ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
আত্মকথায় স্মৃতি ঃ আমার একাত্তর
Published : Tuesday, 22 March, 2022 at 12:00 AM
আত্মকথায় স্মৃতি ঃ আমার একাত্তর
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
(পূর্বে প্রকাশের পর)
২৫ মার্চ রাতে প্রথমে পুলিশ লাইন আক্রান্ত হয়। কারণ, কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করতে হলে পুলিশ লাইন অতিক্রম করতে হয়। সেদিন বীর পুলিশবাহিনি যে সাহস ও শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, প্রশিক্ষিত পাকিস্তানী সৈনিকদের ভারী ভারি অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে সমস্ত রাত্র অতিবাহিত করতে হয়েছিল। অনেক নাম জানা অজানা বীর পুলিশ সে রাতে শহীদ হন, শহীদ হন কুমিল্লার পুলিশ সুপার মুন্সী কবির উদ্দিন আহমদ এদিকে ২৪ মার্চ কুমিল্লা সার্কিট হাউসে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক শামসুল হক খান কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছেন। এখান থেকে পুলিশ সুপার মুন্সী কবির উদ্দিন আহমদ বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ খবর ও পরামর্শ নিতেন। পুলিশ লাইনে পুলিশবাহিনিকে যুদ্ধের জন্য পূর্ণ সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেন এবং অস্ত্রাগারের সকল অস্ত্র পুলিশবাহিনিকে বিলি করে দেন। কাজেই কুমিল্লায় প্রথম পাকবাহিনির সঙ্গে যুদ্ধ হয় পুলিশ লাইনে বীর পুলিশবাহিনির সঙ্গে। ঐদিন পুলিশবাহিনি যে অসীম সাহস ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন জাতি তাঁদেরকে আজীবন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে ও করবে।
জানতে পারি ২৬ মার্চ ভোরবেলা কুমিল্লা সার্কিট হাউস থেকে মেজর আগা ও ক্যাপ্টেন বোখারী কুমিল্লার জেলা প্রশাসক শামসুল হক খান সিএসপি কে ধরে নিয়ে যায় । সকাল ৭ টায় পুলিশ সুপার মুন্সী কবির উদ্দিন আহমদকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে নির্মমভাবে অত্যাচার করে হত্যা করা হয়। তাঁরা দুজন স্বাধীনতার ঊষালগ্নে শহীদ। তাঁদের হাজারো সালাম। কুমিল্লাবাসী তাঁদেরকে চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে, কৃতজ্ঞতা জানাবে।

নিজের কথাই বলব
২৬ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল ১৯৭১-এ ১৫ দিন আমি যেন এক মৃত্যুপুরীতে ছিলাম। কুমিল্লা শহরের ছাতিপট্টি এলাকার দক্ষিণ পার্শ্বে সুপারিবাগানের গুহ বাড়ি মূল রাস্তা থেকে একটু ভিতরে। অতি পরিচিত ঐতিহ্যবাহী এ বাড়িটি সকলের চেনা। এ বাড়ির লোকজনও সকলের পরিচিত। এজন্য ভয়ও বেশি। গুহ পরিবারের বাসায় ভিক্টোরিয়া কলেজের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক অশোকাঙ্কুর মুখোপাধ্যায় ছিলেন এবং আমি এ বাড়িতে থেকে কলেজে পড়াশোনা করেছি,তাঁদের স্নেহ-আদরে মানুষ হয়েছি। এ বাসায়ই আমার বিয়ে (৭ মে ১৯৭০) হয়েছে। যদিও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া কলেজে চাকুরি করি আমার স্ত্রী এ বাসায় থাকতেন আমিও সময়-অসময়ে যাতায়াত করি। পূর্বেই উল্লেখ করেছি এ সূত্র ধরে ২৪ মার্চ কুমিল্লায় চলে আসি। এ দুঃসময়ে দিন কাটে আতংকে, উৎকণ্ঠায়, রাস্তায় এলে মনে হতো এই বুঝি যমরাজ পাকসেনা বেশে হাজির, চারদিক থেকে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ, মনে হতো অতি কাছে, নাগালের মধ্যে। কুমিল্লার পরিত্যক্ত বিমানবন্দর সচল হয়ে যায়। সেখানে সামরিক হেলিকাপ্টার উঠানামা করতে শুরু করে। সেখানে কামান বসানো হয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে কামান দাগায়। একদিন প্রবল বৃষ্টি, আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, অবিরাম বজ্রপাত হচ্ছে, শীলা বৃষ্টি এবং গুলির আওয়াজ প্রায় একাকার, কোনো কিছু পৃথক করে বুঝার জো নেই। বিদ্যুৎ নেই, আকাশের বিদ্যুৎ চমকানোর মধ্যে মনে হলো গলির ভিতর যেন একটি গাড়ি ঢুকছে। ঢুকতেই গাড়ি থেমে কে ডি রায়ের (কালীদাস রায়, বিশিষ্ট ঔষধ ব্যবসায়ী) তাঁর বাসার সামনে থেমে যায়। কিছুক্ষণ পর গাড়ি চলে যায়। কী হয়েছে জানার জো নেই। পরের দিন শুনতে পাই কে ডি রায়কে ধরে নিয়ে গেছে।
আরো শুনেতে পাই এই রাতে দিগম্বরীতলা থেকে সাহা মেডিকেল হলের মালিক নিতাই সাহা, গুপ্ত জগন্নাথ বাড়ি থেকে প্রিয়লাল ঘোষ, কানাইলাল ধর, কাপড়িয়া পট্টি থেকে নীহার সরকার এবং শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সম্ভ্রান্ত হিন্দু ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পাকবাহিনি ধরে নিয়ে যায়। অশোকবাবু ও আমি পশ্চিমের দেয়াল ডিঙিয়ে ফয়জুননেছা বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকার (নাম মনে নেই) বাসায় আশ্রয় নেই। আশ্রিতদের প্রতি তাঁদের সহানুভূতি ও সহমর্মিতা ছিল আন্তরিক ও মানবিক। রাতে রুটি তরকারি খেতে দিয়েছিলেন। আমাদের আশ্রয় দিয়ে বিব্রতবোধ করেননি। কিন্তু এভাবে কতদিন লুকোচুরি করে বেঁচে থাকব। রাতে ঘুম নেই, দিনের বেলায় আতংকে সময় কাটাই, হাটবাজারও নেই, খাওয়া-দাওয়া অপ্রতুল, রুচিরও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এভাবে ৯ এপ্রিল তারিখ অশোকবাবু বাসা থেকে বের হলেন। তখন ১০ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত কারফিউ থাকত না কিন্তু হানাদার বাহিনির টহল ছিল। তিনি তাঁর সহকর্মিদের খোঁজ নিতে বের হয়েছেন। আমি স্নান সেরে ভিতরে সিঁড়িতে বসে আছি, আমার স্ত্রী স্নানে গেছেন। এমন সময় বাসার পূর্বপার্শ্ব দিয়ে একটি কলেজ পড়ুয়া ছেলে (তাকে চিনি না) হস্তদত্ত হয়ে বাসায় ঢুকে আমাকে বলল- 'স্যার এখানে আপনারা দু'জন কলেজ-শিক্ষক আছেন, এখনই বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।' বললাম, তুমি কে? কেন বাসা ছেড়ে যাব।' সে বলল, 'স্যার আমায় চিনবেন না, কেন বাসা ছেড়ে যাবেন তার উত্তর নেই। আপনারা চলে যান।" বলেই যে পথে এসেছিল তড়িগড়ি করে সে পথ অর্থাৎ দেয়াল টপকিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে, বাসার সবাই জেনে গেছে, অশোকবাবু ফিরে এসেছেন, তাঁকে বিষয়টি জানানো হলো। কালবিলম্ব না করে ১১টা বা কিছু পর হবে পরনে যে কাপড়চোপর (লুঙ্গি-জামা) পায়ে সেন্ডেলহ এবং আমার কাছে ১৪০.০০ টাকা ছিল তা নিয়ে রওয়ানা হওয়ার মুহূর্তে আমার স্ত্রী স্নান শেষে কাপড় রৌদ্র দিচ্ছিল, কাছে গিয়ে বললাম- 'চলি'। 'কোথায়'? ‘জানি না'। এরই মধ্যে যে ঘটনা ঘটে গেছে তা তিনি জানতে পারেন নি। শুধু মিতু বৌদি বললেন ‘বাধা দিও না, যাউক।' অশোকবাবু ও আমি অজানা পথে পা বাড়ালাম। বাসা থেকে বের হয়ে গোমতী নদীর বাঁধ ধরে অগ্রসর হয়ে মুচিপট্টিতে পৌছি, সেখানে একটি মন্দির ছিল, আমরা দু'জন শতবার মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলাম। তারপর আর পথ চিনি না। এমন সময় বাসার কাজের মেয়েলোক কার্তিকের মার ছেলে কার্তিক কোথা থেকে আসছে। আমাদের দেখে বলল, 'মামা কোথায় যান।' বললাম- ওপারে যাব রাস্তা চিনি না।' সে বলল, 'আমি আসছি।' সে কোথায় গেল এবং অল্প সময়ে এসে আমাদের পথ চিনিয়ে কুলুবাড়ি দিয়ে ত্রিপুরার সীমান্ত পার করে দেয়। এটুকু পথ, অল্পজলের গোমতী নদী পার হলাম, শত শত মানুষ চলছে সীমান্ত পারে। সকলেরই মনে আতংক ও উৎকণ্ঠা। এক অনিশ্চিত যাত্রা। ত্রিপুরা সীমান্ত পার হয়ে একটি চায়ের দোকান, সেখান থেকে এক টুকরা কাগজ নিয়ে পৌছ খবর এবং এখনই সকলে চলে আসার জন্য অনেকটা নির্দেশ জানিয়ে কাগজটি কার্তিকের হাতে দিয়ে সোনামূড়ার দিকে যাত্রা করেছি। আগেই বলেছি শত শত লোক নানা বয়সী নারী-পুরুষ, প্রতিজনের হাতে একটা কিছু না কিছু। এ জনস্রোতে রাস্তার পার্শ্বে একজন ফটো সাংবাদিক মুভি ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে। একজন বৃদ্ধা তা দেখে হঠাৎ চিৎকার করে ‘অ বাবারে গোলামের পুতেরা দেখি এইহানেও' বলেই অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি তাঁর আত্মীয় স্বজনরা তুলে বসালেন এবং জল নেই, পাখা নেই, কাপড়ের আঁচল দিয়ে বাতাস করে সুস্থ করে তুললেন এবং বিষয়টি বুঝিয়ে বলে আশ্বস্ত করা হলো। অশোকবাবু ও আমার খালি পা, নদীর পারে সেন্ডেল ফেলে এসেছি। কংকরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারছি না। অতি কষ্টে প্রাণ-বাঁচানো যাপিত নিশ্চিত আনন্দে কোনোক্রমে সোনামূড়া গিয়ে পৌছি। সেখানে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য এবং সকলই কুমিল্লার পরিচিত লোকজন। নানা প্রশ্ন। আমরা দুজন ক্ষুধার্ত, ততক্ষণ বুঝি নাই। সোনামূড়া পৌঁছে আপনজন দেখে এবং স্বস্তিবোধের কারণেই জৈবিক তাড়নার অন্যতম ক্ষুন্নিবৃত্তিটা জেগে উঠেছে। প্রবলভাবে। কুমিল্লার সুরেশ করের বিবেকানন্দ হোটেলে এক টাকা চার আনা দিয়ে দু'জন পেটভরে ভাত খেলাম। কিন্তু লুঙ্গি পরে তো থাকা যায় না। তাই কাপড় দোকানে সেখানে একজন দর্জিও আছেন, দুজনে পাজামা-পাঞ্জাবী তৈরি করতে দিলাম। তাতে সাত টাকা খরচ হলো, দুজোড়া খাদিমের সেন্ডেল কিনলাম। তাও বোধ হয় সাত টাকা। নয় মাস এ সেন্ডেল পরেই কাটিয়েছি।

(ক্রমশঃ)
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫