ড. সুলতান মাহমুদ রানা ||
বিশেষ পদ্ধতিতে এইচএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশিত হয়েছে। দেশের ইতিহাসে কোনো পাবলিক পরীায় এবারই প্রথম শতভাগ শিার্থী পাস করেছে। সার্বিক বিচারে পরীার ফল যথেষ্ট সন্তোষজনক। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জিপিএ ৫ প্রাপ্তির বিষয়টি শিার্থীদের প্রত্যাশা এবং স্বস্তির সামঞ্জস্যতা ল করা গেছে। স্বাভাবিকভাইে এমন ভালো ফলের খবরটি আমাদের প্রফুল্ল করেছে। তবে ভালো ফলের পরিপ্রেেিতও বেশ কিছু প্রশ্ন এবং শঙ্কার বিষয় অনুভূত হচ্ছে। খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই শিার্থীদের আগামী দিনের পথচলার বিষয়টি আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপকতায় এবং প্রচারণায় এখন আর কারো বুঝতে বাকি নেই যে উচ্চশিায় নির্ধারিত আসনের চেয়ে এইচএসসি ও সমমানের পরীায় পাস করা শিার্থী অপোকৃত বেশি। এ কারণে উত্তীর্ণ শিার্থীদের সবাই ভর্তি হতে পারবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীায় পাসের পর শিার্থীরা উচ্চশিার স্তরে প্রবেশ করে। ফলে প্রতিবছরই যখন এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীার ফল প্রকাশ হয়, তখন আমরা উচ্চশিার ত্রে নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা করি। বিশেষত আগের বছরের তুলনায় পরের বছরে ভালো ফলাফল এবং উচ্চশিার আসন সীমিত থাকার প্রসঙ্গটি বারবার উচ্চারিত হয়। এবারও বিশেষ পদ্ধতিতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীার ফল এবং শতভাগ শিার্থী পাস করায় উল্লিখিত চ্যালেঞ্জটি আরো বড় শঙ্কার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বিগত বেশ কয়েক বছরের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিবছর ক্রমেই আগের বছরের তুলনায় ফল ভালো হয়েছে, যা দেশের শিাব্যবস্থার জন্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। এ বছর আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। প্রত্যাশার মাপকাঠি বিবেচনায় প্রাসঙ্গিকভাবেই উচ্চ মাধ্যমিকে সদ্য উত্তীর্ণ শিার্থীদের ল্য, ভবিষ্যৎ এবং করণীয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই কমবেশি চিন্তিত।
আমাদের দেশে যেভাবে প্রত্যাশিত ফল নিয়ে শিার্থী ও অভিভাবকরা উচ্চশিার স্বপ্ন বাঁধছে, সেভাবে অনেক েেত্রই তা পূরণ হচ্ছে না। এ জন্য দেশের শিাব্যবস্থার ধরন এবং এর বাস্তবমুখী প্রয়োগ ও সুযোগের পদ্ধতিগত দিককেই দায়ী করা যায়। প্রতিবছরই যেভাবে শিার্থীরা জিপিএ ৫ পাওয়ার গৌরব অর্জন করছে, তাতে তাদের প্রত্যাশার মাত্রা ক্রমেই আকাশছোঁয়া হয়ে উঠছে। অন্যদিকে যারা জিপিএ ৫ পায়নি, তাদের ভবিষ্যৎও মোটেও অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়। ত্রেবিশেষে তারাই সমাজের জন্য অধিক সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের কাস শুরু হয়, তখন খেয়াল করে দেখেছি মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে জিপিএ ৫ পায়নি এমন শিার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। আবার এসব শিার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল করে দেশ ও জাতির কাজে আসছেন। তাঁরাই একদিন দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হচ্ছেন। সে জন্য নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, জিপিএ ৫ পাওয়া এবং না পাওয়া উভয়ের জীবনই যথেষ্ট সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে।
আমাদের দেশের বাস্তবতা একটু ভিন্ন। শিার্থীসহ অভিভাবকদের বেশির ভাগই পর্যায়ক্রমে পিইসি, জেএসসি এবং এসএসসি ও সমমান পরীায় ভালো ফলের সঙ্গে সঙ্গে একটি বিরাট স্বপ্ন লালন করতে শুরু করে। যারা প্রথম হোঁচটটি খেয়ে যায় উচ্চশিায় আশানুরূপ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেরে। অনেক েেত্রই উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফল না করেই উচ্চশিায় ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। প্রতিযোগিতার বাজারে সবাই পছন্দের এবং প্রত্যাশিত প্রথম জায়গাটিতে বসতে পারবে এমন কথাও ঠিক নয়।
সাধারণত যেসব শিার্থী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীায় কৃতিত্বের সঙ্গে জিপিএ ৫ পায়, তারা উচ্চশিায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর মধ্যে কোনো একটিতে জায়গা করে নিতে চায়। এটি খুব স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখজনক হলো, উভয় পরীায় জিপিএ ৫ পাওয়া এসব শিার্থীর সংখ্যার অনুপাতে ভালো বা কাঙ্তি বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। শুধু তা-ই নয়, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিার েেত্রও যথেষ্ট পরিমাণে মানসম্মত শিাপ্রতিষ্ঠান নেই। যখন একজন মেধাবী শিার্থী তার মেধার যথাযথ এবং কাঙ্তি মর্যাদা পায় না, তখন সে এই জাতির জন্য কতটুকুই বা কল্যাণকর হতে পারে? সাধারণত দেখা যায় যে শিার্থীদের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও প্রাপ্তির যথাযথ সমন্বয় না ঘটলে সেখানে সৃষ্টি হয় চরম হতাশা। আর এমন হতাশাই সৃষ্টি করে সমাজে নানা ধরনের অনাকাঙ্তি ঘটনার।
আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিার্থী তাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় ঘটাতে সম হয় না। অনেকের জীবনই হোঁচট খেয়ে যায় কিংবা অনেকেই কাঙ্তি ধাপে পৌঁছাতে পারে না।
কাজেই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, সব শিার্থী তার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যেন একটি কাছাকাছি সমন্বয় ঘটাতে পারে সেদিকে বিশেষভাবে ল রাখা এবং এ ল্েযই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শুরু করে শিার সব স্তরে শিার প্রায়োগিক দিকের গুণগত মান নিশ্চিত করা। শুধু ভালো ফলের পরিমাণগত মাত্রা না বাড়িয়ে সত্যিকার অর্থেই মেধাবী সন্তানদের দিয়ে জাতিকে পুনর্গঠন করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলকে সচেতন হতে হবে। আর এই সচেতনতাই সমাজ, রাষ্ট্র এবং শিাব্যবস্থাকে দৃঢ়তার সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে পারবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়