মানুষের জীবনে ধৈর্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
Published : Friday, 12 March, 2021 at 12:00 AM
মানুষের জীবনে সবর বা ধৈর্যধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দুনিয়া ও পরকালে সবরের নেয়ামতও অনেক বেশি। তাই জীবনে বিপদ-মুসিবত নেমে এলে অস্থিরতা প্রকাশ না করে ধৈর্যধারণ করাই উত্তম। আর তাতে আল্লাহর কাছে পাওয়া যাবে অনেক প্রতিদান।
জগৎ বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমের নব্বই স্থানে সবর সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।’ হাদিসে পাকে সবরকে জ্যোতি বা আলো বলা হয়েছে।
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘সবরকে আমরা আমাদের জীবন-জীবিকার সর্বোত্তম মাধ্যম হিসেবে পেয়েছি।’ (বুখারি)
হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘ঈমানের ক্ষেত্রে সবরের উদাহরণ হল দেহের মধ্যে মাথার মত।’ এরপর উঁচু আওয়াজে তিনি বললেন, ‘যার ধৈর্য নাই তার ঈমান নেই।’
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা ধৈর্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট এবং ব্যাপকতর দান কাউকে দেননি।’ (আবু দাউদ)
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
‘আল্লাহর নির্দেশ ব্যতিত কোনো বিপদ আসে না আর যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে তিনি তাঁর অন্তরকে সঠিক পথের সন্ধান দেন।’ (সুরা তাগাবুন : আয়াত ১১)
যেসব ক্ষেত্রে সবর করতে হবে তা অনেকেই জানেন না। তিনটি বিষয়ের ওপর সবর করতে হবে। তাহলো-
- আল্লাহ তাআলার আদেশের উপর সবর করা।
- আল্লাহ তাআলার নিষেধের উপর সবর করা।
- বিপদাপদে সবর করা।
আয়াতের মর্মার্থ-
- আল্লাহ তাআলা যার অন্তরকে সঠিক পথের সন্ধান দেন; সে হল ওই ব্যক্তি যে বিপদে পড়লে বিশ্বাস করে যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। ফলে বিপদে পড়েও সে খুশি থাকে এবং সহজভাবে তাকে গ্রহণ করে।’
- ‘যে ব্যক্তি বিপদে পড়লে বিশ্বাস রাখে যে, এটা আল্লাহর ফায়সালা মোতাবেক এসেছে। ফলে সে সবর করার পাশাপাশি পরকালে এর প্রতিদান পাওয়ার আশা রাখে এবং আল্লাহর ফয়সালার কাছে আত্মসমর্পণ করে; আল্লাহ তাআলা তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আর দুনিয়ার যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে তার বিনিময়ে তিনি তার অন্তরে হেদায়েত এবং সত্যিকার মজবুত বিশ্বাস দান করেন। যা নিয়েছেন তার বিনিময় দান করবেন।’
- ‘যে ব্যক্তি ঈমান আনে আল্লাহ তার অন্তরকে হেদায়েত দেন।’- এর অর্থ হলো- সে কোনো ক্ষয়-ক্ষতি ও বিপদের সম্মুখীন হলে বলে ‘ইন্না ল্লিাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ অর্থাৎ আমরা আল্লাহর জন্যই আর তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’
সবরের প্রয়োজনীয়তা
মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। মুমিনের প্রতিটি পদক্ষেপে ধৈর্যের প্রয়োজন। আল্লাহর নির্দেশের সামনে ধৈর্যের প্রয়োজন। আল্লাহর পথে দাওয়াতের ক্ষেত্রে ধৈর্যের প্রয়োজন। কারণ এ পথে নিজেকে পরিচালিত করলে অনেক বেশি কষ্ট-বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
‘আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সঙ্গে বিতর্ক করুন উত্তম পন্থায়। নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তাই ওই ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞান রাখেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে।’ (সুরা নাহল : ১২৫)
‘আর যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঐ পরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ তোমাদের কষ্ট দেয়া হয়। যদি ধৈর্যধারণ কর, তবে তা সবরকারীদের জন্যে উত্তম।’ (সুরা নাহল : আয়াত ১২৬)
‘আর আপনি সবর করবেন। আপনার সবর আল্লাহর জন্য অন্য কারও জন্য নয়; তাদের জন্যে দুঃখ করবেন না এবং তাদের চক্রান্তের কারণে মন ছোট করবেন না।’ (সুরা নাহল : আয়াত ১২৭)
দুনিয়াতে দ্বীন কায়েম তথা সত্যের পথে চলতে গেলে চরম ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। বিপদ-আপদের সময় ধৈর্যধারণ সম্পর্কে ছেলেকে উপদেশ দিয়েছেন হজরত লোকমান। কুরআনে এসেছে-
হে ছেলে! নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, সৎকাজে আদেশ দেবে, মন্দকাজে নিষেধ করবে আর বিপদাপদে সবর করবে। নিশ্চয়ই এটা সাহসিকতার কাজ।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৭)
সুতরাং নানাবিধ বিপদ-মুসিবত, কষ্ট ও জটিলতার সামনে মুমিনের ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। তাই দুনিয়াতে যত সংকটই আসুক না কেন; মনে করতে হবে এসব আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। বিপদকে হালকাভাবে মেনে নেয়া, বিপদে আল্লাহর প্রতি খুশি থাকাও ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা।
সবর করার সময় কোনাভাবেই ক্ষোভ, হতাশা ও অস্থিরতা প্রকাশ করা যাবে না। নিজের ভাষা ও আচরণকে সংযত রাখাও জরুরি।
সবরের বৈশিষ্ট্য
বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- সবর বা ধৈর্যধারণ বান্দার গোনাহ মাফের অন্যতম উপায়। বান্দা ধৈর্যধারণ করলে আল্লাহ তার গোনাহ ক্ষমা করে দেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ‘আল্লাহ যখন কোনো বান্দার কল্যাণ চান তখন দুনিয়াতেই তাকে শাস্তি দেন। কিন্তু বান্দার অকল্যাণ চাইলে তিনি তার গোনাহের শাস্তি থেকে বিরত রেখে কেয়ামতের দিন তার যথার্থ প্রাপ্য দেন।’ (তিরমিজি)
এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘বিপদ-মুসিবত হল নেয়ামত। কারণ এতে গোনাহ মাফ হয়। বিপদে ধৈর্যধারণ করলে তার প্রতিদান পাওয়া যায়। বিপদে পড়লে আল্লাহর কাছে আরও বেশি রোনাজারি করতে হয়। তার কাছে আরও বেশি ধরণা দিতে হয়। আল্লাহর কাছে নিজের অভাব ও অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরার প্রয়োজন হয়। সৃষ্টি জীব থেকে বিমুখ হয়ে এক আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হয়। যাবতীয় বিপদের মধ্যে এ রকম অনেক বড় বড় কল্যাণ নিহিত রয়েছে।’
মনে রাখা জরুরি
ধৈর্যের পরিণতি প্রশংসনীয়। বান্দার বিপদ-আপদে যদি গোনাহ ক্ষমা হয়, পাপগুলো ঝরে যায় তবে মুমিন বান্দার জন্য এটা অনেক বড় নেয়ামত। আর বিপদ-মুসিবত যদি কোনো ব্যক্তির মধ্যে ধৈর্য ও আনুগত্য সৃষ্টি করে তবে এই মুসিবত তার জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে বিশাল নেয়ামতে পরিণত হয়।’
এ কারণেই মহান আল্লাহ তাআলা জীবনের সব কষ্ট ও বিপদাপদে নামাজ ও সবরের মাধ্যমে তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, এতেই মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। ধৈর্যের পরিণতি প্রশংসনীয়। আল্লাহ তাআলা মুমিনকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-
‘হে মুমিনগন! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা ধৈর্য্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৩)
সুতরাং বান্দার বিপদ যত কঠিন ও বড় হবে তার প্রাপ্তিও তত বড় হবে। হাদিসে পাকে প্রিয় নবি এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে ঘোষণা করেন-
‘বিপদ যত কঠিন হয় পুরস্কারও তত বড় হয়। আল্লাহ কোনো জাতিকে ভালবাসলে তাদেরকে পরীক্ষা করেন। সুতরাং যে তাতে সন্তুষ্ট থাকে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান আর যে তাতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে আল্লাহ তার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে যান।’ (তিরমিজি)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করার মাধ্যমে দুনিয়া ও পরকালের সব নেয়ামত ও সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।