এবিএম আতিকুর রহমান বাশার ঃ
নলআরায় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের স্থান নির্ধারনি জটিলতায় স্থানীয়দের সাথে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে দেবীদ্বার উপজেলার পূর্ব ফতেহাবাদ গ্রামের মোকামবাড়ি ঈদগাহ মাঠে ওই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ফতেহাবাদ ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ আব্দুল খালেক’র সভাপতিত্বে এবং ইটালি প্রবাসী মো. মোখলেসুর রহমান সরকার’র সঞ্চালনায় উক্ত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাকিব হাসান, বিশেষ অতিথি ছিলেন ছাত্রলীগ কুমিল্লা উত্তর জেলা সভাপতি ও স্মৃতিসৌধ নির্মান ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ‘অনিকএন্টার প্রাইজ’র পরিচালক আবু কাউছার অনিক। আলোচনায় অংশ নেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সুলতান আহমেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হুমায়ুন কবির, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সহিদুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. এরশাদুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোহর আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোশাররফ হোসেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উপজেলা নেতা সাইফুল ইসলাম মিঠু, খাইরুল ইসলাম, শিবলী আহমেদ প্রমূখ।
স্মৃতিসৌধ নির্মানের স্থাননিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে দু’টি পক্ষ তৈরী হয়। এক পক্ষের দাবী মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জমাদার বাড়ি সংলগ্ন ‘নল আরা’য় (এক সময়ের গভীর জঙ্গলে) যেখানে অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষন ক্যাম্প’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেখানেই স্মৃতি সৌধ নির্মাণ হবে। যুদ্ধ প্রশিক্ষণস্থল নলআরায় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ হলে সরকারের দায়িত্বে এখানে জনস্বার্থে সড়ক নির্মাণ হবে, হাজার হাজার পথচারির যাতায়তে দির্ঘদিনের সংকট দূর হবে। প্রশিক্ষণস্থলে স্মৃতি সৌধ নির্মাণ হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সঠিক অবস্থান নির্ধারণ হবে। জমির মালিকদেরও জমিদানে আপত্তি করছেননা। পর্যটক ও দর্শনার্থীরা সঠিক ইতিহাসের সাথে পরিচিতি পাবে। অন্যত্র হলে তা প্রতিকী হবে।
অপর পক্ষের দাবী এখন আর সেই গভীর জঙ্গলটি নেই, অনেক আবাসন তৈরী হয়েগেছে, অনেকেই সংকটে পড়ে জমি হাত বদল করে ফেলেছে। তাছাড়া ঘটনাস্থলে যাতায়তেরও কোন রাস্তা নেই। অতএব নলআরার পাশর্^বর্তী সড়কের পাশে স্মৃতিসৌধ তৈরী হলে দৃষ্টিনন্দন হবে, পথচারি এবং দর্শনার্থীরা সহজেই মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক এ স্থানটির পরিচয় পেয়ে যাবে।
এব্যাপারে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল থেকে ফিরে এসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাকিব হাসান জানান, স্মৃতিসৌধ যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের স্থান ‘নলআরায়’ই হবে। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস- ঐতিহ্য সংরক্ষনে বাস্তব সফলতা পাবে।
উল্লেখ্য এ স্থানটিকে স্মরনীয় করে রাখতে দেবীদ্বার উপজেলা প্রেসকাবের উদ্যোগে ২০১০ সালের ১২ মার্চ ওই স্থানে ‘৭১’র চিঠি পাঠ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলনী’র আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট মোনায়েম সরকার’র সভাপতিত্বে এবং সাংবাদিক, লেখক, কলামিষ্ট, রাজনীতিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এ,বি,এম আতিকুর রহমান বাশার’র সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) নির্বাচনী এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য, সরকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কীত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী, সচিব ও জাতীয় সংসদের প্যানাল স্পিকার এবিএম গোলাম মোস্তফা, চিঠিপাঠ অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ.আ.ম.স আরেফিন সিদ্দিক, বিশেষ অতিথি ছিলেন কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাক্ষনপাড়া) নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য ও সাবেক আইন মন্ত্রী এডভোকেট মতিন খসরু, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামন্ডুলীর সদস্য এএফএম ফখরুল ইসলাম মূন্সী, দেবীদ্বার উপজেলা পরিষদ’র সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হুমায়ুন কবির, সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মামুনুর রশীদ ভূইয়া সহ দেশবরেণ্য ব্যাক্তিবর্গরা উপস্থিত ছিলেন।
ওই অনুষ্ঠানের পর বিভিন্ন সময়ে, সভা-সমাবেশ, সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষকদের লেখালেখিতে স্থানটি সরকার ও প্রশাসনের নজরে আসে। জেলা পরিষদের তত্বাবধানে নলআরায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১১ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে ‘নলআরা’য় মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী প্রশিক্ষন ক্যাম্পে একটি ‘স্মৃতিফলক’ নির্মাণ করা হয়। সে লক্ষ্যে ২০১১ সালের ৪ এপ্রিল দেবীদ্বার ডাক বাংলোতে কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) নির্বাচনী এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক সরকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কীত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী, সচিব ও জাতীয় সংসদের প্যানাল স্পিকার এবিএম গোলাম মোস্তফার সভাপতিত্বে এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মামুনুর রশীদ ভূইয়া, মুক্তিযোদ্ধা, গন্যমান্য ব্যাক্তি ও গনমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতে এক সভায় ‘নলআরা’ মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী প্রশিক্ষন ক্যাম্পের স্মৃতিফলক নির্মান কমিটি গঠন করা হয়।
ওই বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিফলক নির্মানের লক্ষ্যে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুস সামাদ’কে আহবায়ক করে ৫ সদস্যের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিফলক নির্মাণ কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটির সদস্য ছিলেন, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সুলতান আহমেদ, স্থানীয় সমাজ সেবক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম জমাদার, উপজেলা প্রকৌশলী এবং দেবীদ্বার উপজেলা প্রেসকাবের সাবেক সভাপতি, সাংবাদিক, লেখক, কলামিষ্ট, রাজনীতিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবিএম আতিকুর রহমান বাশার। ওই সালে জেলাপরিষদ কর্তৃক প্রাপ্ত বরাদ্ধ ৫০ হাজার টাকায় একটি ‘স্মৃতি ফলক নির্মান করা হয়েছিল।
চলতি বছরে কুমিল্লা-৪ দেবীদ্বার নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের সহযোগীতায় এবং উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রায় ৬ লক্ষ টাকা প্রাক্কলন ব্যয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ‘অনিক এন্টার প্রাইজ’ ওই ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মান করতে যাচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা দেবীদ্বার উপজেলার ৬নং ফতেহাবাদ ইউনিয়নের ফতেহাবাদ গ্রামের জমাদার বাড়ি সংলগ্ন ‘নল আরা’য় (এক সময়ের গভীর জঙ্গলে) অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষন ক্যাম্প’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী-পরিষদ সচিব সফিউল আজমের একান্ত সচিব আবদুল মান্নান সরকারের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে পর্যায়ক্রমে প্রায় ৪/৫ শত মুক্তিকামী জনতা এয়ারগান, থ্রী নট থ্রী রাইফেল, ডেমি বন্দুক আর লাঠি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষন শেষে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে চুড়ান্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ে ঝাপিয়ে পড়েন। ওই প্রশিক্ষন শিবিরের প্রশিক্ষক ছিলেন সেনাবাহিনীর (অবঃ) সদস্য আবু মিয়া এবং মুকবল আহমেদ।
মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের সীমান্ত এলাকা সন্নিকটে থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত পাড়াপাড়ে যেমন সহজ ছিল, তেমনি তৎকালিন পূর্বপাকিস্তানের প্রধান সেনাছাউনী কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনম্যান্ট সন্নিকটে থাকায় মাত্মক ঝুকিতে ছিলেন এ এলাকার মানুষ। মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ ও নির্জন এলাকা হওয়ায় ওই ‘নলআরা’ নামক গভীর জঙ্গল’টিকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন ক্যাম্প হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন স্থানীয় মুক্তিকামী যোদ্ধারা। এখান থেকে প্রাথমিক প্রশিক্ষন শেষে যোদ্ধারা ভাতের ত্রীপুরা রাজ্যের বক্সনগর, আগড়তলার পালাটোনা ক্যাম্প ও আসামের লোহারবন তেজপুর প্রশিক্ষন শিবিরে যোগদান করতেন। আফসু রাজাকার’র নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনী সক্রিয় হওয়ায় পরবর্তীতে উক্ত অস্থায়ী প্রশিক্ষণ শিবিরটি পরিত্যাক্ত ঘোষনা করা হয়। তবে ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্রইউনিয়ন কর্তৃক গঠিত আসামের (ভারত) লোহারবন তেজপুর মুক্তিযুদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরের শাখা এলাহাবাদ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও কিছুদিন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল।
একসময় দিনের বেলায় দেবীদ্বার উপজেলার পূর্ব ফতেহাবাদ গ্রামের ওই নলআরায় অর্থাৎ গভীর জঙ্গলে একা যেতে কেউ সাহস পেতেন না স্বাধীনতা যুদ্ধের পর গত ৪৯ বছরে এ জঙ্গলের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে, জঙ্গল কেটে আবাসন ও আবাদী জমি তৈরী হয়েছে। আর্টিফিশিয়াল বনায়ন করা হয়েছে।
স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে ভারত ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী প্রশিক্ষন ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। দেবীদ্বার উপজেলায় ওই সময় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা মন্ডুলীর সদস্য ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নিজ গ্রাম এলাহাবাদ, ফতেহাবাদ গ্রামের নলআরায় এবং শুভপুর গ্রামে আরো একটি সেটেলাইট মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প সহ তিনটি অস্থায়ী প্রশিক্ষন ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। তারই একটি ‘নলআরা’, এ স্থানটি স্মরণীয় করে রাখতে জেলা পরিষদের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।