এবিএম আতিকুর রহমান বাশার ঃ
তিন
দিন পূর্বে যে গ্রামটিতে ছিল মানুষের কোলাহল, আর চা’ স্টল, হাট-বাজরে
নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের বিশ্লেষণ! সে গ্রামটি এখন জনমানব শূণ্য বিরান ভূমি।
শুক্রবার দুপুরে দেবীদ্বার উপজেলার ১নং বড়শালঘর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের ছোট শালঘর গ্রামে সরেজমিনে যেয়ে এ চিত্র দেখা যায়।
পুলিশি
আতঙ্ক এড়িয়ে কিছু নারী-পুরুষ এবং শিশুরা নিজেদের বাড়ি পাহারায় দেখা গেলেও
নারী-পুরুষ শূণ্য পরিবারগুলির খোঁজ খবর নিতে দেখা উৎকন্ঠিত স্বজনদের।
ছোটশালঘর
গ্রামের মৈশান বাড়ির প্রবীণ ব্যাক্তি বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত
বিডিআর’র সুবেদার আবু তাহের জানান, ঘটনার সূত্রপাত ভোটের দু’দিন আগে বিজয়ী
মেম্বার আলম হাজারীর সমর্থক অটো রিক্সা চালক জিকির আলী ও ফরিদ মেম্বারের
সমর্থক মোশাররফ হোসেন সরকারের তর্ক ও হাতাহাতি নিয়ে।
এ মারধরের সংবাদে
আলম হাজারীর সমর্থকরা দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে ফরিদ মেম্বারের বাড়িতে
হামলা চালায়। হামলায় ফরিদ মেম্বারের সমর্থক আবিদ হোসেন সরকার, শাহজাহান
সরকার ও মোশাররফ হোসেন সরকারের দ্বিতল ভবনে ব্যপক ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা
ঘটায়।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আলম হাজারী ও তার বড় ভাই শাহজাহান হাজারীকে
আটক করে থানায় নিয়ে আসে। ওই সংবাদে আলম হাজারীর সমর্থক কয়েকশত নারী- পুরুষ
আলম হাজারীর মুক্তির দাবীতে কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের ছোটশালঘর
এলাকায় গাছের গুড়ি ফেলে অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এসময় পুলিশ
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও বিক্ষোভকারীদের ছত্র ভঙ্গ করতে মাইক যোগে আহবান,
মৃদু লাঠি চার্জ সর্বপরি ফাঁকাগুলি, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেট ছুরে।
এতে নারী সহ ২৫/২৬জন বিক্ষোভকারী বুলেট বিদ্ধ হন। অপর দিকে আলম হাজারীর
সমর্থকদের ইট-পাটকেল ও লাঠির আঘাতে একজন এসআইসহ ৪ পুলিশ আহত হন।
ওই
ঘটনার পর কুমিল্লা পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ৬০ জন রিজার্ভ ও মুরাদনগর,
বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, বাঙ্গরা বাজার থানাসহ শতাধিক পুলিশ নিয়ে সারাষি
অভিযান চালান। শুক্রবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দফায়-দফায় পুলিশি অভিযান
অব্যাহত আছে। ফলে ওই গ্রামটি এখন একরকম নারী-পুরুষ শূণ্য।
গ্রামের
অধিকাংশ বাড়ি-ঘরের দরজা ও প্রধান ফটকে (গেইটে) তালা ঝুলতে দেখা যায়। কিছু
কিছু বাড়ির ঘরের দরজা খোলা থাকলেও ঘরের ভেতরে সুকেস, আলমিরা, চেয়ার-টেবিল,
দরজা, জানালা, রান্না ঘরের চুলা ভাংচুর অবস্থায় দেখা যায়।
জুম্মা নামাজ আদায়ে মুসুল্লীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম, কোন কোন মসজিদে এক কাতারও পূর্ণ হয়নি।
দু’টি
বিয়ে বাড়িতে নিজেরা থাক দূরের কথা; স্বজন ও স্থানীয় কাউকে দেখা যায়নি।
দুটি প্রভাবশালী পরিবারের এ বিয়ের আনন্দে বিপুল লোক সমাগমের কথা থাকলেও
বরের সাজানো গাড়ির সাথে ৩/৪টি মাইক্রেবাস আসতে দেখা যায়। বিয়ের অনুষ্ঠানে
আসা অতিথিদের চোখে-মুখে ছিল আতঙ্ক আর হতাশার ছাপ।
আটক আলম হাজারীর
স্ত্রী অঞ্জনা আক্তার ও তার ননদ (আটক শাহজাহান হাজারীর স্ত্রী) ফরিদা
আক্তার জানান, গত বুধবার সকালে ছোট শালঘর গ্রামে আলম হাজারীর লোকজন বিজয়
মিছিলের প্রস্তুতি নেয়, পুলিশের বাঁধায় বিজয় মিছিল বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন
শোনতে পাই ছোট শালঘর ফরিদ মেম্বারের সমর্থকরা আলম হাজারীর সমর্থক জিকিরকে
মারধর করছে, ওই সংবাদ পেয়ে আলম হাজারীসহ তার কিছু সমর্থক ঘটনাস্থলে ছুটে
যান। কিছু বুঝে উঠার আগেই পুলিশ আলম হাজারী ও তার ভাই শাহজাহান হাজারীকে কে
মিমাংসার কথা বলে ডেকে নিয়ে অমানবিক লাঠি পেটায় অচেতন করে গাড়িতে তুলে
থানায় নিয়ে যায়। আলম হাজারীর সমর্থকরা এসময় তাদের মুক্তির দাবীতে বিক্ষোভ ও
সড়ক অবরোধ করে রাখে।
মোস্তফা সরকারের স্ত্রী হাজেরা খাতুন জানান, ঘটনার
দিন এলাকায় ৩/৪টি ঘর ও ২ টি দোকান ভাংচুর ও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটলেও
পরবর্তীতে পুলিশের যে তান্ডব চলে তা ৭১’রকেও হার মানিয়েছে। আমি ৭১’র দেখিনি
শুনেছি। বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা থেকে প্রায় দুই শতাধিক পুলিশ পুরো গ্রামটি
ঘিরে ফেলে। তল্লাসী চালানোর নামে বাড়িতে থাকা নারীদের লাঞ্ছিতই নয়, ওরা
ঘরের আসবাবপত্র ভেঙ্গে চুরে তছনছ করে দেয়, দরজা, বেড়া, জানালার গ্লাস
ভাংচুর করে। পুলিশ আমার আলমিরাতে থাকা ২০ হাজার টাকা এবং একটি মোবাইল সেট
নিয়ে যায়।
একই ঘটনার বর্ণনা দিতে যেয়ে সানিমোহাম্মদ বাড়ির সাহিনা আক্তার
জানান, পুলিশ আমাদের বাড়ির ৬নারীকে টানা হেচরা করে তুলে থানায় নিয়ে যায়।
প্রতিটি ঘরের রান্নার চুলা, আসবাব ভাংচুর ও ঘরের লেপ তোষকে পানি ঢেলে
ভিজিয়ে দেয়। এমন কোন ঘর নেই যেখানে পুলিশের তান্ডবের চিহ্ন নেই। রাতে
স্থানীয় মেম্বার ও গন্যমান্য ব্যক্তিদের সহযোগীতায় ২০হাজার টাকার বিনিময়ে
৬নারীকে ছাড়িয়ে আনা হয়। আমার দুধের শিশু কোলে থাকায় কান্নাকাটি করে রক্ষা
পাই। তবে গালে-কানে যে থাপ্পর মেরেছে তার যন্ত্রনা এখনো সইতে হচ্ছে।
আরিফ
সরকারের বাড়ির জয়নাল আবেদীনের মেয়ে সাজিদা জানান, আমার ভাতিজা সৌদী
প্রবাসী আশিকের ১০মাসের গর্ববতী ‘লিখা আক্তার’কে টানা হেচরা করে পুলিশ নিয়ে
যেতে চায়, আমরা অনেক অনুরোধ করে তাকে ছারিয়ে রাখি। ওই অবস্থায গর্ভবতী
‘লিখা’ আরো অসুস্থ্য হয়ে পড়লে আজ বেলা একটায় দেবীদ্বার হাসপাতালে তাকে
চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে।
দেবীদ্বার থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ
আরিফুর রহমান জানান, নজির বিহীন নিরাপত্তা ও কোন ধরনের সংঘাত ছাড়াই
নির্বাচন সম্পন্ন করেছি। অথচ নির্বাচনের দু’দিন পরই পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে
আলম হাজারী তার বাহিনী দিয়ে ফরিদ মেম্বারের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট
করে। তারা দা, ছেনি, লাঠি, রডসহ বিভিন্ন দেশীয় অন্ত্র নিয়ে সড়ক অবরোধ করে
গাড়ি ভাংচুর ও জনগনের ভোগান্তি সৃষ্টি করে। আমরা অত্যন্ত ধৈর্যসহকা কোন
ধরনের প্রাণ হাণী ছাড়াই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনি।
তিনি আরো জানান,
ঘটনার পর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলাকায় পুলিশ মোতায়েন ও সারাষি
অভিযানসহ ‘ব্লক রেইড’ করি। অপর দিকে আলম হাজারীর সমর্থক সেকেন্ড ইন কমান্ড
সুজন হালদার, শাহীন, নাজমুল রিফাতসহ তাদের প্রায় সহস্রাধীক কর্মী এলাকায়
পুলিশকে বিতর্কীত করতে নিজেদের সমর্থকরা নিজেদের ঘর দরজা ভাংচুর করে উল্টো
অভিযোগ পুলিশের উপর চাপাচ্ছে।