সাবেক
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রয়াণে আমরা শোকাহত।
শনিবার সকালে ৯২ বছর বয়সে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগের পর তাকে নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই
শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
প্রকাশের মধ্য দিয়ে গোটা জাতির বেদনাই প্রতিফলিত হয়েছে। তার মৃত্যু গোটা
জাতির জন্য অপূরণীয় এক ক্ষতি। একজন জাতীয় অভিভাবকের বিদায়।
আমরা জানি,
গত ৫০ বছরে দেশ ২৩ জন প্রধান বিচারপতি পেয়েছে। তবে গুণে ও ব্যক্তিত্বে
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ছিলেন অনেকের থেকেই আলাদা। রোববার সুপ্রিম কোর্ট
প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের জানাজার আগে দেওয়া বক্তব্যে
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশের
বিচারাঙ্গনে স্বর্ণযুগের বিচারপতিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। মনে রাখতে হবে,
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন দেশ কাঁপানো অষ্টম সংশোধনী মামলার রায় দিয়েছিলেন
তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। এ রায়ের ফলে
১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ঢাকার বাইরে হাইকোর্ট বেঞ্চ
স্থাপন এবং বিচারপতিদের কর্মপরিধি নির্ধারণে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া ক্ষমতা
বাতিল হয়ে যায়। রায়টি এমন এক সময় দেওয়া হয়, যার মাত্র কয়েক বছর আগে গায়ের
জোরে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেই এরশাদ কলমের এক খোঁচায় তৎকালীন প্রধান
বিচারপতিকে অবসরে যেতে বাধ্য করেন। অষ্টম সংশোধনী মামলায় দেওয়া রায়ের
মাধ্যমেই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন এবং একই বেঞ্চের সহযোগী বিচারপতিরা
সংবিধানের 'মৌলিক কাঠামো' ডকট্রিনটি চালু করেন, যা আজও সংবিধান-সংক্রান্ত
যে কোনো মামলায় অনুসৃত হয়, সংবিধানের সুরক্ষায় আদালতের হাতে এক মোক্ষম
হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
তবে যে কারণে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে দেশের
একেবারে তৃণমূলের মানুষও মনে রাখবেন তা হলো, ১৯৯১ সালে এ দেশের সংসদীয়
গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রায় তার পৌরহিত্য। যৌথ সংগ্রামের মাধ্যমে এরশাদের
বিদায় নিশ্চিত করলেও আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ আন্দোলনকারী দলগুলো গ্রহণযোগ্য
নির্বাচন অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে একমত হতে পারছিল না। তখনই
ঐকমত্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন। তার অধীনে সে সময় যে সংসদ
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তা শুধু অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুই ছিল না; পরবর্তী
সময়ে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনপ্রত্যাশী মানুষের কাছে রীতিমতো মডেল হয়ে
দাঁড়ায়। এটাও মানতে হবে, ২০০১-পরবর্তী সময়ে দলটির নেতারা বিচারপতি
সাহাবুদ্দীনের যত সমালোচনাই করুন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা দলের ভেতরের অনেকের মত উপেক্ষা করে তাকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছিলেন
১৯৯১ সালের নির্বাচনে তার দৃঢ়, সাহসী ও নিরপেক্ষ ভূমিকারই কারণে। বঙ্গভবনে
থাকাকালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন একদিকে সরল ও আড়ম্বরহীন জীবনযাপন করে এবং
আরেক দিকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সব বিষয়ে এমনকি নিজের প্রাধিকারকেও সংকুচিত
করে সততা ও নৈতিকতার যে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন, তা আজও কিংবদন্তি।
অস্থায়ী
রাষ্ট্রপতি থাকাকালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আরও কিছু জনমুখী পদক্ষেপ
নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষায় সে সময়ে বিশেষ
ক্ষমতা আইনসহ বেশ কিছু আইন বাতিলের বিষয়টির উদাহরণ দেওয়া যায়। তার এ
সিদ্ধান্তের ফলে যখন তখন নির্বাহী আদেশে সংবাদপত্র বন্ধ করার ক্ষমতা রদ হয়ে
যায়। একইভাবে সংবাদপত্র প্রকাশের আইনি সুযোগও সহজ হয়ে যায়। তিনি অস্থায়ী
রাষ্ট্রপতি থাকাকালে অধ্যাদেশ বলে দণ্ডবিধির ৫০০ ও ৫০১ ধারা সংশোধন করেন।
এর ফলে এখন যে কোনো মানহানির ফৌজদারি মামলায় সাংবাদিকদের সরাসরি গ্রেপ্তার
না করে আদালতের সমনের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করতে হয়।
আমরা মনে করি,
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তার কর্মকাণ্ড ও জীবনাচরণের মাধ্যমে যেসব দৃষ্টান্ত
রেখে গেছেন, তা শুধু গণতন্ত্র বা বিচারালয়-সংক্রান্ত সংকটকালে নয়, সব সময়
মানুষ স্মরণ করবে। তার জীবন ও কর্ম সুশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য পাথেয় হয়ে
থাকবে।