আবুল হাসানাত বাবুল ||
আলী তাহের মজুমদার জীবন সংগ্রামী একজন রাজনীতিক। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠেছিল কুমিল্লায় তিনি তাতে শরীক হন। মিছিল করেন। সমাবেশে যোগ দেন। সেজন্য তিনি ভাষাসৈনিক। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে থেকে অন্যান্য বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। তাই তিনি মুক্তিযোদ্ধা। সব মিলিয়ে আলী তাহের মজুমদার একজন জীবনযোদ্ধা। এই জীবনযোদ্ধা ২৩ জানুয়ারি সদর দেিণর নিজগ্রাম চাঁদপুরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী তার বয়স হয়েছিল ১০৭। অন্তত পঞ্চাশ বছর তাকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। দলীয় কোন পদ-পদবীর ধার ধারতেন না। তাকে কোন নেতৃত্বের স্থানে দেখিনি বরং আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জহিরুল কাইয়ুম, আবদুল আজীজ খান, এডভোকেট আহমেদ আলী, অধ্যাপক মোঃ খোরশেদ আলম, অধ্য আবুল কালাম মজুমদারের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে তাকে দেখেছি। বক্তৃতা শুনেছি। একজন নিরলস রাজনৈতিক কর্মী দিনরাত রাজনৈতিক কর্মে নিয়োজিত থাকতেন। দলীয় কোন নেতা তাকে সামান্য আর্থিক সহযোগিতা করতেন। আর তাতেই তিনি তার সংসার খরচ চালাতেন। তাঁর সামান্য চাষযোগ্য জমি ছিল। নিদারুণ দুঃখকষ্টে জীবন কাটিয়েছেন। পিতা মোঃ চারু মজুমদার কৃষকের সন্তান। মাতা সাবানি বিবি, গৃহিনী। ৫ ভাই, ১ বোনের মধ্যে আলী তাহের মজুমদার তৃতীয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিার চেয়ে জীবনমুখী শিাই ছিল বেশী। তার সাথে আমার বহুবার কথা হয়েছে। বহু জনসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে নিজের রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারণ করতেন। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পড়াশোনা শেষে জিলা স্কুলেও পড়াশোনা করেছেন। পারিবারিক অভাব-অনটনে স্কুল ছাড়তে হয়। খুব কম বয়সেই রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। সেই বয়সে কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন। সেকালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অতীন্দ্র মোহন রায়, হেদায়েত উল্লাহর সান্নিধ্যে ছিলেন। শরত্বসু, নেতাজি সুভাষ বসুর অনুসারী ছিলেন। ১৯৪৭ পূর্ব দেশভাগ আন্দোলনও করতেন। সোহরাওয়ার্দী-শরত্বসুর অবিভক্ত বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনেও ছিলেন। সময়ের বাস্তবতায় পাকিস্তান মেনে নিলেও ৪৮ সালে গঠিত মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগে সূচনাতেই ছিলেন। ১৯৫৪ সালেই কুমিল্লা কোতয়ালী আওয়ামী মুসলিম লীগের সেক্রেটারি হয়েছিলেন। এটাই ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের বড় পদ। বৃটিশভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের অমূল্য স্মৃতি ছিল তার কাছে। যেখানে বক্তৃতা করার সুযোগ পেতেন সেখানে তিনি তা বলতেন। তিননদী পরিষদের একুশে ফেব্রুয়ারির একুশদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের গতবারও তিনি ভাষা সৈনিক হিসেবে উদ্বোধন করেছিলেন। তার আগেও বহুবার তাকে তিননদীর একুশের অনুষ্ঠানে আনতাম। তিনি বক্তৃতা করতেন। স্মৃতিচারণ করতেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অনুপ্রেরণায় সেদিনের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের কথা বলতেন। কুমিল্লার তিন উল্লাহর কথাও জানাতেন। জনগণ একুশের আন্দোলনকে ছাত্রদের আন্দোলন বলতেন, কিন্তু খুব সহসাই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বিবৃতি দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন এটা বাংলা ভাষাভাষীদের আন্দোলন। গত দুই দশকে গণযোগাযোগ মাধ্যম অনেক শক্তিশালী হয়। বর্তমান প্রজন্মের সংবাদকর্মীরা তার বহু সাাতকার নিয়ে প্রকাশ করেছেন। সব কথাই তার নিজের। এই সবকিছু গবেষকদের কাজে আসবে। তারাই যাচাই-বাছাই করে ইতিহাসের পাতায় ঠাই দেবেন। তার জন্মসাল কারো মতে ১৯১৭, কারো মতে ১৯১৯। যদি তাই হয় তাহলে তার বয়স একশত হতে পারে। কিন্তু তিনি মুখে মুখে বলতেন একশত দশ হয়ে গেছে। ১৯৫৩ সালে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন। তারপর তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতিই করে গেছেন। সংবাদকর্মীদের কাছে একুশে পদকের কথাও বলতেন। রাষ্ট্রীয় বহু সুযোগ-সুবিধার কথাও বলতেন। আর্থিক সুবিধা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কথাও বলতেন। আর্থিক সুবিধা এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও তিনি পেয়েছেন। তবে হয়তো নিয়মিত পাননি। এজন্য আমি মনে করি দলীয় নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা তাকে অবহেলা করেছেন। রাজনৈতিকরাই তো রাজনীতিকদের বেশী অপমান করেন। অবহেলা করেন। নতুবা সরকারি দলের যারা ছিলেন তারা এমন একজন সংগ্রামীকর্মীর দায়িত্ব নিতে পারতেন অথবা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন। তিনি দুই ছেলে দুই মেয়ে রেখে গেছেন। তাদের সহায়তা করলেও আলী তাহের মজুমদারের আত্মা শান্তি পাবে। কুমিল্লার রাজনীতির ইতিহাসে সংগ্রামী রাজনীতিক আলী তাহের মজুমদার যে ইতিহাস হবেন সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।
শাহাজাদা গিয়াসউদ্দিন
একালের সমাজজীবনে একজন অমায়িক ভদ্রলোকের নাম শাহজাদা গিয়াসউদ্দিন। ভাল মানুষ হবার জন্য ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-আমলা হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। কোন রাজনৈতিক দলের বড় নেতা-কর্মী হলেই ভাল মানুষ হওয়া যাবে তারও কোন গ্যারান্টি নেই। একজন সফল ব্যাংকার হিসেবে তিনি পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করেছেন। সততার সঙ্গে চাকরি করেছেন। চাকরির আয়ে বাড়ি করেছেন। দুই পুত্রকে উপযুক্ত করেছেন। তাদের একজন চিকিৎসক। অন্যজন প্রকৌশলী। দুজনেই সরকারি চাকরি করেন। সহধর্মিনী শিকতা করেছেন। নাগরিক জীবনে সভ্যতা ও ভদ্রতা নিয়ে সময় কাটিয়ে গেছেন। চাকরি জীবন শেষে সময়কে কাজে লাগিয়েছেন সমাজসেবায়। অন্তত গেল একদশকে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির নির্বাহী কমিটির কোষাধ্যরে দায়িত্ব পালন করেছেন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে। সামাজিক কাজ করি। বহু কমিটির বহু কোষাধ্য দেখেছি। তাদের অনেকের সঙ্গেই ছিলাম। এখনো আছি। শাহজাদা গিয়াসউদ্দিনের মত কোষাধ্য পদ বুঝেন এবং অনুরুপ দায়িত্বপালন করার মত দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি আপাতত আমার চোখে ভাসে না। তিনি টাউনহল কমিটির সহসভাপতি, এই পদে অনেককে পাওয়া যাবে কিন্তু অন্ধকল্যাণ কমিটির কোষাধ্য পদের শূন্যতা পূরণ করা কঠিন হবে। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। একটা আদর্শ তিনি ছাত্রজীবনে গ্রহণ করেছিলেন। স্কুলজীবনে তিনি আমার এক কাস সিনিয়র হলেও আমরা ছিলাম পারস্পরিক বন্ধু। সহযোগী। তার নেতৃত্বে আমি কিছু অডিট কমিটিতে কাজ করেছি। তার যে এত দতা যদি তার কাছে না থাকতাম বুঝতাম না। ফাঁকি দিতে তিনি জানতেন না। তিনি যদি কোন অডিটফার্ম করতেন, নিশ্চয় তিনি সফল হতেন। আধুনিক মানুষ কিন্তু নামাজ-রোজা কোনদিন ছাড়েন নি। এমন কি পবিত্র হজ্বও পালন করেছেন। সবার সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে তিনি যেভাবে জীবনযাপন করে গেছেন তা কেবল সুনাগরিকের পইে সম্ভব। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন একজন সুনাগরিক। তিনি ২২ জানুয়ারী সন্ধ্যার পর আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অথচ সেদিনই বিকেল ৫টায় অসহায়দের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছিলেন। ৭০ বছর বয়সে একজন সুস্থ-সবল জনহিতকর মানুষের চলে যাওয়ায় দুঃখ পেয়েছি। পরদিন বেলা ১০ টায় মুন্সেফবাড়ি প্রাঙ্গণে মরহুমের জানাযায় মুসল্লিদের ঢল নেমে ছিল। মরহুমের অকৃত্রিম বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা আকম বাহাউদ্দিন বাহার এমপি যথার্থ অর্থেই বলেছেন শাহাজাদা গিয়াসউদ্দিন যে কত ভাল মানুষ ছিলেন এই জানাযাই তার প্রমাণ।