক্রন আতঙ্ক তুঙ্গে। যখন প্রথম করোনা হানা দিয়েছিল সরকার-রাষ্ট্র কেউই পাত্তা দেয়নি। একটু একটু করে করোনা যখন চেপে বসল, টনক নড়েছিল তাদের। অস্বীকার করা যাবে না, পরে সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় লাখো কোটি মানুষ দারিদ্র্য আর অভাবের হাত থেকে বেঁচে যায়। খাইয়ে-পরিয়ে, সাময়িক ঋণ মাফ করে দিয়ে সরকার বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু এবার তারা দায় নিতে নারাজ। সবাই জানেন পুঁজিবাদী সমাজ ও দেশে টাকাই সব। আমি এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমাদের দেশে যত খারাপ আর ভয়ঙ্কর সমাজ মনে হোক না কেন, যে টান, আগ্রহ আর মায়া আছে তা এখানে নেই। থাকার কারণও নেই। প্রথমত, মানুষ আসে বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন সমাজ থেকে। তাদের ভাষা, খাবার, পোশাক, রুচি কিছুর মিল নেই। এমনকি ভাষা, রুচি, সংস্কৃতিও ভিন্ন। কেবল এক পতাকা, এক দেশে বসবাস করলেই মায়া জন্মায় না। মায়াহীন সরকার দেখভাল করে বাঁচিয়ে রাখার দেশে যদি সরকার সাহায্য না করে আর মানুষ করোনায় মারা যায় তার চেয়ে কষ্টের কী থাকতে পারে?
আমাদের সমাজে এখনো মানুষ পরস্পর জড়াজড়ি করে বাঁচে। এর ভালো দিক হচ্ছে মায়ামমতা। অন্যদিকে করোনা এমন এক রোগ যা চায় না মানুষ ভালোবেসে কাছে থাকুক। চায় না মানুষের মেলামেশা। কঠিন হলেও সত্য, মানুষের দেখাদেখিও বন্ধ করার চেষ্টা করছে করোনার নতুন সংক্রমণ। তবে আশার কথা, এই এখনো বিজ্ঞানীরা বলছেন এবার তার দফারফা হওয়ার পথে। কতটা সত্য জানি না, তবে এটা বলা হচ্ছে ওমিক্রন নাকি চার ঘণ্টা সঙ্গে থাকলে তবেই সংক্রমিত হয়। বলা হচ্ছে, সবকিছু খোলা রেখে স্বাভাবিক রেখেও নাকি এর দমন সম্ভব। এ মতামতের ব্যাপারেই তর্ক আছে। অনেকে মনে করেন, সবকিছু চালু রাখা, ব্যবসায়িক আর্থিক লোকসান বন্ধ করার জন্যই নাকি এগুলো বলা হচ্ছে। যাতে মানুষকে সাহায্য করতে না হয় আর ব্যবসা চলে পুরোদমে।
সে যাই হোক বাংলাদেশেও অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে পরিবেশ। আমাদের দেশে নিয়ম না মানার অনেকগুলো কারণ। দরিদ্রতা আর অভাব যতটা, খেয়ালখুশি বা গায়ের জোরও কম কিছু নয়। যেসব বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হচ্ছে সেগুলো না হলেও চলে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? আমাদের সমাজে আরেক আপদ রাজনীতি। এই যে এখন ওমিক্রন হানা দিয়েছে এমন কঠিন সময়ে নির্বাচন হওয়া কি জরুরি? না এটা দেশের সরকার নির্ধারণের নির্বাচন? তার পরও নারায়ণগঞ্জে ইলেকশন হবেই। মানুষ আক্রান্ত হবে, দরকার হলে জান হারাবে তবু চলবেই চলবে। সরকারি তরফ থেকে আদেশ দেওয়ার কাজ শেষ।
দেশের বন্দরগুলোতে ওমিক্রন আক্রান্ত দেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্ক্রিনিং জোরদার করতে হবে। সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে হবে। রেস্তোরাঁয় ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম লোক বসে খেতে পারবে। সব ধরনের জনসমাবেশ, পর্যটন স্থান, বিনোদনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল বা থিয়েটার হল ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম লোক অংশ নিতে পারবে। যারা এখনো কোভিড টিকা নেননি, টিকাকেন্দ্রে গিয়ে তাদের প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে।
এসব নির্দেশ নিঃসন্দেহে জরুরি। কিন্তু সরকারি লোকজনই এসব মানছে না। মানলে নির্বাচন সমাবেশ কিংবা মেলামেশা শিথিল করা হতো। মানুক আর না মানুক মূলত সমস্যা মানুষের নিজেদের। যে কথা বলছিলাম, উন্নত দেশ নামে পরিচিত দেশের সরকার এক ধরনের সিগন্যাল দিয়ে দিয়েছে। তাদের কথা হচ্ছে, যার যার দায়দায়িত্ব তার তার। তোমার আয়-উপার্জন, বাঁচা-মরা তোমার হাতে। কাজেই সিদ্বান্ত নিজেদের।
বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা কী মনে করছেন এ বিষয়ে : বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশে আগামী তিন থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিরাময় ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এখনো মানুষ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টেই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, কিন্তু ওমিক্রনের সংক্রমণ শক্তি বেশি হওয়ায় আরও বেশিসংখ্যক লোক আক্রান্ত হবে বলে তিনি ধারণা করছেন।
কথাগুলো উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আবারও বলছি, সিডনিতে পরিবেশ ক্রমেই খারাপ হয়ে উঠছে। সেদিন এক বাঙালি ভদ্রলোক বয়সে প্রবীণ আমাকে বলছিলেন তার কষ্টের কথা। তার একমাত্র ছেলে করোনা আক্রান্ত। কিন্তু বাপ হিসেবে তিনি না পারছেন যেতে, না তার পাশে দাঁড়াতে। এই মনোবেদনার চাপে তিনি দিশাহারা। বললেন, প্রায়ই চোখের পানি ফেলেন- এ ছাড়া কী করার আছে? তার এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সাধ্য আমার কেন, কারও নেই। কিন্তু এটাই বাস্তবতা।

কাজের কথা হচ্ছে, বাস্তবতা মেনেই বিধিনিষেধ দেওয়া। আর সে নিষেধগুলো মান্য করা। নানা দেশে নৈশকালীন কারফিউ চালু রয়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে, যোগাযোগ ও মেলামেশা সীমিত করে রাখার। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। সমাজে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। কত মানুষ এসব বোঝেই না। এদের নিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। মানাতে হবে যতটা সম্ভব। অন্যথায় আবারও পড়তে হবে বিপদের মুখে।
আশার কথা, এই বাংলাদেশে যত দুর্ভাবনা প্রায় সবটাই ব্যর্থ করে দিয়েছে সময়। আশার কথা, এই মানুষ সচল থাকলেও মাস্ক পরছে এবং আরও একটা ভরসার বিষয় সচেতনতা বেড়েছে। মূলত লেখাপড়া জানেন এমন নামে পরিচিত মানুষজনই লোভ সামলাতে পারে না। তারাই নিয়ম ভাঙে। তাদের দরকার হয় ঘুরে বেড়ানোর। কী দরকার দলে দলে এখন কক্সবাজার যাওয়ার? ছুটি কি শুধু দলবেঁধে সবাই মিলে কাটানোর জন্য? আর তাও কেবল একটি জায়গায়? এই ধারণাগুলো বদলাতে হবে। পরিবার-পরিজন সবাই মিলে ভালো থাকার জন্য সামান্য কিছু নিয়ম মানা আর সাবধানতা। আশা করি এটুকু বুঝতে পারবে মানুষ।
ওমিক্রন দূর হোক। ভালো হোক মানুষের।

 
অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক, সিডনি