কবিতার কথা
জীবনানন্দ দাশ ||
সকলেই কবি নয়। কেউ-কেউ কবি; কবি-কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধ’রে এবং তাদের সঙ্গে-সঙ্গে আধুনিক জগতের নব-নব কাব্য-বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে, তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।
বলতে পারা যায় কি এই সম্যক কল্পনা-আভা কোথা থেকে আসে? কেউ-কেউ বলেন, আসে পরমেশ্বরের কাছ থেকে। সে- কথা যদি স্বীকার করি তাহলে একটি সুন্দর জটিল পাককে যেন হিরে’র ছুরি দিয়ে কেটে ফেললাম। হয়তো সেই হিরে’র ছুরি পরিদেশের, কিংবা হয়তো সৃষ্টির রক্ত চলাচলের মতোই সত্য জিনিস। কিন্তু মানুষের জ্ঞানের এবং কাব্য সমালোচনা- নমুনার নতুন-নতুন আবর্তনে বিশ্লেষকেরা এই আশ্চর্য গিটকে-আমি যত দূর ধারণা করতে পারছি-মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খসাতে চেষ্টা করবেন। ব্যক্তিগত ভাবে এ-সম্বন্ধে আমি কী বিশ্বাস করি-কিংবা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করবার মতো কোনও সুস্থিরতা খুঁজে পেয়েছি কি-না-এ-প্রবন্ধে সে-সম্বন্ধে কোনও কথা বলব না আমি আর। কিন্তু যারা বলেন সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে-পৃথিবীর কিংবা স্বকীয় দেশের বিগত ও বর্তমান কাব্যবেষ্টনীর ভিতর চমৎকার রূপে দীক্ষিত হয়ে নিয়ে, কবিতা রচনা করতে হবে, তাদের এ- দাবির সম্পূর্ণ মর্ম আমি অন্তত উপলব্ধি করতে পারলাম না। কারণ আমাকে অনুভব করতে হয়েছে যে, খণ্ড-বিখণ্ডিত এই পৃথিবী, মানুষ ও চরাচরের আঘাতে উত্থিত মৃদুতম সচেতন অনুনয়ও এক-এক সময় যেন থেমে যায়,-একটি-পৃথিবীর-অন্ধকার-ও-স্তব্ধতায় একটি মোমের মতন যেন জ্ব’লে ওঠে হৃদয়, এবং ধীরে-ধীরে কবিতা-জননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায়। এই চমৎকার অভিজ্ঞতা যে-সময় আমাদের হৃদয়কে ছেড়ে যায়, সে-সব মুহূর্তে কবিতার জন্ম হয় না, পদ্য রচিত হয়, যার ভিতর সমাজশিক্ষা, লোকশিক্ষা, নানা রকম চিন্তার ব্যায়াম ও মতবাদের প্রাচুর্যই পাঠকের চিত্তকে খোঁচা দেয় সব-চেয়ে আগে এবং সব-চেয়ে বেশি ক’রে; কিন্তু তবুও যাদের প্রভাব ক্ষণস্থায়ী, পাঠকের মন কোনও আনন্দ পায় না, কিংবা নিম্নস্তরের তৃপ্তিবোধ করে শুধু, এবং বৃথাই কাব্যশরীরের আভা খুঁজে বেড়ায়।
আমি বলতে চাই না যে, কবিতা সমাজ বা জাতি বা মানুষের সমস্যা-খচিত-অভিব্যক্ত সৌন্দর্য হবে না। তা হতে বাধা নেই। অনেক শ্রেষ্ঠ কাব্যই তা হয়েছে। কিন্তু সে-সমস্ত চিন্তা, ধারণা, মতবাদ, মীমাংসা কবির মনে প্রাক্কল্পিত হয়ে কবিতার কঙ্কালকে যদি দেহ দিতে যায় কিংবা সেই দেহকে দিতে চায় যদি আভা, তা হলে কবিতা সৃষ্ট হয় না-পদ্য লিখিত হয় মাত্র- ঠিক বলতে গেলে পদ্যের আকারে সিদ্ধান্ত, মতবাদ ও চিন্তার প্রক্রিয়া পাওয়া যায় শুধু। কিন্তু আমি আগেই বলেছি কবির প্রণালী অন্য রকম, কোনও প্রাক্নির্দিষ্ট চিন্তা বা মতবাদের জমাট দানা থাকে না কবির মনে কিংবা থাকলেও সেগুলোকে সম্পূর্ণ নিরস্ত ক’রে থাকে কল্পনার আলো ও আবেগ; কাজেই চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ প্রকৃত কবিতার ভিতর সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনে শিরা, উপশিরা ও রক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকে যেন। লুকিয়ে থাকে; কিন্তু নিবিষ্ট পাঠক তাদের সে-সংস্থান অনুভব করে; বুঝতে পারে যে, তারা সঙ্গতির ভিতর রয়েছে, অসংস্থিত পীড়া দিচ্ছে না; কবিতার ভিতর আনন্দ পাওয়া যায়; জীবনের সমস্যা ঘোলা জলের মূষিকাঞ্জলির ভিতর শালিকের মতো স্নান না ক’রে বরং যেন করে আসন্ন নদীর ভিতর বিকেলের সাদা রৌদ্রের মতো,-সৌন্দর্য ও নিরাকরণের স্বাদ পায়।
এ না হলে আমরা জিজ্ঞাসা ও চিন্তার জন্যে কেন পতঞ্জলি’র কাছে যাব না, বেদান্ত’র কাছে যাব না, ষড়দর্শন’এর কাছে যাব না, মাঘ ও ভারবি’র কাছে না গিয়ে ? জীবনের ও সমাজের ও জাতির সমস্যার সম্বন্ধে উৎকৃষ্ট আলোক চাই-অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণণ, মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরু’র কাছে যাব না কেন, রবীন্দ্রনাথ’এর কাব্যের কাছে না গিয়ে; দার্শনিক বার্গস’র কাছে যাওয়া উচিত, ইংলন্ড’এর বা রুশিয়ার অর্থনীতি ও সমাজনীতিবিদ সুধী ও কর্মীদের কাছে যাওয়া উচিত-ইয়েটস’এর কাব্যের কাছে, এমন-কি এলিয়ট ইত্যাদির কাব্যপ্রচেষ্টার কাছেও নয়।
এখন আমি আর একটা কথা বলতে চাই খানিকটা অত্যুক্তি ক’রেই যেন, অথচ যা অত্যুক্তি নয়-আমার কাছে অন্তত সত্য ব’লে মনে হয় কাব্যের ভিতর লোকশিক্ষা ইত্যাদি অর্ধনারীশ্বরের মতো একাত্ম হয়ে থাকে না; ঘাস, ফুল বা মানবীর প্রকট সৌন্দর্যের মতো নয়; তাদের সৌন্দর্যকে সার্থক করে কিন্তু তবুও সেই সৌন্দর্যের ভিতর গোপন ভাবে বিধৃত রেখা-উপরেখার মতো যে-জিনিসগুলো মানবী বা ঘাসের সৌন্দর্যের আভার মতো রসগ্রাহীকে প্রথমে ও প্রধান ভাবে মুগ্ধ করে না- কিন্তু পরে বিবেচিত হয়-অবসরে তার বিচারকে তৃপ্ত করে। যাঁরা এ-কথা স্বীকার করেন না, যাঁরা বলতে চান যে কবিতার ভিতর প্রথম প্রধান দর্শনীয় জিনিস কিংবা সৌন্দর্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সৌন্দর্যের মতোই প্রধান জিনিস, হচ্ছে লোকশিক্ষা বা দর্শন বা নানা রকম সমস্যার উদঘাটন, তাঁদের আমি এই কথা বলতে চাই যে, মানুষ সে যে অনৈতিহাসিক শতাব্দীতেই প্রথম হোক না কেন-একটা বিশেষ রস সৃষ্টি করল যা দর্শন বা ধর্ম বা বিজ্ঞানের রস নয়,-যাকে বলা হল কাব্য (বা শিল্প)-যার কতগুলো ন্যায্য পদ্ধতি ও বিকাশ রয়েছে; যার আস্বাদে আমরা এমন একটা তৃপ্তি পাই, বিজ্ঞান বা দর্শন এমন-কি ধর্মের আস্বাদেও যা পাই না-এবং ধর্ম বা দর্শনের ভিতরে যে-তৃপ্তি পাই কাব্যের ভিতর অবিকল তা পাই না; পৃথিবীর শতাব্দী-স্রোতের ভিতর মানুষ যদি এমন একটা বিশেষ রস-বৈচিত্র্য সৃষ্টি করল (কিংবা হয়তো অমানব কেউ মানুষের জন্যে সৃষ্টি করল)-কি ক’রে সেই বিচিত্রতার নিকট তার অনধিগত, অতিরিক্ত দাবি আমরা করতে পারি? কিংবা সেই সব দাবি কবিতা যদি মেটাচ্ছে বা মেটাতে পারে ব’লে মনে করি তাহলে তার ন্যায্য ধর্ম অভঙ্গুর নয় আর; তার বিশেষ স্থিতির কোনও প্রয়োজন নেই। সে যা দিতে পারে দর্শনও তা দিতে পারে, ধর্মও তা দিতে পারে; সমাজসংস্কারক, জাতিসংস্কারক মনীষীরা এমন-কি কর্মীরাও তা দিতে পারে। তাহলে কাব্যের স্বকীয় সিদ্ধির কোনও প্রয়োজন থাকে না। কিন্তু আমি জানি কাব্যের নিজের ইন্টিগ্রিটি’র প্রয়োজন রয়েছে। এবং এই প্রবন্ধের ভিতর আমার নিজের কথারই পুনরুক্তি ক’রে আমি বলব সকলেই কবি নয়। কেউ-কেউ কবি; কবি-কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধ’রে এবং তাদের সঙ্গে-সঙ্গে আধুনিক জগতের নব-নব কাব্য-বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে।’ দর্শন বা সমাজসংস্কার বা মানুষের কর্ম ও মননের জগতে অন্য কোনও বিকাশের ভিতর এই কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার ঠিক এই ধরনের সারবত্তা নেই।
হতে পারে কবিতা জীবনের নানা রকম সমস্যার উদঘাটন; কিন্তু উদঘাটন দার্শনিকের মতো নয়; যা উদঘাটিত হল তা যে-কোনও জঠরের থেকেই হোক আসবে সৌন্দর্যের রূপে, আমার কল্পনাকে তৃপ্তি দেবে; যদি তা না দেয় তাহলে উদঘাটিত সিদ্ধান্ত হয়তো পুরোনো চিন্তার নতুন আবৃত্তি, কিংবা হয়তো নতুন কোনও চিন্তাও (যা হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে,) কিন্তু তবুও তা কবিতা হল না, হল কেবলমাত্র মনোবীজরাশি। কিন্তু সেই উদঘাটন-পুরোনোর ভিতরে সেই নতুন কিংবা সেই সজীব নতুন যদি আমার কল্পনাকে তৃপ্ত করতে পারে, আমার সৌন্দর্যবোধকে আনন্দ দিতে পারে, তাহলে তার কবিতাগত মূল্য পাওয়া গেল; আরও নানা রকম মূল্য-যে- সবের কথা আগে আমি বলেছি-তার থাকতে পারে, আমার জীবনের ভিতর তা আরও খানিকটা জ্ঞান বীজের মতো ছড়াতে পারে, আমার অনুভূতির পরিধি বাড়িয়ে দিতে পারে, আমার দৃষ্টি-স্থূলতাকে উঁচু মঠের মতো যেন একটা মৌন সূক্ষ্মশীর্ষ আমোদের আস্বাদ দিতে পারে; এবং কল্পনার আভায় আলোকিত হয়ে এ-সমস্ত জিনিস যত বিশাল ও গভীর ভাবে সে নিয়ে আসবে কবিতার প্রাচীন প্রদীপ ততই নক্ষত্রের নূতনতম কক্ষ-পরিবর্তনের স্বীকৃতি-ও-আবেগের মতো জ্বলতে থাকবে।
প্রত্যেক মনীষীরই একটি বিশেষ প্রতিভা থাকে নিজের রাজ্যেই সে সিদ্ধ। কবির সিদ্ধিও তার নিজের জগতে; কাব্যসৃষ্টির ভিতরে। আমরা হয়তো মনে করতে পারি যে, যেহেতু সে মনীষী, কাজেই অর্থনীতি সম্বন্ধে-সমাজনীতি, রাজনীতি সম্বন্ধে-মননরাজ্যের নানা বিভাগেই, কবির চিন্তার ধারা সিদ্ধ। আমাদের উপলব্ধি করে নিতে হবে যে, তা নয়। উপকবির চিন্তার ধারা অবশ্য সব বিভাগেই সিদ্ধ-যেমন উপ-দার্শনিকের। কিন্তু প্রতিভা যাকে কবি বানিয়েছে কিংবা সঙ্গীত বা চিত্রশিল্পী বানিয়েছে-বুদ্ধির সমীচীনতা নয়,- শিল্পের দেশেই সে সিদ্ধ শুধু-অন্য কোথাও নয়। এক জন প্রতিভাযুক্ত মানুষের কাছ থেকে আমরা যদি তার শ্রেষ্ঠ দান চাই, কোনও দ্বিতীয় স্তরের দান নয়, তাহলে তা পেতে পারি সেই রাজ্যের পরিধির ভিতরেই শুধু যেখানে তার প্রতিভার প্রণালী ও বিকাশ তর্কাতীত। শেক্সপীয়র’এর কথাই ধরা যাক- তার এক-একটি নাটক পড়তে-পড়তে বোঝা যায়, মনোবৈজ্ঞানিকের কাছে যেমন ক’রে পাই তেমন ক’রে নয়, মানবচরিত্র ও মানুষের প্রদেশ সম্বন্ধে নানা রকম অর্থ ও প্রভূত সত্যের ইঙ্গিত পাওয়া গেল কাব্যের সমুদ্রবীজনের গভীরে-গভীরে মুক্তার মতো, কিংবা কাব্যের আকাশের ওপারে আকাশে স্বাদিত অনাস্বাদিত নক্ষত্রের মতো সব খুঁজে পাওয়া গেল যেন। কারণ এখন আমরা প্রতিভার সঙ্গে বিহার করছি সেই রাজ্যে যেটি তাঁর নিজস্ব। কিন্তু শেক্সপীয়র’কে যদি ইংলন্ড’এর কোনও জনসভায় দাঁড়িয়ে প্রবন্ধ পাঠ করতে হত এলিজাবেথীয় সমাজ সম্বন্ধে, আমি ধারণা করতে পারি না যে, অন্য কোনও অভিজ্ঞ সমাজনীতিবিদের চেয়ে তা কোনও অংশে অসাধারণ কিছু হত (হয়তো হাসি তামাশা এবং যুক্তিহীন মুখর প্রশংসা থাকত সেই সমাজ ও সমাজপতিদের সম্বন্ধে)। কিংবা শেক্সপীয়র’কে যদি ইংলন্ড’এর কোনও বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে ইংলন্ড’এর তখনকার রাজনীতি সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতে হত, সে-অভিভাষণের ভিতর কোনও বাগ্মিতা থাকত ব’লে মনে হয় না-তা না-ই বা থাকল- কিন্তু তেমন কোনও সারবত্তাও থাকত না ইংলন্ড’এর তখনকার রাজনীতিজ্ঞদের আলোচনায়ও যেটুকু রয়েছে; কিংবা তার ঈষৎ প্রতিবিম্বও থাকত না শেক্সপীয়র’এর নিজের কাব্যে-অন্য রকম সারবত্তার যে-আশ্চর্য ব্যাপক গভীরতা আমাদের বিস্মিত করে। বৈষ্ণব যুগ থেকে শুরু ক’রে আজ পর্যন্ত আমাদের কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। শেক্সপীয়র’এর সম্বন্ধে যেকথা বললাম রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধেও ঠিক সেই কথাই বলা চলে-সব কবির সম্বন্ধেই। অন্য সমস্ত প্রতিভার মতো কবি-প্রতিভার কাছেও শ্রেষ্ঠ জিনিস পেতে হলে যেখানে তার প্রতিভার স্বকীয় বিকাশ হবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা, সেই শিল্পের রাজ্যে তাকে খুঁজতে হবে; সেখানে দর্শন নেই, রাজনীতি নেই, সমাজনীতি নেই, ধর্মও নেই কিংবা এই সবই রয়েছে, কিন্তু তবুও এ-সমস্ত জিনিস যেন এ-সমস্ত জিনিস নয় আর; এ-সমস্ত জিনিসের সম্পূর্ণ সারবত্তা ও ব্যবহারিক প্রচার অন্যান্য মনীষী ও কর্মীদের হাতে যেন কবির হাতে আর নয়। কেউ যেন মনে না করেন আমি কবিকে কাব্যসৃষ্টি ছাড়া অন্য কোনও কাজ করতে নিষেধ করছি। আমি তা মোটেই করছি না। কবি তার ব্যবহারিক জীবনে-কর্ম- ও মননরাজ্যে-যেখানে যে-অসঙ্গতি বা অন্ধকার রয়েছে ব’লে মনে করেন সব কিছুর সঙ্গেই সংগ্রাম করতে সম্পূর্ণ উপযুক্ত; এই প্রবন্ধের আরম্ভেই আমি বলেছি যে, তার কাব্যেও কল্পনার-ভিতর-চিন্তা-ও-অভিজ্ঞতার সারবত্তা থাকবে। আমি তার প্রতিভার স্বধর্মের কথা বলেছি; কাব্য সম্পর্কে যে-জিনিসের বিশ্লেষণ ইতিপূর্বে আমি করেছি; এবং ব্যবহারিক জীবনে যেস্বধর্ম অসাধারণ কিছু দিতে পারে না, এমন-কি কাব্যজীবনকে নষ্ট ক’রেও দিতে পারে না ব’লে উল্লেখ করেছি। সে যদি বাস্তবিক কবি হয়, তাহলে তার কাব্যের মতো অসাধারণ কোনও দ্বিতীয় জিনিস ব্যবহারিক জীবনের পদ্ধতির ও প্রকাশের নিকট দান করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিমান লোকের মতো কর্ম ও চিন্তা দান করতে পারে সে, ব্যবহারিক মানুষ হিসেবে। সেখানে তার কাব্যজগতের কল্পনা-মনীষার মুক্তি নেই-এবং তার প্রয়োজনও নেই।
যারা আমার প্রবন্ধ এই পর্যন্ত অনুসরণ করেছেন তারা নিশ্চয়ই বুঝেছেন যে, আমি বলতে চাই না যে, কাব্যের সঙ্গে জীবনের কোনও সম্বন্ধ নেই; সম্বন্ধ রয়েছে- কিন্তু প্রসিদ্ধ প্রকট ভাবে নেই। কবিতা ও জীবন একই জিনিসেরই দুই রকম উৎসারণ; জীবন বলতে আমরা সচরাচর যা বুঝি তার ভিতর বাস্তব নামে আমরা সাধারণত যা জানি তা রয়েছে, কিন্তু এই অসংলগ্ন অব্যবস্থিত জীবনের দিকে তাকিয়ে কবির কল্পনা-প্রতিভা কিংবা মানুষের ইমাজিনেশন সম্পূর্ণ ভাবে তৃপ্ত হয় না; কিন্তু কবিতা সৃষ্টি ক’রে কবির বিবেক সান্ত্বনা পায়, তার কল্পনা-মনীষা শান্তি বোধ করে, পাঠকের ইমাজিনেশন তৃপ্তি পায়। কিন্তু সাধারণত বাস্তব বলতে আমরা যা বুঝি তার সম্পূর্ণ পুনর্গঠন তবুও কাব্যের ভিতর থাকে না: আমরা এক নতুন প্রদেশে প্রবেশ করেছি। পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা করা যায়, কিংবা পৃথিবীর সমস্ত দীপ ছেড়ে দিয়ে এক নতুন প্রদীপের কল্পনা করা যায়-তা হলে পৃথিবীর এই দিন, রাত্রি, মানুষ ও তার আকাক্সক্ষা এবং সৃষ্টির সমস্ত ধুলো, সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে ছেড়ে দিয়ে এক নতুন ব্যবহারের কল্পনা করা যেতে পারে, যা কাব্য;- অথচ জীবনের সঙ্গে যার গোপনীয় সুড়ঙ্গ-লালিত সম্পূর্ণ সম্বন্ধ সম্বন্ধের ধূসরতা ও নূতনতা। সৃষ্টির ভিতর মাঝে-মাঝে এমন শব্দ শোনা যায়, এমন বর্ণ দেখা যায়, এমন আঘ্রাণ পাওয়া যায়, এমন মানুষের বা এমন অমানবীয় সংঘাত লাভ করা যায়- কিংবা প্রভূত বেদনার সঙ্গে পরিচয় হয় যে, মনে হয় এই সমস্ত জিনিসই অনেক দিন থেকে প্রতিফলিত হয়ে কোথায় যেন ছিল; এবং ভঙ্গুর হয়ে নয়, সংহত হয়ে, আরও অনেক দিন পর্যন্ত, হয়তো মানুষের সভ্যতার শেষ জাফরান রৌদ্রালোক পর্যন্ত, কোথাও যেন রয়ে যাবে; এই সবের অপরূপ উদগীরণের ভিতরে এসে হৃদয়ে অনুভূতির জন্ম হয়, নীহারিকা যেমন নক্ষত্রের আকার ধারণ করতে থাকে তেমনই বস্তুসঙ্গতির প্রসব হতে থাকে যেন হৃদয়ের ভিতর; এবং সেই প্রতিফলিত অনুচ্চারিত দেশ ধীরে-ধীরে উচ্চারণ ক’রে ওঠে যেন, সুরের জন্ম হয়; এই বস্তু ও সুরের পরিণয় শুধু নয়, কোনও-কোনও মানুষের কল্পনা-মনীষার ভিতর তাদের একাত্মতা ঘটে-কাব্য জন্ম লাভ করে।
কবিতা মুখ্যত লোকশিক্ষা নয়; কিংবা লোকশিক্ষাকে রসে মণ্ডিত ক’রে পরিবেশন-না, তা-ও নয়; কবির সে-রকম কোনও উদ্দেশ্য নেই। কিঙ্ লিয়ার কিংবা বলাকা’র কবিতায়-এবং পৃথিবীর সমস্ত শ্রেষ্ঠ কাব্যেই- কবির কল্পনা-প্রতিভার বিচ্ছুরণে, কিংবা তার সৃষ্ট কবিতার ভিতর সে-রকম কোনও লক্ষ্যের প্রাধান্য নেই। কবিতাপাঠ হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র রসাস্বাদ যার পরিচয় দিয়েছি ইতিপূর্বে। কিন্তু তবুও কবিতার সঙ্গে ব্যক্তির ও সমাজের সম্বন্ধ অন্তত দুই রকম। প্রথমত শ্রেষ্ঠ কবিতার ভিতর একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই যে, মানুষের তথাকথিত সমাজকে বা সভ্যতাকেই শুধু নয়, এমন-কি সমস্ত অমানবীয় সৃষ্টিকেও যেন তা ভাঙছে-এবং নতুন ক’রে গড়তে চাচ্ছে; এবং এই সৃজন যেন সমস্ত অসঙ্গতির জট খসিয়ে কোনও একটা সুসীম আনন্দের দিকে। এই ইঙ্গিত এত মেঘধবলিমা গভীর ও বিরাট, অথচ এত সুক্ষ্ম যে, ব্যক্তি সমাজ ও সভ্যতা তাকে উপেক্ষা করলেও (সব সময় উপেক্ষা করে না যদিও) এই ইঙ্গিতের প্রভাবে তারা অতীতে উপকৃত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও ব্যাপক ভাবে উদ্ধার লাভ করতে পারে। এই জন্যেই সমস্ত অতীত ও বর্তমান শ্রেষ্ঠ কাব্য তাদের নিজের প্রণালীতে মানুষের চিত্তকে যত বেশি অধিকার করতে পারবে সভ্যতার তত বেশি উপকার। কিন্তু খৃস্টান পাদরিরা যেমন জনতার হাজার-হাজার বর্গ-মাইলের দিকে তাকিয়ে বাইবেল বিতরণ করেন, শ্রেষ্ঠ কাব্য সে-রকম ভাবে বিতরিত হবার জিনিস নয়।
এই প্রসঙ্গেই ব্যক্তি সমাজ ও সভ্যতার সঙ্গে কবিতার দ্বিতীয় সম্বন্ধের কথা ওঠাতে পারি। কথাটা হয়তো স্বাদহীন শোনাবে, কিন্তু, আমার মনে হয়, তা সত্য। কবিতা সকলের জন্যে নয়, এবং যে-পর্যন্ত জন-সাধারণের হৃদয় নতুন দিগ্বলয় অধিকার না করবে সে-পর্যন্ত কয়েকটি তৃতীয় শ্রেণির কবি’র স্কুল উদ্বোধন ছাড়া বাজারে ও বন্দরে-এবং মানব-সমাজ ও-সভ্যতার সমগ্রতার ভিতর কোনও প্রথম শ্রেণির কাব্যের প্রবেশের পথ থাকবে না; এমন-কি তা বিলাস, কল্পনাবিলাস পর্যন্ত ব’লে আখ্যাত হয় এবং হবে এই সব স্থূল উদ্গাতাদের কাছে-যদিও আমরা জানি তা কল্পনাবিলাস নয়, কিন্তু কল্পনা-মনীষার সাহায্যে যেন কোনও মহান-কোনও আদিম জননীর নিকট-যেন কোনও অদিতি’র নিকট প্রশ্ন, বারংবার প্রশ্নের বেদনা, প্রশ্নের তুচ্ছতা; বারংবার প্রতি যুগের স্তরে-স্তরে যেন কোনও নতুন সৃষ্টির বেদনা ও আনন্দ; অবশেষে এক দিন সমস্ত চরাচরের ভিতর সকলের জন্যে কোনও সঙ্গতির সৌন্দর্য পাওয়া যাবে ব’লে।
কবিতা আমাদের জীবনের পক্ষে সত্যই কি প্রয়োজন? কেন প্রয়োজন? কবিতা-যে এত অল্প লোকে ভালোবাসে সেটা কি প্রকৃতিরই নিয়ম, না কি অধিকাংশের বিকৃত কী দূষিত শিক্ষার ফল ? যদি আরও বেশি লোকে কবিতা ভালোবাসতে ও বুঝতে শেখে, তাহলে সেই অনুপাতে তারা ভালো ক’রে বাঁচতে শিখবে কি না-অর্থাৎ সেই অনুপাতে সমাজের মঙ্গল হবে কি না? মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনকে সর্বাঙ্গীণ ও সুখের ক’রে গড়বার সংগ্রামে ও সাধনায় কবিতার স্থান কোথায় ?-এ-প্রশ্নগুলো কোনও হিতসাধনমণ্ডলীর কর্মসচিবদের প্রশ্ন ব’লে মনে হয়, কিন্তু তবুও জিজ্ঞাসাগুলো নিটোল ও আন্তরিক, এবং বিশদ ভাবে নয়, সংক্ষেপে, হয়তো ইশারায়, এ-সব জিজ্ঞাসার উত্তর আমার উপরের কয়েকটি লাইনের ভিতর নিহিত রয়েছে।
কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে ভিড়ের হৃদয় পরিবর্তিত হওয়া দরকার; কিন্তু সেই পরিবর্তন আনবে কে? সেই পরিবর্তন হবে কি কোনও দিন? যাতে তিন হাজার বছর আগের জনসাধারণ কিংবা আজকের এই বিলোল ভিড়ের মতো জনসাধারণ থাকবে না আর? যাতে এলিজাবেথ’এর সময়ের ইংলন্ড’এ কিংবা, ধরা যাক, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বাঙলাদেশে যে-সব শ্রেষ্ঠ কাব্য রচিত হয়েছে, গণ-পাঠক সে-সবের গভীর বোদ্ধা হয়ে দাঁড়াবে? ভাবতে গেলেও হাসি পায়। কিন্তু তামাশার জিনিস নয় হয়তো। যখন দেখি শুধু তৃতীয় শ্রেণির সঙ্গীতশিল্পী ও চিত্রশিল্পীই শুধু নয়, এ-দিককার উচ্চতর শিল্পীরাও দিকে-দিকে স্বীকৃত হচ্ছে, তখন জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয় প্রথম শ্রেণির কবি নির্বাসিত হয়ে রয়েছে কেন? কিন্তু যখন দেখি তথাকথিত সভ্যতা কোনও এক দারুণ হস্তীজননীর মতো যেন বুদ্ধি স্খলিত দাঁতাল সন্তানদের প্রসবে-প্রসবে পৃথিবীর ফুটপাথ ও ময়দান ভ’রে ফেলছে, তখন মনে হয় যে, কোনও সূক্ষ্মতা, পুরোনো মেদ ও ইন্দ্রলুপ্তির বিরুদ্ধে যা, পুরোনো প্রদীপকে যে-অদৃশ্য হাত নতুন সংস্থানের ভিতর নিয়ে গিয়ে প্রদীপকেই যেন পরিবর্তন করে ফেলে, তার এই সাময়িকতা ও সময়হীনতার গভীর ব্যবহার যেন মুষ্টিমেয় দীক্ষিতের জন্যে শুধু-সকলের জন্যে নয়-অনেকের জন্যে নয়।
কিন্তু তবুও সকলের হৃদয়ের পরিবর্তন হবে কি? কবে? কে আনবে? কবিকে কি শিক্ষার অধিনায়ক সাজতে হবে? সৌন্দর্যপ্রবাদে স্পন্দিত ক’রে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে হবে? প্রপাগান্ডা করতে হবে ? ডিক্টেটর সাজতে হবে জীবনের সঙ্গতি ও সুষমার সাধনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ? যদি কোনও শেষ বৈকালিক ইন্দ্রজালে আজকের এই সভ্যতার মোড় ঘুরে যায় তাহলে কবিকে কিছুই করতে হবে না আর; তার নিজের প্রতিভার কাছে তাকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে শুধু কতিপয়ের হাতে তার কবিতার দান অর্পণ ক’রে; যে কতিপয় হয়তো ক্রমে-ক্রমে বেড়েও যেতে পারে- মানুষের হৃদয় তার পুরোনো আপোশ-অবলেপের ভিতর আর থাকতে পারছে না ব’লে। আর যদি সভ্যতার মোড় ঘুরে না যায় তাহলে কমরেডের দল এবং সাহিত্যের হব্গব্লিন’রা কাব্যের জন্যে একটা কিছু করবেনই নিশ্চয়। সাহিত্যজগতে গ্যয়টে বা ল্যাম, কিংবা তার নিজের ভাবে পেটার, অথবা রবীন্দ্রনাথ অথবা ইয়েটস্, কিংবা স্বসৃষ্ট পরিধিবিশেষের ভিতর এলিয়ট ইত্যাদির মতো প্রকৃষ্ট রসবোদ্ধাদের কথা ছেড়ে দিলেও বিদেশে বুর্জোয়া শ্রেণিদের ভিতরেও এমন অজস্র খাঁটি রসবোদ্ধা আছে যার হীন ভগ্নাংশও আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত সমাজে নেই; এ-দেশে রসবোধযে হৃদয়হীন ভাবে বিরল, কবির কোনও-কোনও শিথিল মুহূর্তের নিকট এর তিক্ততাও কম নয়।
কিন্তু সভ্যতার মেদ ও ইন্দ্রলুপ্তির যদি পুনর্যৌবন না ঘটে, যিনি তৃতীয় শ্রেণির কবি নন, অতএব স্বখাত সলিলে ধাতস্থ আমাদের দেশের সাহিত্যকর্মীদের সহানুভূতি যাঁর জন্যে একটুও নেই, তিনি কি করবেন? তিনি প্রকৃতির সান্ত্বনার ভিতর চ’লে যাবেন-শহরে বন্দরে ঘুরবেন-জনতার স্রোতের ভিতর ফিরবেন- নিরালম্ব অসঙ্গতিকে যেখানে কল্পনা-মনীষার প্রতিক্রিয়া নিয়ে আঘাত করা দরকার নতুন ক’রে সৃষ্টি করবার জন্যে সেই চেষ্টা করবেন; আবার চ’লে যাবেন, হয়তো উন্মুখ পঙ্গুদের সঙ্গে ক’রে নিয়ে, প্রকৃতির সান্ত্বনার ভিতর; সেই কোন আদিম জননীর কাছে যেন, নির্জন রৌদ্রে ও গাঢ় নীলিমায় নিস্তব্ধ কোনও অদিতির কাছে।
তার প্রতিভার কাছে কবিকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে; হয়তো কোনও এক দিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে তার কবিতাবৃত্ত প্রয়েজেন হবে সমস্ত চরাচরের সমস্ত জীবের হৃদয়ে মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসলের খেতে বুননের জন্যে।